অভিমত

বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক ভঙ্গুরতা

স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বহু ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ প্রভূত উন্নতি করেছে। মানুষের গড় আয়, প্রত্যাশিত গড় আয়ু, সাক্ষরতার হার বেড়েছে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হারে উল্লম্ফন ঘটেছে। পরিবহন ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির উন্নতি ঘটেছে। বেসরকারি খাত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে, ডিজিটাল ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। অন্যান্য আর্থসামাজিক সূচকেরও

স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে বহু ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ প্রভূত উন্নতি করেছে। মানুষের গড় আয়, প্রত্যাশিত গড় আয়ু, সাক্ষরতার হার বেড়েছে। বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী ভর্তির হারে উল্লম্ফন ঘটেছে। পরিবহন ব্যবস্থা, রাস্তাঘাট, যোগাযোগ ব্যবস্থাসহ আর্থিক অন্তর্ভুক্তির উন্নতি ঘটেছে। বেসরকারি খাত দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে, ডিজিটাল ব্যবস্থা তৈরি হয়েছে। অন্যান্য আর্থসামাজিক সূচকেরও উন্নতি হয়েছে। জনসংখ্যার বেশির ভাগই এখন তরুণ, দেশজুড়ে ব্যবসায়িক উদ্দীপনার কমতি নেই। মানুষের হাতে হাতে সেলফোন। পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে দেশের দক্ষিণের সঙ্গে মধ্যভাগের যোগাযোগের উন্নতি হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের বেশ কয়েকটি কাঠামোগত এবং প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যা রয়েছে, যা দেশকে তার সম্পূর্ণ ক্ষমতায় বিকশিত হতে

দিচ্ছে না।

প্রথম সমস্যা মানসম্পন্ন পরিকাঠামোর ঘাটতির। স্বাধীনতা অর্জনের পাঁচ দশক পরও রেল, সড়ক, বিদ্যুৎ, সেচ, বন্দর, বিমানবন্দর এবং অধুনা ব্রডব্যান্ড সংযোগ, সব ক্ষেত্রেই মানের বিপুল ঘাটতি রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের বাজেটের বড় অংশ চলে যাচ্ছে ভর্তুকি আর সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা-পেনশন পুরনো ঋণের সুদাসল পরিশোধে। পরিকাঠামো খাতের জন্য অবশিষ্ট থাকছে সামান্যই। তার ওপরে আছে ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা, পরিচালনা ব্যর্থতা, অস্বচ্ছ নিয়ম-কানুন, দুর্নীতি এবং এখন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খাতায় ক্রমবর্ধমান অনাদায়ি ঋণের পাহাড়।

দ্বিতীয় ঘাটতি শিক্ষায়। দেশে বহু চাকরির জন্যই ন্যূনতম যোগ্যতা লাগে মাধ্যমিক শিক্ষার। কিন্তু সেই অবধি লেখাপড়া করার আগেই দরিদ্র পরিবারের বিপুলসংখ্যক ছেলেমেয়ে ঝরে পড়ছে অর্থনৈতিক কারণে, মেয়েদের ক্ষেত্রে বিয়ে করার চাপেও। স্কুল-কলেজের শিক্ষার গড় মানও নিচুই থেকে গেছে। আজকের বেশির ভাগ চাকরির জন্য সে শিক্ষা যথেষ্ট নয়। বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ, দক্ষতা তৈরি এবং বিশেষত গ্রামাঞ্চলে এবং ছোট শহরে প্রশিক্ষিত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে নিয়োগকারী সংস্থার যোগাযোগ দুর্বল। আশ্চার্যের বিষয় উদ্বৃত্ত শ্রম-এর দেশে নিয়োগযোগ্য শ্রমিকের বড়ই অভাব।

তৃতীয়ত, ভঙ্গুর স্বাস্থ্য খাত। গত কয়েক বছরে অতি উৎসাহী ভঙ্গিতে হাসপাতাল-ক্লিনিকসহ নানা অবকাঠামো তৈরি হয়েছে বটে, কিন্তু সেগুলোর বেশকিছু অব্যবহূত পড়ে রয়েছে। ভবন আছে কিন্তু চিকিৎসক কর্মী নেই, নেই যন্ত্রপাতিও। জনস্বাস্থ্য সেবার ঘাটতির ফলে রোগব্যাধির প্রকোপ অনেক, শ্রমিকের উৎপাদনশীলতাও কম।

উপরের সমস্যাগুলোর প্রতিটির ক্ষেত্রেই সরকারের প্রশাসনিক সাফল্য ব্যর্থতার প্রশ্নটি জড়িত। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স নিম্ন। রাষ্ট্রের সক্ষমতাকে চারটি মাপকাঠিতে পরিমাপ করা যেতে পারেসাংগঠনিক, কারিগরি, অর্থনৈতিক রাজনৈতিক।

কাজের সঙ্গে উন্নতির যোগ না থাকলে সাংগঠনিক সক্ষমতা বিকশিত হয় না। যেমন বাংলাদেশে পদোন্নতি ঘটে বয়স মেনে দলীয় রাজনৈতিক বিবেচনায়, কর্মদক্ষতার ভিত্তিতে নয়। ঘন ঘন এবং অসুবিধাজনক বদলির হুমকিও কর্মীদের বাধ্য করে রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য থাকতে। নিজের দক্ষতা বৃদ্ধির চেয়ে রাজনৈতিক সংযোগ তৈরিতে মনোযোগী হলে সরকারি কর্মীরা লাভবান হন বেশি। নিয়মিত নজরদারি না থাকায় ফাঁকি দেয়ার অনেক সুযোগ তৈরি হয়। আবার সৎ উদ্দেশ্যেও যদি কোনো সরকারি কর্মী কোনো ভুল সিদ্ধান্ত নেন, তাহলে তদন্তের মুখে পড়ে বিপুল হয়রানির উদাহরণ আমাদের সামনেই রয়েছে। অনেকে ভালো কাজ করে তিরস্কারের শিকার হয়েছেন, হারিয়েছেন চাকরিও। ফলে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করার চেয়ে হাত-পা গুটিয়ে রাখাকেই অনেকে নিরাপদ ভাবেন।

রাষ্ট্রের কারিগরি সক্ষমতার প্রশ্নটিও গুরুত্বপূর্ণ। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার একে আরো বিস্তৃত করেছে। বায়োমেট্রিকনির্ভর অর্থ প্রদানের পদ্ধতি দ্রুততর অধিকতর নিশ্চয়তার সঙ্গে কাজ করছে, তুলনায় কম দুর্নীতি হচ্ছে, কিন্তু প্রযুক্তির সুফল মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। বিচার ব্যবস্থা, অডিট এবং অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থার ক্ষেত্রেও পথে প্রশাসনিক সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা ভাবা প্রয়োজন। জমির রেকর্ড নথিভুক্ত করা বা লেনদেনের ক্ষেত্রে ডিজিটাল ব্যবস্থা ব্যবহার করে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে প্রযুক্তির ব্যবহার এবং নাগরিকের ব্যক্তিগত তথ্য সংগ্রহে রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধির নেতিবাচক দিক হলো, নাগরিকের ওপর সরকারের নজরদারির ক্ষমতাও বাড়ে। শাসকরা ক্ষমতার অপব্যবহার এবং তারই সঙ্গে পুরনো কিছু আইনকে অস্ত্র বানিয়ে নাগরিক সমাজের মধ্যে থেকে উঠে আসা যেকোনো প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করতে সচেষ্ট হয়।

রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আর্থিক সামর্থ্যও ব্যাপক নয়। ফলে রাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিসরও সীমিত। বাংলাদেশে কর জিডিপির অনুপাত মাত্র শতাংশ। একটি গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে অনুপাত অনেকখানি কম তো বটেই, আজ থেকে এক দশক আগেও অনুপাত যা ছিল, এটি তার চেয়েও কম। এই অর্থাভাবের কারণেই বাংলাদেশের সরকারি কর্মীর পদও খালিই থেকে যায়। আবার কথাও সত্য, বাংলাদেশে প্রশাসন, পুলিশ, বিচার বিভাগ, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাসহ সরকারের প্রতিটি শাখাতেই বহু পদ দীর্ঘদিন শূন্য পড়ে রয়েছে, যার সবই অর্থাভাবের কারণে নয়। যে কর্মীরা অফিসে রয়েছেন, বহু পদ খালি থাকার কারণে তাদের ওপর কাজের চাপ বেশি, ফলে বহু ক্ষেত্রেই তারা অকুশলী হয়ে পড়েন। পরিস্থিতিটি রাজনীতিকদের পক্ষে ভালো! নিজেদের প্রাপ্যটুকু আদায়ের জন্য সরকারি দপ্তরে ঘুরে ঘুরে জুতা ক্ষয়ে যাওয়ার পরই মানুষ নেতাদের দ্বারস্থ হন। নেতাদের কাছে তা এক সুযোগ বটে। ব্যবস্থাটার শতভাগ সুফল তারা ঘরে তোলেন। তারা মানুষকে কিছু পাইয়ে দিয়ে ভোটের দাবি করেন, যা নিতান্তই খারাপ দৃষ্টান্ত।

বাংলাদেশে কর জিডিপির অনুপাত এত কম কেন প্রশ্নের উত্তরে বাংলাদেশের অস্বাভাবিক রকম বড় অনানুষ্ঠানিক খাতের দিকে আঙুল তুলতে হবে। কৃষিশ্রমিকদের বাদ রাখলেও দেশের মোট শ্রমিকের প্রায় ৭৫ শতাংশ কাজ করেন অনানুষ্ঠানিক খাতে। তাদের বেশির ভাগই প্রত্যক্ষ করের আওতায় পড়েন না, কিন্তু সংগঠিত ক্ষেত্রেও করের হার কম। ব্যক্তিগত আয়ে (দীর্ঘমেয়াদি) মূলধনি লাভের ওপর করের হার অনেক কম। বিনিয়োগ করলে ব্যক্তিগত আয়করের ওপর ছাড়ের সুবিধাও পান প্রধানত ধনীরাই। দেশে বিত্তকর, এবং উত্তরাধিকার কর নেই বললে চলে, এমনকি সাম্প্রতিক সময়ে দেশে বিত্তশালীদের সম্পদের পরিমাণ বহুলাংশে বৃদ্ধি পাওয়ার পরও।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা আমলাদের স্বার্থও অতি প্রবল। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলোর অধিকাংশই ব্যর্থ। এর বড় কারণ নেতা বা আমলারা নিজেদের ক্ষমতা ছাড়তে চান না। সে কারণেই সংস্থাগুলো খাতা-কলমে স্বশাসিত হলেও তাদের প্রকৃত অর্থে স্বশাসনের অধিকার নেই। নিজেরাই সে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে চান না অনেকে। বাংলাদেশে আর্থিক সংস্কারের পর থেকে অর্থনীতিতে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার আধিপত্য কমেছে; কিন্তু চীনে যেভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে, বাংলাদেশে তা হয়নি। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো এখনো আমলা মন্ত্রীদের অঙুলিহেলনেই পরিচালিত হয়, নিয়ম মেনে হয় না।

নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় থাকার কারণে একচেটিয়া ব্যবসা উৎসাহ পায়, ফলে বাজার প্রতিযোগিতা দুর্বল হয়ে পড়ে। প্রায়ই অবসরপ্রাপ্ত আমলাদের নজরদারি সংস্থাগুলোর শীর্ষ পদে বসানো হয়। যে ব্যবসায়িক স্বার্থের ওপর তাদের নজর রাখার কথা, সে গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে অতিঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক শাসক শ্রেণীকে ক্ষেপিয়ে সেই ব্যবসায়িক স্বার্থের অন্যায় আচরণের পরিপন্থী সিদ্ধান্ত গ্রহণের সদিচ্ছা তাদের থাকে না বললেই চলে। সাম্প্রতিক কালে ধরনের নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর বাড়বাড়ন্তের ফলে সামগ্রিক ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা সমন্বয় আসার বদলে বরং তা হয়ে পড়েছে জটিল বহুধাবিভক্ত, দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া। দুর্বল কাঠামো প্রাতিষ্ঠানিক সমস্যাই বাংলাদেশের অর্থনীতি এগিয়ে নেয়ার পথে বড় বাধা।

এম এম মুসা: সহযোগী সম্পাদক, বণিক বার্তা

আরও