সময়ের ভাবনা

অসাম্য কমাতে বণ্টন ব্যবস্থার উন্নয়ন জরুরি

ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি রিপোর্ট আর অক্সফাম রিপোর্টে বাংলাদেশের অসাম্য ও দারিদ্র্যের আশঙ্কাজনক ছবি। অন্যদিকে ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্টে অতিধনী হওয়ার তালিকায় বাংলাদেশ প্রথম সারিতে। বিষয়টি নিয়ে এক দল বলছে যে দারিদ্র্য বাড়ছে, অসাম্য বাড়ছে, ধনীরা অতিধনী হচ্ছে; আর অন্য দল বলছে, বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে শ্রেষ্ঠ হওয়ার যাত্রায় এগিয়ে চলছে। তবে তার ফল সমাজের সব স্তরে

ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি রিপোর্ট আর অক্সফাম রিপোর্টে বাংলাদেশের অসাম্য ও দারিদ্র্যের আশঙ্কাজনক ছবি। অন্যদিকে ওয়ার্ল্ড আল্ট্রা ওয়েলথ রিপোর্টে অতিধনী হওয়ার তালিকায় বাংলাদেশ প্রথম সারিতে। বিষয়টি নিয়ে এক দল বলছে যে দারিদ্র্য বাড়ছে, অসাম্য বাড়ছে, ধনীরা অতিধনী হচ্ছে; আর অন্য দল বলছে, বাংলাদেশ বিশ্বদরবারে শ্রেষ্ঠ হওয়ার যাত্রায় এগিয়ে চলছে। তবে তার ফল সমাজের সব স্তরে প্রতিফলিত হতে সময় লাগবে।

অসাম্য বা বৈষম্য নিয়ে আলোচনার সমস্যা হলো অসাম্য এমন এক আপেক্ষিক বিষয়, যার থেকে প্রত্যক্ষভাবে জীবনযাত্রার মান—সেটি গড়পড়তা আয়ই হোক বা দারিদ্র্য—অনুমান করা কঠিন। অসাম্য বাড়লে তার সঙ্গে গড় আয় বাড়তেও পারে, কমতেও পারে। অসাম্য কমলেও তাই। তেমনই অসাম্য বাড়লে তার সঙ্গে দারিদ্র্য বাড়তেও পারে, কমতেও পারে—অসাম্য কমলেও তাই। তাই শুধু অসাম্য বেড়েছে বা কমেছে দেখে তার থেকে ভালো-মন্দ কোনো সিদ্ধান্তে আসা সহজ নয়, ঠিক যেমন অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বেড়েছে বা কমেছে, তার থেকেও দারিদ্র্য বা অসাম্যের পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত সিদ্ধান্তে আসা যায় না।

নব্বইয়ের দশকের শুরুতে নেয়া আর্থিক উদারীকরণের পরের দুই দশকের গল্পটা অনেকের জানা। আগের দশকগুলোর তুলনায় সে সময়ে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হার বেশি ছিল; দারিদ্র্য কমেছে, কিন্তু আয় ও সম্পদের অসাম্য বেড়েছে। নব্বইয়ের দশকের আগের দুই দশকে মাথাপিছু আয়ের গড় বৃদ্ধির হার ছিল শ্লথ, যা তার পরের দুই দশকে গতি লাভ করে। দারিদ্র্যরেখার নিচে থাকা জনসংখ্যার অনুপাত ২০০০ সালে ছিল ৪৯ শতাংশ, আর যে বছরে সর্বশেষ সরকারি পরিসংখ্যান পাওয়া যায় তাতে দেখা যায়, দারিদ্র্য কমে হয়েছে ২৪ শতাংশ (২০১৬)। কিন্তু এ পর্যায়ে অসাম্যও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য। অসাম্যের একটা সোজা এবং জনপ্রিয় মাপকাঠি হলো দেশের মোট আয় বা সম্পদে দরিদ্র ও ধনী শ্রেণীর ভাগ কতটা। সর্বশেষ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো পরিচালিত ‘হাউজহোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেনডিচার সার্ভে’ বলছে, বর্তমানে সবচেয়ে গরিব ৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীর আয়ের পরিমাণ মোট আয়ের মাত্র শূন্য দশমিক ২৩ শতাংশ। ২০১০ সালে এ হার ছিল শূন্য দশমিক ৭৮ শতাংশ। অন্যদিকে দেশের জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে ধনী ৫ শতাংশের আয়ের পরিমাণ এ সময়ের মধ্যে দেশজ মোট আয়ের ২৪ দশমিক ৬১ থেকে বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৮৯ শতাংশে। এ পরিসংখ্যান মূলত নির্দেশ করে, সবচেয়ে গরিব জনগোষ্ঠীর আয় ক্রমাগত কমছে। অন্যদিকে সবচেয়ে ধনীদের আয় ক্রমাগত বাড়ছে। গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) দেয়া তথ্যমতে, জিনি কোইফিশিয়েন্ট বিবেচনায় সম্পদ-অসাম্যের উদ্বেগজনক পরিমাণ শূন্য দশমিক ৭৪, যেখানে আয়ের অসাম্যের বেলায় এই জিনি কোইফিশিয়েন্ট হচ্ছে শূন্য দশমিক ৪৮। উল্লেখ্য, জিনি কোইফিশিয়েন্ট হচ্ছে ০ থেকে ১ পর্যন্ত আয়বৈষম্য ও সম্পদবৈষম্য পরিমাপের একটি অর্থনৈতিক সূচক, যেখানে ১ নির্দেশ করে পরিপূর্ণ বৈষম্য এবং ০ নির্দেশ করে পরিপূর্ণ সমতা। বুঝতে অসুবিধা হয় না, এক্ষেত্রে কোইফিশিয়েন্টের বিদ্যমান তথ্য উদ্বেগ সৃষ্টির জন্য যথেষ্ট। প্রকৃত বৈষম্য আরো খারাপের দিকে যাওয়ার শঙ্কা প্রবল। কারণ সমাজের সবচেয়ে ধনীরা তাদের প্রকৃত আয় ও সম্পদের পরিমাণ প্রকাশ করতে চায় না। 

তার পরের দশকের ছবিটা এত স্পষ্ট নয়—জাতীয় আয়ের মান, তার বৃদ্ধির হার, দারিদ্র্য এবং অসাম্য, প্রয়োজনীয় তথ্য-পরিসংখ্যান নিয়ে নানা বিতর্কের কারণে। সরকারি নানা পরিসংখ্যান সময়মতো প্রকাশ হয়নি। পরোক্ষ নানা পদ্ধতি ব্যবহার করে যে ছবিটা উঠে আসছে, তা থেকে বলা মুশকিল যে মাথাপিছু পারিবারিক ব্যয়ের ভিত্তিতে যেভাবে দারিদ্র্য মাপা হয়, সেই অনুযায়ী দারিদ্র্য বেড়েছে, কমেছে, নাকি একই আছে। অসাম্য বা বৈষম্যের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। অসাম্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির কারণে সৃষ্টি হওয়া সম্পদে দরিদ্রদের প্রাপ্তি কম। দরিদ্র শ্রেণী দুর্বল হওয়ায় তাদের যৌক্তিক পাওনা প্রদানের দায়িত্ব সরকারের। এ কারণে সরকার ধনীদের ওপর কর আরোপপূর্বক দরিদ্র্যদের তা বিতরণ করে। কিন্তু সরকার অতিমাত্রায় ধনীবান্ধব হওয়ায় কর আহরণের পরিমাণ কমছেই। মোট দেশজ উৎপাদন অনুপাতে কর আহরণের পরিমাণ ৮ শতাংশেরও নিচে, যা উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে সর্বনিম্নও বটে। ধনীরা ব্যাপক মাত্রায় সম্পদের মালিক হলেও কর প্রদানে তাদের অনীহা লক্ষ করা যায়। 

আয়বৈষম্য হ্রাসের ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে উদাহরণ হতে পারে মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ার সরকার আশির দশকের শুরুতে প্রান্তিক গোষ্ঠীর জন্য বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি গ্রহণ করে। নব্বইয়ের দশকের শুরুর দিকে মালয়েশিয়ায় আয়বৈষম্য যখন ক্রমে বাড়ছিল, তখন তারা নীতি কাঠামো সংস্কারের পাশাপাশি বিভিন্ন ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়া হয় এবং সত্যিকারের ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির কাছে যাতে সুবিধাগুলো পৌঁছায় তা নিশ্চিত করা হয়। এজন্য তালিকা করে কর্মসূচির প্রতিটি ধাপে নজরদারি বাড়ানো হয়। ২০১২ সালে মালয়েশিয়ার জিনি কোইফিশিয়েন্ট ছিল শূন্য দশমিক ৪৩১, যেটি ২০১৪ সালে কমে দাঁড়ায় শূন্য দশমিক ৪০১ এবং ২০১৬ সালে তা আরো কমে হয় শূন্য দশমিক ৩৯৯। তবে ২০১৯ সালে হঠাৎ করে জিনি কোইফিশিয়েন্ট কিছুটা বেড়ে যায়, যার সহগ ছিল শূন্য দশমিক ৪০৭। এটি নিয়ে সে সময়ে দেশটিতে ব্যাপক আলোচনা হয় এবং এটি কমিয়ে আনতে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে নতুন করে সাজানো হয়। 

প্রশ্ন হলো, আয় ও সম্পদের বৈষম্য কমিয়ে আনতে বাংলাদেশ সরকারের করণীয় কী? এর একটি উপায় হলো, ধনীদের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে দরিদ্রদের মাঝে সেটি যথাযথ বণ্টন করা। অন্য উপায় হলো দরিদ্রদের সক্ষমতা বাড়ানো। তাদের সামাজিক নিরাপত্তা জোরদারের মাধ্যমে অবস্থার উন্নয়নে সহায়তা জোগানো ও আয়বর্ধনমূলক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। 

নরওয়ে, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস ও জার্মানির মতো ইউরোপের কল্যাণ রাষ্ট্রগুলোর নীতি অনেক বেশি আয় পুনর্বণ্টনমূলক, যেখানে অন্তত প্রগতিশীল আয়কর ও সম্পত্তি করের মতো প্রত্যক্ষ করের মাধ্যমে জিডিপির ৩০-৩৫ শতাংশ রাজস্ব হিসেবে সংগ্রহ করে সরকার। সংগৃহীত অর্থ সরকার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, পরিবেশ উন্নয়ন, নিম্নবিত্ত পরিবারের খাদ্যনিরাপত্তা, গণপরিবহন, বেকার ভাতা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়নে ব্যয় করে। 

অনেক দেশই আয়বৈষম্য কমাতে সবচেয়ে কার্যকর উপায় হিসেবে প্রগ্রেসিভ কর ব্যবস্থা অনুসরণ করেছে। সেক্ষেত্রে সরাসরি কর, অর্থাৎ আয়করের আওতায় করযোগ্য সবাইকে আনতে হবে আর করনীতি হতে হবে আসাম্য কমানোর লক্ষ্যে। এক্ষেত্রে কর খাত সম্প্রসারণ করে রাজস্ব বাড়ানোর বিকল্প নেই। তার জন্য আবার প্রয়োজন সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা।

বাংলাদেশের বিদ্যমান করনীতি দেশে অসাম্য আরো বাড়িয়ে তোলার পেছনে ভূমিকা রাখছে। কিন্তু অর্থনীতিবিদরা বলে থাকেন, করনীতির মুখ্য দর্শন হচ্ছে সমাজে অসাম্য কমিয়ে আনা। ভুল করনীতির কারণে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে ধনীদের করের আওতায় আনতে। আর এ নেতিবাচক প্রভাবে সমাজে অসাম্য বাড়ছে। 

বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর দেয়া তথ্য হচ্ছে, আমাদের অর্থনীতির ৪৫-৬৫ শতাংশ সম্পদ করের আওতার বাইরে। কারণ অতিধনীদের কর দেয়া এড়ানোর জন্য রয়েছে নানা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সুযোগ। সরকারের রাজস্ব আয়ের বেশির ভাগই আসে অপ্রত্যক্ষ কর থেকে, যেমন ভ্যাট থেকে। এ অপ্রত্যক্ষ কর আরোপ করা হয় সব মানুষের ওপর, তার আয় কত তা বিবেচনা না করেই। যারা গরিব তারা তাদের বৃহত্তর অংশ ব্যয় করে এ ধরনের অপ্রত্যক্ষ করের পেছনে। অন্যদিকে আয়করের পরিমাণ বাড়ছে না। 

মূল কথা হলো, রাষ্ট্রকেই অসাম্য বা বৈষম্য নিরসনকারীর ভূমিকা নিতে হবে, যে রকম অনেকটা করা হয়েছে ভিয়েতনামে, দক্ষিণ কোরিয়া কিংবা ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোয়। সরকারকে রাজস্ব সংগ্রহ করতে হবে প্রধানত সমাজের উচ্চমধ্যবিত্তদের আয়কর ও সম্পদ কর থেকে। সরকারি ব্যয়ে প্রধান অগ্রাধিকার দিতে হবে বৈষম্যহীন ও মানসম্পন্ন প্রাথমিক শিক্ষায়, গরিবের জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা গড়ে তোলায়, মানসম্পন্ন ভৌত অবকাঠামো নির্মাণে, পরিবেশদূষণ নিয়ন্ত্রণে, খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে।

কর ব্যবস্থার সংস্কারের পাশাপাশি সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের অবস্থার উন্নয়নে প্রয়োজন বহুমুখী প্রয়াস। অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের ক্ষেত্রে সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে উন্নয়নের সুফল পৌঁছে দিতে হলে প্রয়োজন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি এবং শোভন কাজের ব্যবস্থা করা, যাতে সঠিক মজুরি ও সংশ্লিষ্ট সুযোগ-সুবিধার মাধ্যমে শ্রমজীবী মানুষের অবস্থার পরিবর্তন হয়।

অসাম্য কমানোর ক্ষেত্রে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপায় হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সংস্কার। সে পরিপ্রেক্ষিতে হতদরিদ্রদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর আওতা বৃদ্ধি এবং দরকার মাথাপিছু বরাদ্দে ব্যাপক পরিবর্তন আনা। সেই সঙ্গে পুরো প্রক্রিয়ায় অভিনবত্বও প্রয়োজন। শহরাঞ্চলের দরিদ্র মানুষের জন্য নতুন নতুন কর্মসূচির দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি। অঞ্চলভিত্তিক বৈষম্য কমানোর ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়া ও দুর্যোগপ্রবণ এলাকাগুলোয় সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি জোরদার করতে হবে। 

এম এম মুসা: সহযোগী সম্পাদক, বণিক বার্তা

আরও