বাংলাদেশ বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) চেয়ারম্যান আশিক মাহমুদ চৌধুরী ৭ জানুয়ারি নিজ কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে আগামী দুই বছরে দেশের পাঁচটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে (এসইজেড) ৫৫০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ ও আড়াই লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির ঘোষণা দিয়েছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অন্যান্য আরো কিছু কারণে বেশ কয়েক বছর ধরেই দেশে দেশী-বিদেশী উভয়বিধ বিনিয়োগের ধারা যেখানে অনেকটা নিম্নমুখী, সেখানে হঠাৎ করেই বেজা চেয়ারম্যানের দেয়া এ ঘোষণা নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক। একইভাবে চরম বেকারত্ব প্রবণতার এ মুহূর্তে আগামী দুই বছরে শুধু পাঁচটি এসইজেডেই যদি আড়াই লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়, তাহলে সেটি নিঃসন্দেহে এক মহাআনন্দের খবর। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির আগামী দুই বছরের যে লক্ষ্যমাত্রা তিনি দিলেন, সেটি কতটা বাস্তবসম্মত কিংবা অতীত অগ্রগতির ধারার সঙ্গে তা কতটা সামঞ্জস্যপূর্ণ?
২০১১ সালে বেজা গঠিত হওয়ার পর এর আওতায় ১০০টি এসইজেড স্থাপনের যে প্রকল্প বা কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়েছে, তার মধ্যে গত ১২ বছরে স্থাপিত ও নির্মাণাধীন এসইজেডের সংখ্যা হচ্ছে ১৯। আর সে ১৯টি এসইজেডে শিল্প স্থাপনের জন্য গত বারো বছরে বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে প্রায় ১৫০ কোটি ডলারের। কিন্তু ওই প্রস্তাবের বিপরীতে বাস্তবে কত বিনিয়োগ হয়েছে, সংবাদ সম্মেলনে সে বিষয়ে জানতে চাওয়া হলেও বেজা চেয়ারম্যান তা জানাতে পারেননি। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের দেয়া তথ্যমতে এ সময়ের মধ্যে সেখানে বাস্তবে বিনিয়োগ হয়েছে মাত্র ৭৬ লাখ ডলার। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন দাঁড়ায়, দীর্ঘ এক যুগে ১৯টি এসইজেডের জন্য আসা ১৫০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাবের বিপরীতে বাস্তবায়নের হার যেখানে ১ শতাংশেরও কম এবং এসইজেড স্থাপনের ভৌত অগ্রগতির হার যেখানে অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক, সেখানে কোন জাদুমন্ত্রবলে বেজা চেয়ারম্যান আগামী দুই বছরে সাড়ে পাঁচশ কোটি ডলারের বিনিয়োগ নিশ্চিত করে ফেলবেন, তা এক গুরুতর প্রশ্ন বৈকি! বলা প্রয়োজন, দেশে সরকার বদল হলেও বেজার এ কাজগুলো কিন্তু সেখানকার স্থায়ী লোকজনই করবেন এবং রাতারাতি তাদের দক্ষতা ও মানসিকতায় বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন এসে যাবে এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। তাহলে বেজা চেয়ারম্যান ঘোষিত উল্লিখিত লক্ষ্যমাত্রা কীভাবে কোন ‘বৈপ্লবিক’ কায়দায় অর্জিত হবে?
সত্যি কথা বলতে কি, আমাদের অধিকাংশ আমলাই তার ঊর্ধ্বতনকে খুশি করার জন্য নানা ফোলানো-ফাঁপানো তথ্য দিতে খুবই অভ্যস্ত এবং এ ধরনের তোষামোদি ও চাটুকারিতামূলক কাজে তারা এতটাই সিদ্ধহস্ত যে এটিকে তারা অনেকটা শিল্পের পর্যায়ে উত্তীর্ণ করে ফেলেছেন। আমি একবার এক সংস্থাপ্রধানের সহযোগী কর্মকর্তা হিসেবে একটি ঋণ প্রকল্পের নথি নিয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মহোদয়ের কাছে গেলে তিনি তা দেখে খুব নম্রভাবেই বললেন, ‘সবই তো ঠিক আছে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এসব শর্ত মেনে কর্মীরা তো কোনো ঋণ নিতে পারবে না। তাই শর্তগুলো শিথিল করা যায় কিনা দেখুন।’ মন্ত্রী মহোদয়ের মন্তব্যের পর পরই সেখানে সচিবের পক্ষে উপস্থিত অতিরিক্ত সচিব আমাদের উদ্দেশ্য করে অনেকটা উচ্চকণ্ঠেই বললেন, ‘আপনারা কী কাজ করেন? দেশে রাজনৈতিক সরকার। ফলে রাজনৈতিক কর্মীদের সুবিধা-অসুবিধার বিষয়গুলোর দিকে খেয়াল রাখবেন না?’ বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে ঋণ ম্যানুয়ালে এ শর্তগুলো না থাকলে পরে ঋণ আদায় করা কষ্টকর হবে। আমাদের যুক্তি কাজে এল না। তারা ঋণের শর্ত শিথিল করে তা পরবর্তী সভায় উপস্থাপনের সিদ্ধান্ত দিলেন। সে অনুযায়ী শর্ত শিথিলকৃত ম্যানুয়াল নিয়ে স্পিকারের সভাপতিত্বে পরবর্তী সভা আহ্বান করা হলো। স্পিকার সংশোধিত ম্যানুয়াল দেখে বললেন, ‘এ ম্যানুয়াল মেনে ঋণ দিলে তো এক পয়সাও আদায় হবে না। আমরা রাজনীতিকরা আজ আছি, কাল নাই। কিন্তু আপনারা এরূপ শিথিল শর্তে ঋণ আদায় করবেন কীভাবে? যৌক্তিক শর্ত যুক্ত করে ম্যানুয়াল পুনর্বিন্যাস করুন।’ স্পিকারের কথা শেষ না হতেই তার মুখের কথা টেনে নিয়ে সেই অতিরিক্ত সচিব আমাদের বললেন, ‘স্যার তো ঠিকই বলেছেন। আপনারা ঋণের শর্ত এত শিথিল করলেন কেন?’ সেদিন আর তাকে বলা হয়নি যে আগের সভায় দেয়া আপনার চাটুকারী নির্দেশের কারণেই তা করতে হয়েছে। তবে ওই স্পিকারের কথা আজও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
বস্তুত এই হচ্ছে বাংলাদেশের আমলাতন্ত্রের মোটামুটি চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য। বেজা চেয়ারম্যানও হয়তো তার ঊর্ধ্বতনকে খুশি করার জন্যই বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের এ চাটুকারিতামূলক লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছেন। নইলে সংবাদ সম্মেলনে যেখানে তিনি বিগত সময়ে এসইজেডগুলোয় কত বিনিয়োগ হয়েছে সেটাই বলতে পারলেন না, সেখানে মাত্র পাঁচটি এসইজেডে আগামী দুই বছরে ৫৫০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ ও আড়াই লাখ লোকের কর্মসংস্থানের অবাস্তব ঘোষণা দিলেন কিসের ভিত্তিতে? যদি ধরেও নেয়া হয় যে এরই মধ্যে পাওয়া ১৫০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাবের সবটাই বাস্তবায়িত হবে (যা বাস্তবে কোনোদিনও সম্ভব নয়) তাহলেও ৫৫০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে আরো ৪০০ কোটি ডলার লাগবে। সেটি তিনি জোগাড় করবেন কোত্থেকে? এর মধ্যে কিছু বিনিয়োগ প্রস্তাব হয়তো অবশ্যই আসবে। কিন্তু অভিজ্ঞতার আলোকে বলা যায়, তাই বলে সেটি কিছুতেই ৪০০ কোটি ডলার হওয়া সম্ভব নয়। আর যে পরিমাণের বিনিয়োগ প্রস্তাবই আসুক না কেন, আসার পর সেগুলোকে বাস্তবে রূপদান করা কি এ দুই বছরের মধ্যে সম্ভব? মোটেও না।
অন্যদিকে পাঁচ এসইজেডে দুই বছরে আড়াই লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য সেখানে কত সংখ্যক শিল্প-কারখানা দরকার, এ ঘোষণাদানের আগে সেটি কি হিসাব করে দেখা হয়েছে? মনে রাখা দরকার যে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) ব্যাপকায়ন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উদ্ভাবন ও এর দ্রুত ব্যবহার-বিস্তৃতি, শিল্প-প্রযুক্তির উৎকর্ষিক বিকাশের পরিপ্রেক্ষিতে এ খাতে প্রযুক্তিঘনতা বেড়ে যাওয়া প্রভৃতি নানা কারণে শিল্প-কারখানায় জনবলের চাহিদা ক্রমেই নিম্নমুখী হয়ে পড়ছে। ফলে ৫৫০ কোটি ডলারের অবাস্তব বিনিয়োগ প্রস্তাবকে বাস্তব ধরে নিয়েও যদি হিসাব করা হয়, তাহলেও দেখা যাবে যে এর মাধ্যমে আড়াই লাখ লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হওয়া সম্ভব নয়। কারণ বিনিয়োগ মানে তো শুধু পুঁজি ও অর্থ কোনো একটি নির্দিষ্ট স্থানে এনে জমা করা নয়। কোনো একটি বিনিয়োগের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের ভিত্তিতে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব প্রণয়ন থেকে শুরু করে পুঁজি সংগ্রহকরণ, অবকাঠামো নির্মাণ, যন্ত্রপাতি স্থাপন, কাঁচামাল সংগ্রহকরণ ইত্যাদি শেষ করে উৎপাদন পর্যায়ে ব্যাপকভিত্তিক লোকবল নিয়োগের বিষয়টি অনেকটাই অনেক পরের ধাপের কাজ। ফলে প্রতি ‘এত ডলারে এত লোকের কর্মসংস্থান হবে’—এরূপ কাগুজে হিসাব করে কর্মসংস্থানের ঘোষণা দিলে কিংবা কোনো হিসাব ছাড়াই ৫৫০ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা সামনে আনলে সেটি হাস্যকর হতে বাধ্য।
আর বেজা চেয়ারম্যানের এসব ঘোষণা অভিজ্ঞদের কাছে শুধু যে হাস্যাস্পদ বলেই বিবেচিত হচ্ছে তাই নয়, দেশের স্থানীয় ও বৈদেশিক বিনিয়োগের ব্যাপারে সাধারণের মধ্যে চরম বিভ্রান্তিও সৃষ্টি হচ্ছে। আর এসব তথ্যকে স্বতন্ত্রভাবে দেখতে গেলে কিছুতেই বোঝার উপায় থাকবে না যে বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রকৃত সাম্প্রতিক চিত্র কেমন ছিল বা এতৎসংক্রান্ত ভবিষ্যৎ গতিবিধি কোনদিকে ধাবিত হচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে একটাই সান্ত্বনা যে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত সব সরকারের আমলেই চাটুকারিতামূলকভাবে এ ধরনের অতিরঞ্জিত ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রদান করা হয়ে আসছে এবং তাতে কখনই কারো কোনো সমস্যা হয়নি কিংবা সহসা তা হবে বলেও মনে হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্য এ দেশের সাধারণ মানুষের যে তাদের কষ্টার্জিত করের পয়সায় যাদের ভরণপোষণ, তারা উল্লিখিত জনগণকে বিন্দুমাত্র কোনো হিসাবের মধ্যেই নিচ্ছে না। জনগণের কাছে তাদের যেমন কোনো জবাদিহিতা নেই, তেমনি এ ব্যাপারে তাদের নিজেদের মধ্যেও কোনো অপরাধবোধ আছে বলে মনে হয় না। আর এটা তো বলাই যায় যে বেজার এ ধরনের অবাস্তব ও বিভ্রান্তিমূলক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের বিষয়টি একটি চরম অপেশাদারত্বমূলক কাজ।
তবে এ বিষয়গুলো বেজা কর্তৃপক্ষ বুঝতে পারছে না, এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং তারা বুঝেশুনেই এসব করছে ঊর্ধ্বতনের কাছে নিজেদের দক্ষ ও চৌকস প্রমাণের জন্য, যেমনটি বেজায় এবং অন্যত্র তাদের পূর্বতনেরাও করেছেন। অনুপুঙ্খ ও বিস্তারিত খোঁজ নিলে দেখা যাবে যে গত ৫৪ বছরে বাংলাদেশের রাষ্ট্র খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন পঞ্চবার্ষিক, প্রেক্ষিত, বার্ষিক ও অন্যান্য উন্নয়ন পরিকল্পনার আওতায় স্ব স্ব কাজের যেসব লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, সেগুলো একসঙ্গে যোগ করলে ক্রমপুঞ্জিত যে লক্ষ্যমাত্রা দাঁড়াবে, তা অর্জনের জন্য হয়তো শত বছরেরও বেশি লেগে যাবে। অসহায় সাধারণ জনগণের অজান্তে বাংলাদেশের রাষ্ট্র খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো এ কাজগুলোই পাঁচ দশক ধরে পরম ‘নির্ভারতার’ সঙ্গে করে যাচ্ছে। তবে একটি জবাবদিহিতামূলক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে এমনটি কখনই হওয়ার কথা নয়। তা সত্ত্বেও তেমনটি যে হচ্ছে তা ওই জবাবদিহিতা ও গণতন্ত্রহীনতারই ফল, যার সুবিধা (আসলে অপ-সুবিধা?) বেজা বা বেজা চেয়ারম্যানও ভোগ করছেন। এ অবস্থায় বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানসহ সব ধরনের বিভ্রান্তিমূলক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের প্রবণতা থেকে যত দ্রুত বেরিয়ে আসা যাবে, দেশ, রাষ্ট্র ও জনগণের জন্য ততই মঙ্গল। তবে সেটি আমলাতন্ত্রের কায়েমি স্বার্থরক্ষার ক্ষেত্রে মঙ্গলজনক নাও হতে পারে।
আবু তাহের খান: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), শিল্প মন্ত্রণালয়