ভোটের আগে স্থিতিশীল আবহ তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ

শক্তিশালী সিভিল সোসাইটি গড়ে ওঠে মূলত দু’ভাবে। এটি গড়ে ওঠার পরিবেশগুলো রাষ্ট্রের তরফ থেকে নিশ্চিত করা দরকার। আপনি যদি এমন কোনো আইন করে রাখেন যে আমি ফেসবুকে একটা পোস্ট দিলাম

হোসেন জিল্লুর রহমান, বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান। ছিলেন ২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা। এছাড়া তিনি বিশ্বের বৃহত্তম এনজিও ব্র্যাকের চেয়ারপারসন। দায়িত্ব গ্রহণের ১০০ দিন পেরিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম ও দক্ষতা-যোগ্যতা মূল্যায়ন, তাদের করণীয়, অভ্যুত্থান-পরবর্তী পরিস্থিতিসহ নানা ইস্যুতে কথা বলেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম। আজ শেষ পর্ব

(গতকালের পর)

আপনি শক্তিশালী সিভিল সোসাইটির কথা বলছেন, সেটা কীভাবে গড়ে উঠবে?

শক্তিশালী সিভিল সোসাইটি গড়ে ওঠে মূলত দু’ভাবে। এটি গড়ে ওঠার পরিবেশগুলো রাষ্ট্রের তরফ থেকে নিশ্চিত করা দরকার। আপনি যদি এমন কোনো আইন করে রাখেন যে আমি ফেসবুকে একটা পোস্ট দিলাম তার পরদিনই আমাকে জেলে যেতে হবে। তাহলে আমি কীভাবে সমালোচনা করব। এখন সেগুলো বাদ হচ্ছে কিন্তু পুরোপুরি বাদ হচ্ছে কিনা সেটা দেখার বিষয়। নাগরিক কণ্ঠস্বরের আরেকটা মাধ্যম হলো গণমাধ্যমের জগৎটা। এটা অত্যন্ত জরুরি কারণ আমরা সবাই সমাজ নির্মাণে ও একে অন্যের জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার দায়িত্বে আছি এববং আমরা বিভেদ নয়, ঐক্যের মনোভাব নিয়ে কাজ করতে যে আগ্রহী—এটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ।

শোনার সংস্কৃতি খুব জরুরি হলেও আমাদের এখানে বলার সংস্কৃতি খুব জোরালো। যথারীতি এক্ষেত্রেও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যেও শোনার সংস্কৃতি দেখতে পাচ্ছি না। সরকারের তো প্রতি মুহূর্তে বলার সুযোগ আছে। মানুষ থেকে শোনার প্রয়োজন আছে এবং সেটা আমলাতান্ত্রিকভাবে দুজনকে দুই মিনিট সময় দেয়ার মতো করে নয়। হৃদয় থেকে মন খুলে কথা বলা জরুরি।

আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ক্ষমতার চর্চা কীভাবে হচ্ছে, রাষ্ট্র পরিচালনার ধারণাগুলো কীভাবে যারা ক্ষমতায় আছেন তাদের কর্মকাণ্ডে দৃশ্যমান হচ্ছে। এই মুহূর্তে রাষ্ট্র কীভাবে চলছে বা চলা উচিত কিংবা কীভাবে চালানো যায় সেটা নিয়ে ধারণাগত এবং জ্ঞানগত ঘাটতি ব্যাপক। অনেকেই এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসেছেন। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি রাষ্ট্র কীভাবে চলে সেটি অনেকেই ঠিকমতো বুঝতে পারছেন না এবং যার ফলে আমলানির্ভরতা একটা অবধারিত ফল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ বিষয়গুলো এই মুহূর্তে বলাটা খুব জরুরি।

জনগণের প্রত্যাশিত নির্বাচন আয়োজনে সরকারের কী কী পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন?

একটা বিশৃঙ্খলা অবস্থায় আমাদের নির্বাচনে যাওয়াটা সঠিক হবে না। বিভেদগুলো চারদিকে ছাড়িয়ে আছে, প্রশাসন কাজ করছে না। কাগজে-কলমে সব ঠিক করা হলো কিন্তু কাঠামোটা দুর্বল হলে চলবে না। নির্বাচনের দিকে যেতে প্রথম কাজ হবে রাষ্ট্র এবং সামাজিক স্থিতিশীলতার আবহ তৈরি করা। গত তিন মাসে এক্ষেত্রে উদ্যোগের ব্যাপক ঘাটতি দেখতে পাচ্ছি। যখনই নির্বাচন হোক না কেন স্থিতিশীল একটা সমাজ এবং নাগরিক প্রেক্ষিত খুবই জরুরি। মানুষ যদি মনে করে ভোট কেন্দ্রে গেলে আমার সমস্যা হবে, যদি আস্থা না পায় তাহলে আপনি যতই ভোটের সুযোগ তৈরি করে দেন না কেন কাজ করবে না। সুতরাং প্রথম পদক্ষেপ হবে স্থিতিশীল আবহ তৈরি করা।

আরেকটা বিষয় হলো, মানুষ এ মুহূর্তের সমস্যার সমাধান চাচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও অর্থনীতির চাকাটা ঘুরানো এখন জরুরি। সুতরাং নির্বাচনের দিকে এগোতেও এই পূর্বশর্ত পূরণ করা প্রয়োজন। প্রথমত, মানুষের যে দৈনন্দিন চাহিদা আছে সেগুলো পূরণের দৃশ্যমান ও সক্ষম প্রচেষ্টা দরকার। দ্বিতীয়ত, প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার আবশ্যক। অনেকগুলো সংস্কার কমিশন হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এটা কেতাবি জায়গায় চলে যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সংস্কারের প্রথম শর্ত হচ্ছে স্থিতিশীলতা ও দৈনন্দিন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলার একটা বাস্তবসম্মত পরিবেশ তৈরি। বিশৃঙ্খল অবস্থায় নির্বাচন বিশৃঙ্খল পরিণতির দিকে নিয়ে যাবে।

নির্বাচনে যাওয়ার পথে কোন কোন ধাপগুলো পার হতে হবে?

নির্বাচনে হাঁটার তিনটি স্তর রয়েছে। প্রথমত, প্রাত্যহিক অবস্থাকে স্থিতিশীল করতে হবে, বিশৃঙ্খল অবস্থায় নির্বাচনে যাওয়া যাবে না। জনগণের দৈনন্দিন চাহিদা কার্যকরের জায়গাগুলো নিশ্চিত করতে হবে। কারণ আপনি একটা শৃঙ্খলিত অবস্থায় নির্বাচনে যেতে চান। দ্বিতীয়ত, এই যে সংস্কার এবং সংস্কারের জায়গাগুলো রয়েছে, এগুলো নিয়ে কোনো ধরনের লুকোচুরি বা কোনো ধরনের বিভ্রান্তির সুযোগ নেই এটা নিশ্চিত করতে হবে। সংস্কারের প্রয়োজন সবাই বুঝেছে কিন্তু এটা দৃশ্যমান হওয়া দরকার। কিছু সংস্কার স্বল্পমেয়াদি, কিছু মধ্য ও কিছু দীর্ঘমেয়াদি। কিছু সংস্কার প্রশাসনিক ক্ষমতাবলে করে ফেলা যায়, কিছু ঐক্যের মাধ্যমে করতে হবে এবং সেটা হয়তো এ সরকারের মেয়াদে নাও হতে পারে, পরবর্তী সময়ে হতে পারে। তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলোর মতামতের ভিত্তিতে একটা নির্বাচনের দিন-তারিখ ঠিক করা দরকার। এখানে আমি নাগরিক সমাজের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখছি। কারণ রাষ্ট্র এক ধরনের দায়িত্বের পরিধির মধ্যে এগুলো সম্পাদন করবে।

বাড়তি চাহিদাগুলো, যেমন আমরা রাজনীতিতে কী চাই সেই চিন্তার রূপরেখাগুলো নাগরিক সমাজের মধ্যে আছে। আমি মনে করি এ সময় রাষ্ট্র যেমন সক্রিয়, তেমনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, রাজনৈতিক দল, নাগরিক সমাজেরও এখন আরো দ্বিগুণ সক্রিয় হওয়া দরকার। আমি নাগরিক সমাজকে আহ্বান জানাব আমরা সবাই মিলে সুনিশ্চিতভাবে আরো দ্বিগুণ সক্রিয় হব। অন্তর্বর্তী সরকার কমিশন গঠন করেছে, কমিশনের কার্যক্রম চলতে থাকুক। আমার আশঙ্কা, সেটা যেন কেতাবি জিনিসে পরিণত না হয়। সেদিকে খেয়াল রাখা জরুরি।

আমরা দেখেছি যে রাজনৈতিক দলগুলো তাদের কার্যক্রম গুছাচ্ছে। এ দলগুলোর যারা প্রতিযোগী হবেন তাদের গ্রহণযোগ্যতা, নেতৃত্ব তারা নিজেরা তৈরি করতে থাকুক। তবে এখানে আমাদের সজাগ থাকা লাগবে যে ফ্যাসিস্ট চিন্তার সমর্থক বা যারা ফ্যাসিজম ধারণ করে বা রাজনীতির বিষয়টিকে ফ্যাসিস্ট দৃষ্টিকোণ ও মানসিকতা থেকে দেখেন তাদের এ ব্যাপারে আমাদের সজাগ থাকতে হবে। তাদের অংশগ্রহণ নিয়ে আমাদের সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে আলোচনা হওয়া দরকার এবং সুস্পষ্ট নিয়মাবলির মাধ্যমে এগুলোকে কাঠামোবদ্ধ করা দরকার। আর আমাদের যে তারুণ্যের শক্তি রয়েছে, এটাকে একটা রাজনৈতিক শক্তিতে রূপান্তর করা দরকার। রাজনীতিতে তারুণ্যের শক্তিটাও সম্পৃক্ত হওয়া প্রয়োজন। তারা এক বা একাধিক প্রতিষ্ঠিত দলের মধ্যে ঢুকতে পারে বা তারা বিভিন্ন দল তৈরি করতে পারে। তারা দল তৈরি না করেও বিভিন্ন সামাজিক প্রেশার গ্রুপ তৈরি করতে পারে। তাদের কাছে নানা পথ আছে। তারুণ্যের শক্তিকে কার্যকরভাবে একটা সামাজিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা যেতে পারে যেটা রাজনীতির শুভ দিকনির্দেশনার জন্য একটা শক্তি হিসেবে কাজ করবে। এটিও একটা কাজের জায়গা, এখানেও মনোযোগ দেয়া দরকার।

তরুণদের মাঝে নানা দলে মিশে যাওয়া কিংবা এক বা একাধিক নতুন দল গঠনের আভাস ইদানীং পাওয়া যাচ্ছে। তাদের রাজনৈতিক সম্ভাবনা কেমন দেখছেন?

আগস্টের পরিবর্তন আনতে তারুণ্যের একটা গ্রুপ খুব সক্রিয় ছিল এবং তারা এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আছে। কিন্তু ওই পরিবর্তন আনার কৃতিত্বের যে পুঁজি তাকে রাজনৈতিক পুঁজি বানিয়ে দল হলেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে এমন নয়। কারণ দল হলেও তাদের সমাজের মধ্যে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করতে হবে। জবাবদিহিতার সামনে দাঁড়াতে হবে। তারা যদি দল গঠন করতে চায় তাহলে আমি সাধুবাদ জানাব। কিন্তু চাওয়াটা শুধু চাওয়া হলে হবে না। সমাজ গ্রহণ করবে কিনা তা ভাবতে হবে। তাদের এই পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে এবং এই পরীক্ষা কেবল এককালীন পরীক্ষা নয়। তারা কীভাবে দল সাজাচ্ছে, নেতৃত্বের সোপানগুলো তৈরি করছে বা কী ধরনের সেবামূলক মানসিকতা ধারণ করছে তার ওপর নির্ভর করবে। নাকি তারাও পুরনো কলুষিত রাজনীতির বৃত্তে ঢুকে যাবে সেদিকে সবার দৃষ্টি থাকবে।

আমাদের পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভারতে আছেন এবং তিনি বেশ কয়েকটি অডিও ছেড়েছেন। এটা বাংলাদেশের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করছে বলা হচ্ছে। বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে আমাদের নতুন সম্পর্কের সমীকরণটা কেমন হবে?

বৃহৎ প্রতিবেশী শব্দটা আমার কাছে খুব একটা পছন্দের শব্দ নয়। ছোট হোক বড় হোক সব প্রতিবেশীকে আমাদের সম্মান জানাতে হবে। বৃহৎ প্রতিবেশী বলে একটা আলাদা সম্মানের জায়গা নেয়ার কোনো সুযোগ নাই। কৌশলগতভাবে বৃহৎ অর্থনীতির সঙ্গে কীভাবে মোকাবেলা করব সেটা বিবেচ্য বিষয়। কিন্তু বৃহৎ প্রতিবেশী বলে কিছু নেই আমার দৃষ্টিতে। প্রতিবেশী শুধুই প্রতিবেশী সেটা ছোট হোক বড় হোক। হোক সেটা মালদ্বীপ, ভুটান কিংবা ভারত; আকার খুব একটা বিবেচ্য নয়। সবাইকে আমি প্রতিবেশীর মর্যাদার আসনে বসাতে চাই। এরপর আছে ভূরাজনৈতিক ক্যালকুলেশন। আমি মনে করি, গত পনেরো বছরে গুরুতর ভুল করেছে ভারত। একটা দেশের সঙ্গে এবং ওই দেশের নাগরিকের সঙ্গে সম্পর্ক না করে খুব ক্ষুদ্র, লোভী, ক্ষমতায় আসক্ত আর দুর্নীতিবাজ একটা গ্রুপের সঙ্গেই লেনদেনে অভ্যস্ত হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত এতদিন এক ধরনের মাতুব্বরি বা খবরদারি করছিল, এখন সে জায়গায় তারা নেই। সুতরাং তারা হয়তো এক ধরনের আহতবোধ করছে; সে আহতবোধের প্রতি আমাদের কোনো সহানুভূতি নেই। কিন্তু আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের প্রতি সবসময় শ্রদ্ধাশীল থাকব। সব প্রতিবেশীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকা এবং সুসম্পর্ক বজায় রাখা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির অন্যতম স্তম্ভ। আমাদের রাষ্ট্রীয় বা দেশীয় স্বার্থকে সমুন্নত রেখে সব প্রতিবেশীর সঙ্গে সুসম্পর্কগুলো গড়তে হবে। একতরফা সুসম্পর্কের দিন নেই। একতরফা সুসম্পর্ক গ্রহণযোগ্য নয়।

শেখ হাসিনা যদি ভারতে বসে অপতৎপরতা চালাতে থাকে তা মোকাবেলা হবে ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ। পতিত স্বৈরাচারের ব্যাপারে নাগরিকদের মধ্যে বৃহত্তর ঐক্য রয়েছে, রাষ্ট্রের সিদ্ধান্তে তার প্রতিফলন হচ্ছে না। ভারতে বসে শেখ হাসিনা যদি বিশৃঙ্খলা তৈরির চেষ্টা চালান তা জোরালোভাবে প্রতিহত করতে হবে। নয়াদিল্লির সঙ্গে আলোচনায় বসতে হবে এবং তাদেরকে এ বার্তা দিতে হবে, ঢাকার কাছে এ আচরণ গ্রহণযোগ্য না। আশ্রয় দিয়েছে ঠিক আছে কিন্তু সেখানে বসে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কোনো ষড়যন্ত্রে যেন ভারত সহযোগিতা না করে।

আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ কী? সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো আওয়ামী লীগকে কীভাবে মোকাবেলা করবে?

আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ তার আরো কিছু অঙ্গসংগঠনের সন্ত্রাসী ভূমিকা দেখেছি। এটা লুকোচুরির বিষয় নয়, দৃশ্যমান। জনগণের কাছে তাদের হত্যাযজ্ঞের ছবি, ভিডিও সবই আছে। গত ১৫ বছরে একটা ক্ষুদ্র ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তৈরি হয়েছে যারা রাজনীতির অনেক কিছুকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছে। তাদের নিজ দলের মধ্যেও অনেকেই শোষিত হয়েছে, যোগ্য অনেককেই সুযোগ দেয়া হয়নি। তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের অনেক কিছু ব্যবহার করেছে। যেমন ধরুন বিএনপি-জামাত ট্যাগ দিয়ে তাদের ওপর নিপীড়ন ও সম্পদ হাতিয়ে নেয়ার মতো কাজ করেছে। আওয়ামী লীগের এই দুর্নীতিগ্রস্ত ক্ষমতাভোগকারী গোষ্ঠী অংশটা এখনো দেশে বিশৃঙ্খল অবস্থা তৈরি করতে চায়, তাদের ব্যাপারে সম্পূর্ণ সজাগ থাকতে হবে। শুধু সজাগ নয়, সঠিক ও শক্তিশালী পদক্ষেপ নেয়াটা জরুরি। রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের অনেক জায়গায় হয়তো তাদের লোকজন আছে। তারা যদি বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে চায় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া লাগবে। রাজনীতির ময়দানে ফিরতে হলে অনুশোচনা ও আত্মশুদ্ধির অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমেই জনগণের কাছে যেতে হবে।

যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলো। সেখানে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় বাংলাদেশের জন্য কোনো ভাবনার বিষয় হতে পারে?

আমাদের নিজস্ব ভূরাজনৈতিক কৌশল থাকলে মার্কিন নির্বাচন নিয়ে ভাবনার কিছু ছিল না। দুঃখজনকভাবে আমাদের দেশের সোশ্যাল মিডিয়া বা বিভিন্ন প্লাটফর্মে কিছুটা অপরিপক্ব আলোচনা হচ্ছে বা প্রচার পাচ্ছে। মূল কথা, বাংলাদেশ রাষ্ট্র ও সমাজের ওপর দাঁড়িয়ে আমরা সবকিছু করব। বাংলাদেশের উন্নতির জন্য যা যা করা দরকার, যে যে দেশের সঙ্গে সম্পর্ক দরকার আমরা সম্পর্ক স্থাপন করব। বাংলাদেশের সমৃদ্ধি ও সংহতি এক্ষেত্রে একমাত্র মাপকাঠি। এ লক্ষ্য সামনে রেখেই দক্ষতার সঙ্গে ভূরাজনৈতিক কৌশলগুলো নির্ধারণ করতে হবে। আমি মনে করি না, ট্রাম্প প্রশাসন বাংলাদেশকে নিয়ে ভিন্নতর কোনো অবস্থান নেবে কিংবা ভারত আগ্রাসী কোনো পদক্ষেপ নেবে। ভারতের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে একটা গোষ্ঠী হয়তো এতদিন একটা জায়গায় ইনভেস্ট করেছিল এখন সেটা ব্যাহত হয়েছে। তারা আঘাত পেয়েছে। আমি মনে করি, ভারত একটা পরিপক্ব রাষ্ট্র। তারা বিষয়টা কৌশলগত জায়গা থেকে দেখবে। দেখবে ভারতের গণমাধ্যমেও বাংলাদেশ নিয়ে একমাত্রিক আলোচনা নাই। যদিও ডমিনেন্ট ন্যারেটিভ এখনো বাংলাদেশের প্রতি বৈরী মনোভাবেরই।

ভূরাজনীতিতে বয়ানের গুরুত্ব কী?

ভূরাজনৈতিক দক্ষতার বিষয়টিতে এর কৌশলের দুটি দিক আছে। একটা হলো, আপনার ভূরাজনৈতিক বয়ানটাকে কীভাবে তৈরি করছেন। আরেকটা হলো, পররাষ্ট্রনীতিটাকে কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে। বয়ান তৈরির কাজটা যদি চারদিকে শত্রু খুঁজে বেড়ানোর মতো হয় তবে বয়ানটা দুর্বল হয়ে যাবে। এখানে যেমন সংখ্যালঘুদের একটা বিষয় আছে। সংখ্যালঘু আওয়ামী লীগের সময়ও প্রচুর প্রতারিত, শোষিত হয়েছে। সংখ্যালঘু বিষয়টা আমাদের সাংবিধানিকভাবে দেখতে হবে। সংখ্যালঘু শব্দটাইবা এখন কতটুকু প্রযোজ্য। সবাই তো দেশের নাগরিক। যেখানে যে পরিচয় আসুক না কেন নাগরিক মর্যাদা দিয়েই দেশটা গড়তে হবে। আমি যেটা মনে করি, আমাদের একটা মর্যাদাশীল রাষ্ট্র, আন্তর্জাতিক পরিসরে সক্ষম এবং নিজের দেশের মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে। আমরা সেদিকে এগুচ্ছিও। ভারত রফতানিতে কিছুটা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করায় আমরা মালদ্বীপকে বেছে নিয়েছি। এরকম সিদ্ধান্ত নেয়ার অধিকার সব স্বাধীন রাষ্ট্রের রয়েছে। এটা কোনো বৈরিতা নয়। এটা কেবল নীতিগত পরিবর্তন। দেখুন, চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কত বৈরিতা! তার পরও কত বড় অর্থনৈতিক সম্পর্ক।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার এবং একে অন্যের ওপর নির্ভরশীল। আমরা এতদিন স্বার্থের ভিত্তিতে পলিসি নিতে পারিনি কেন?

শুধু চীন-যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ভারত-চীনের মধ্যে সম্পর্ক দেখতে পারেন। বৈদেশিক বাণিজ্য একে অন্যের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। আমরা আমাদের রাষ্ট্রের স্বার্থটা নানাভাবে চরিতার্থ করার চেষ্টা করব, এটাই স্বাভাবিক। এখানে মূল বিষয় আমি দক্ষ কিনা। দক্ষতার সঙ্গে আমি আমার অবস্থানটা বা আমার সুযোগগুলো তৈরি করতে পারছি কিনা বিষয়টা এভাবে দেখা দরকার। আমাদের এখানে একমাত্রিক হাইপার (উত্তেজক) কোনো বয়ান তৈরি করা উচিত নয়। আর বিগত ১৫ বছর আমরা আমাদের স্বার্থ সামনে না এনে ‘বৃহৎ’ প্রতিবেশীর মন জোগানোর দিকেই নজর দিয়েছি। এ ধরনের নতজানু ও হীনম্মন্য মানসিকতা লাল জুলাইয়ের স্পিরিটের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজের সার্বিক সক্ষমতা বাড়ানোর পথ ধরে বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে তার যোগ্য স্থান তৈরিতে সচেষ্ট হতে হবে।

আরও