আশির দশকের গোড়ার দিকে দেশে পোশাক শিল্পের যাত্রা শুরু। নব্বই দশকের শুরুতেই এ শিল্প দেশের শীর্ষ রফতানি খাত হয়ে ওঠে। এরপর থেকে ধারাবাহিকভাবে পোশাক রফতানি বেড়েছে। বর্তমানে রফতানি আয়ের ৮০ শতাংশই আসে এ খাত থেকে। পোশাক রফতানিতে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে দ্বিতীয়। দেশের সবচেয়ে বেশি মানুষের কর্মসংস্থানও এ খাতে। এত সাফল্যগাথার বিপরীতে দুঃখজনক হলো, পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সামঞ্জস্য হারে বাড়েনি। বরং প্রায় প্রতিবারই মজুরি বৃদ্ধির জন্য এ শ্রমিকদের করতে হয়েছে আন্দোলন-সংগ্রাম।
পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি ও পোশাক রফতানির প্রবৃদ্ধির মধ্যে তুলনা করলে প্রতীয়মান হয় যে রফতানির অনুপাতে মজুরির হার কতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যানুযায়ী, ১৯৯৪ সালে তৈরি পোশাকের রপ্তানি ছিল ১৮৮ কোটি ডলারের। ২০২২ সালে রফতানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ হাজার ৫৭০ কোটি ডলারে। এ হিসাবে গত ২৮ বছরে তৈরি পোশাকের রফতানি বেড়েছে ২৪ গুণ। যেখানে পোশাক শ্রমিকদের নিম্নতম মজুরি বেড়েছে ১৩ গুণ। গত বছর পোশাক শ্রমিকদের মজুরি পরিস্থিতি নিয়ে ‘গার্মেন্ট খাতে ন্যূনতম মজুরি পুনর্নির্ধারণ: পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাবনা’ শীর্ষক একটি সংলাপের আয়োজন করে সিপিডি ও বেসরকারি সংস্থা ক্রিশ্চিয়ান এইড। সেখানে উল্লেখ করা হয়, বিশ্বের শীর্ষ পোশাক রফতানিকারক দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম মজুরি পান এ দেশের শ্রমিকরা। আর সবচেয়ে বেশি মজুরি চীনে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাও (ডব্লিউটিও) একই মত প্রকাশ করেছে গত বছর। ভারত, কম্বোডিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানের পোশাক শ্রমিকরা বাংলাদেশের চেয়ে বেশি মজুরি পান। উপরন্তু স্বল্প মজুরির বিপরীতে তাদের ব্যাপক শ্রম দিতে হয়। অনেক সময় অক্লান্ত পরিশ্রমের পরও সেই মজুরি সময়মতো মেলে না। বকেয়া মজুরি পেতেও তাই আন্দোলনে নামতে দেখা যায় শ্রমিকদের। সব মিলিয়ে জীবন পরিচালনায় হিমশিম খেতে হয় দেশের সর্ববৃহৎ রফতানি খাতের শ্রমিকদের। একাধিক সরকারি প্রতিষ্ঠানের জীবনযাত্রার ব্যয় সূচকে তৈরি পোশাকের ন্যূনতম মজুরি সাড়ে ১২ হাজার টাকায় জীবন চালানো সম্ভব নয় বলে উল্লেখ করা হয়। এখানে উল্লেখ্য যে ২০২৩ সালে ঘোষিত সর্বশেষ নিম্নতম মজুরির ক্ষেত্রে শ্রমিক পক্ষের প্রস্তাব ছিল ২০ হাজার ৩৯৩ টাকা আর মালিক পক্ষের প্রস্তাব ছিল ১০ হাজার ৪০০ টাকা। মালিকদের প্রস্তাবে শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়ে আন্দোলনে নামলে চার পোশাক শ্রমিক মারা যান। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে মালিক পক্ষ নতুন করে সাড়ে ১২ হাজার টাকা মজুরির প্রস্তাব দিলে পরে সেটিই চূড়ান্ত হয়।
এ মজুরি নিয়েও বিদ্যমান শ্রমিক অসন্তোষের জের ধরে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের পর বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের মতো পোশাক শ্রমিকরাও আন্দোলন শুরু করেন, যা এখনো চলমান। বর্তমান উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও শ্রমিকদের জীবন যাপন মান বিবেচনায় মজুরি বাড়ানো উচিত। এ খাতের শ্রমিকদের যে মজুরি দেয়া হয়, তা শোভন জীবনযাপনের জন্য যথেষ্ট নয়। বরং উচ্চ মূল্যস্ফীতি শ্রমিকদের ক্রয়ক্ষমতা কমিয়েছে। গত বছর যে মজুরি বৃদ্ধি ৫৬ শতাংশ বলে দেখানো হয়েছিল, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) বলছে, বার্ষিক ৫ শতাংশ বেতন বৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিনিময় মূল্যের ঊর্ধ্বগতি বিবেচনায় পোশাক শ্রমিকদের মজুরি সে সময় প্রকৃত অর্থে ৩০ শতাংশও বাড়েনি। প্রায় ১০ শতাংশ মূল্যস্ফীতিতে ৫ শতাংশ বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি শ্রমিকের আর্থিক নিরাপত্তা দিতে পারবে বলে প্রতীয়মান হয় না। মালিক পক্ষের উচিত শ্রমিক অসন্তোষ দূর করার পদক্ষেপ নেয়া। তাদের জীবন মান উন্নয়নে পর্যাপ্ত মজুরি বাড়ানো।
তবে চলমান আন্দোলন কেবল মজুরি বৃদ্ধিকে কেন্দ্র করে নয়। শ্রমিকরা কিছু সুযোগ-সুবিধা চাচ্ছেন যা তাদের জীবনমান উন্নত করতে সহায়ক হতে পারে। তাদের দাবিগুলোর মধ্যে বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধির দাবি করা হয়েছে ১৫ শতাংশ, যা বর্তমানে আছে ৫ শতাংশ। এছাড়া প্রভিডেন্ট ফান্ড চালু, ১৫ দিন পিতৃত্বকালীন ছুটি, টিফিন বিল ৩৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ টাকা, হাজিরা বোনাস বৃদ্ধি, মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়িয়ে ছয় মাস করা, একবার বিনামূল্যে আল্ট্রাসনোগ্রামের ব্যবস্থা করা, মেয়েদের স্যানিটারি ন্যাপকিন দেয়া, ডে কেয়ার সুবিধা বৃদ্ধি, মাসিককালীন দুইদিন ছুটি মঞ্জুর, চক্ষু পরীক্ষা ও সানগ্লাস প্রদান ইত্যাদি।
কিন্তু সব দাবি একই সঙ্গে পূরণ করা বাস্তবে সম্ভব নয়। এটিও শ্রমিকদের বিবেচনায় রাখতে হবে। আন্দোলন নিয়মতান্ত্রিক পর্যায়ে নিতে হবে। উৎপাদন সচল রাখতে হবে। এরই মধ্যে আন্দোলন ঘিরে বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় কল-কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। কোথাও আবার শ্রমিকরা কর্মবিরতি ঘোষণা করেন। উৎপাদন বন্ধ থাকলে তা দীর্ঘমেয়াদে ভালো ফল বয়ে আনবে না। বিশেষ করে ক্রয়াদেশের নিশ্চয়তার জন্য এ খাতে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একটি প্রতিনিধি দল তৈরি পোশাক পণ্য প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর সঙ্গে এক বৈঠকে পোশাক শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধির শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে দীর্ঘমেয়াদি ক্রয়াদেশের মৌখিক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। মালিকদের যেমন মজুরি বাড়ানো প্রয়োজন, তেমনি শ্রমিকদেরও কারখানা সচল রাখার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। অস্থিরতা দীর্ঘায়িত হলে পোশাক রফতানির অন্যতম গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে ক্রয়াদেশ বাতিলের আশঙ্কা রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের রফতানি বাজার হারালে পোশাক খাতের রফতানি নিম্নমুখী হওয়ার শঙ্কা রয়েছে। এতে ধস নামতে পারে রফতানি আয়ে, যার প্রভাব পড়বে মোট রিজার্ভে। কিন্তু সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এ খাতে যাদের কর্মসংস্থান তথা শ্রমিকরা।
বর্তমানে একাধিক কারখানার শ্রমিকদের দুর্দশার অন্যতম কারণ সরকার পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে মালিক পক্ষ আত্মগোপনে চলে গেছে। রাতারাতি এসব কারখানার সমস্যা সমাধান সম্ভব নয়। এর জন্য সময় প্রয়োজন। সরকারের এদিকে মনোযোগী হতে হবে। আন্দোলনকারী ও মালিকদের কীভাবে সমঝোতায় আনা যায় তার মধ্যপন্থা বের করে এ খাতকে রক্ষা করতে হবে।