সময়ের ভাবনা

করোনায় কোরবানির অর্থনীতি

করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় সংক্রমণ ও মৃত্যু উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার নিয়ে অনিশ্চয়তা। স্বাভাবিক কাজকর্ম বিঘ্নিত হওয়ায় দারিদ্র্য বাড়ছে, বাড়ছে কাজের অনিশ্চয়তা। গরিব, নিম্নবিত্ত আর নিম্ন-মধ্যবিত্তের আয় কমছে। শুধু অনেকটা ব্যাংকনির্ভর প্রণোদনা আর কিঞ্চিৎ এককালীন সহায়তা দিয়ে অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য আনা যাচ্ছে না।

করোনার দ্বিতীয় ধাক্কায় সংক্রমণ মৃত্যু উভয়ই বৃদ্ধি পেয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে অর্থনীতির পুনরুদ্ধার নিয়ে অনিশ্চয়তা। স্বাভাবিক কাজকর্ম বিঘ্নিত হওয়ায় দারিদ্র্য বাড়ছে, বাড়ছে কাজের অনিশ্চয়তা। গরিব, নিম্নবিত্ত আর নিম্ন-মধ্যবিত্তের আয় কমছে। শুধু অনেকটা ব্যাংকনির্ভর প্রণোদনা আর কিঞ্চিৎ এককালীন সহায়তা দিয়ে অর্থনীতিতে চাঞ্চল্য আনা যাচ্ছে না।

উৎসবকেন্দ্রিক বাংলাদেশে রোজার ঈদ আর কোরবানির ঈদ এমনিতেই অর্থনীতিতে তারল্য বৃদ্ধিতে বিরাট সহায়তা করে। করোনাকালে অর্থনৈতিক শৈথিল্যকালে এটি বরং আরো বেশি কাজ করার কথা। তবে করোনা পরিস্থিতিতে চলমান লকডাউনে কোরবানির পশুর বাজার নিয়ে শঙ্কা স্বস্তি দুটিই রয়েছে। স্বস্তি হলো গত বছরের মতো অস্থিতিশীল পরিস্থিতি কিছুটা হলেও কমেছে। পর্যাপ্ত গরু-মহিষ যেমন রয়েছে, তেমন হাটও হচ্ছে দেশব্যাপী। মানুষের ক্রয়ক্ষমতাও গত বছরের তুলনায় কিছুটা হলেও ভালো। তবে শঙ্কাও রয়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চলসহ বিভিন্ন অঞ্চলের করোনা পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাওয়ায় দেশব্যাপী কঠোর বিধি-নিষেধ ছিল। তবে সরকার সবার কথা চিন্তা করে কিছু দিনের জন্য বিধি-নিষেধ শিথিল করেছে। পরিস্থিতিতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে গরু-মহিষ আনা-নেয়া করতে পারবে কিনা, হাটে আনলে সঠিক দামে বিক্রি হবে কিনাএমন নানা ধরনের শঙ্কার কথা বলছেন প্রান্তিক চাষী খামারিরা।

ফলে গরু-মহিষসহ কোরবানির পশু, পশুর চামড়া, পরিবহন ব্যবস্থাসহ দেশের ৭৫ হাজার কোটি টাকার ওপর কোরবানির বাজার কোন দিকে যাচ্ছে তা নিয়ে কিছুটা অস্পষ্টতা রয়েছে। তবে খামার মালিক, ব্যবসায়ী সংশ্লিষ্টরা আশার কথাই বলছেন। তাদের মতে, সরকারের পক্ষ থেকে হাটে স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কিছু পদক্ষেপ নিলেও পশু আনা-নেয়ার ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখলে গতবারের তুলনায় বাজার অনেক ভালো হবে। হাটে পর্যাপ্ত গরু থাকবে, ক্রেতারাও সুবিধামতো কিনতে পারবেন। এতে কোরবানিকে ঘিরে বিপর্যস্ত অর্থনীতির গতি অনেকটাই ফিরে আসবে। এরই মধ্যে অনলাইন খামারগুলোতে কোরবানির পশু বিক্রি জমে উঠেছে। খামার পর্যায়ে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ গরু বিক্রি হয়ে গেছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। সম্প্রতি গণমাধ্যমের সঙ্গে মতবিনিময়ে পুলিশ প্রধানও একই কথা বলেছেন।

প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের হিসাবে দেশে কোরবানির জন্য গরু-মহিষ ছাগল-ভেড়াসহ পশুর চাহিদা রয়েছে ৯৫ লাখ থেকে কোটি ১০ লাখ। চলতি বছর দেশে কোরবানির যোগ্য পশু রয়েছে কোটি ১৯ লাখ ১৬ হাজার। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় নয় লাখের বেশি পশু উদ্বৃত্ত রয়েছে।

কোরবানির যোগ্য এসব পশুর বাজারমূল্য ৫৪ হাজার কোটি টাকার ওপরে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের হিসাবে মোট পশুর মধ্যে ৪৫ লাখ ৪৭ হাজার রয়েছে গরু-মহিষ। বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে এসব গরু-মহিষের মধ্যে ৮৫ শতাংশই ৬০ হাজার থেকে লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যের ছোট গরু। দেশের মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনুসারে এসব গরু-মহিষের চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। সে হিসেবে ছোট গরুর বাজারমূল্য গড়ে ৯০ হাজার টাকা হিসাবে ৩৪ হাজার ৭৮৪ কোটি টাকা। বাকি বড় গরু-মহিষের বাজারমূল্য গড়ে লাখ টাকা বলছেন অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য নেতৃস্থানীয় খামারিরা। সে হিসেবে এসব গরু-মহিষের বাজারমূল্য দাঁড়ায় ১৩ হাজার ৬৪১ কোটি টাকা।

প্রাণিসম্পদ বিভাগের হিসাবে দেশে চলতি বছর কোরবানির যোগ্য ছাগল-ভেড়া রয়েছে ৭৩ লাখ ৬৫ হাজার। বাজারদর অনুসারে ছাগল-ভেড়ার গড় বাজারমূল্য হাজার টাকা। সে হিসেবে দেশে কোরবানির যোগ্য ছাগল-ভেড়ার মোট বাজারমূল্য হাজার ১৫৫ কোটি টাকা।

এছাড়া উট-দুম্বাও রয়েছে হাজার ৭৬৫টি। গত বছর এসব উট-দুম্বা বিক্রি হয়েছে থেকে লাখ টাকায়। সে হিসেবে উট-দুম্বার মোট বাজারমূল্য ২৩৮ কোটি টাকা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।

এর বাইরে রয়েছে পরিবহন খাদ্যের খরচ। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে গরু-মহিষ আনতে প্রতিটি ট্রাকের ভাড়া দিতে হয় ১৫ থেকে ১৮ হাজার টাকা। এসব ট্রাকে ২০টি করে গরু-মহিষ আনা যায়। অর্থাৎ প্রতিটি গরু-মহিষের জন্য পরিবহন খরচ পড়ে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। সে হিসেবে কোরবানির পশু বেচা-বিক্রিকে ঘিরে পরিবহন খাতে লেনদেন হওয়ার কথা প্রায় ৩৫০ কোটি টাকা। এছাড়া গো-খাদ্যের বাজার রয়েছে দৈনিক ১১৩ কোটি টাকার। সব মিলিয়ে কোরবানির পশু বেচাকিনিতে লেনদেন হয় প্রায় ৫৪ হাজার ৩০০ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের মতে, সংখ্যা আরেকটু বেশি হবে এবার। গো-খাদ্যের উপকরণের আমদানি ব্যয় বেশি। ফলে গরু মোটাতাজাকরণে চাষীদের খরচও বেড়েছে। গত বছরের তুলনায় সার্বিকভাবে ১০ শতাংশ বেশি দামে গরু বিক্রি করতে হবে।

তাদের মতে, গরু আনা-নেয়া যদি নির্বিঘ্ন হয়, রাস্তায় চাঁদাবাজি জোর করে পাইকারদের গরু পথে আটকে রাখা না হয়, তবে কোরবানির পশুর বাজার খুবই ভালো হবে। এসব সমস্যা বছরের পর বছর ধরে চলছে। প্রতি বছর কোরবানির সময়গুলোতে গরু ব্যবসায়ীরা রাতে ঘুমাতে পারেন না। রাত জেগে এসব সমস্যার সমাধান করতে হয় প্রশাসনের সঙ্গে দেনদরবার করে। তাই কোরবানির হাটের সময়গুলোতে সরকারিভাবে একটি কন্ট্রোল রুম বা মনিটরিং সেল বেশ প্রয়োজন। যেখানে ফোন দিলে সমস্যার সমাধান হবে।

এরই মধ্যে অনলাইনে কোরবানি পশু কেনা-বেচাও জমে উঠেছে। পত্রিকান্তরে খবর বেরিয়েছে, জুলাই থেকে শুরু হলেও জুলাই থেকে বাজার জমে উঠেছে এবং প্রতিদিন অনলাইনে প্রায় ২৫ হাজার কোরবানির পশু বিক্রি হচ্ছে। এরই মধ্যে ১০ জুলাই পর্যন্ত এক লাখের বেশি পশু বিক্রি হয়ে গেছে, যার মূল্য ছিল আনুমানিক ৭৩৭ কোটি টাকা। অনলাইনে প্রায় লাখ ২১ হাজার পশু বিক্রির জন্য তোলা হয়, যা হাজার ২৭৭টি মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে বিক্রি হতে দেখা যায়।

অনেকেই বলছেন, করোনার কারণে বিপর্যস্ত অর্থনীতিতে এবার অনেকটাই গতি ফিরবে কোরবানিকে ঘিরে। কোরবানির অর্থনীতির মূল চালিকা পশু বেচাকেনা হলেও আরো কয়েকটি ক্ষেত্রে দেশে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বৃদ্ধি পায়। এর মধ্যে অন্যতম হলো চামড়া শিল্পের কর্মকাণ্ড। দেশে সারা বছরের কাঁচা চামড়ার চাহিদা পূরণ হয় মুসলমানদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে।

পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে অর্থনীতিতে চামড়ার ব্যাপক গুরুত্ব রয়েছে। ব্যবসায়ীদের মতে, প্রতি বছর দেশে দেড় কোটিরও বেশি পশুর চামড়া পাওয়া যায়। এর বড় অংশই আসে কোরবানির পশু থেকে। চামড়া ব্যবসায়ীরা বলছেন, খাতের মূল বাজার - হাজার কোটি টাকা। কিন্তু এর সঙ্গে জড়িত অন্যান্য বাজারসহ খাতে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হয়। এছাড়া ঈদুল আজহাকে কেন্দ্র করে মসলাজাতীয় পণ্যের ব্যবসায়ও ব্যাপক গতি আসে। কোরবানির বাজারে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয় এসব পণ্যের। কোরবানির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হলো কামার পণ্য। ছুরি, বঁটি, দা, চাপাতি, কুড়াল, রামদা ছাড়া কোরবানিই সম্ভব নয়। সঠিক কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বাজারতথ্য বলছে, কোরবানিতে পণ্যের বাজারও হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। লকডাউনের মধ্যে শত বাধা-নিষেধ সত্ত্বেও দেখা যাবে শ্রমজীবী-নিম্নবিত্তরা ঠিকই গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছেন তা- যাতায়াত খরচ এবার যোগ করলাম না। যোগ করলাম না বিত্তশালীদের গ্রামে গিয়ে দান-খয়রাতের ব্যাপারটিও। ঈদ ধামাকায় টেলিভিশন-ফ্রিজসহ ভোগ্যপণ্য কেনার কথাও বাদ রয়ে গেল।

২১ জুলাই দেশে ঈদুল আজহা উদযাপিত হবে। কিন্তু এরই মধ্যে জমে উঠেছে কোরবানির পশু বিক্রি। রাজধানীর আশপাশের খামারগুলোতে এরই মধ্যে ৭৫ থেকে ৮০ শতাংশ গরু বিক্রি শেষ বলে জানিয়েছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এছাড়া বেচাকেনা চলছে অনলাইন হাটেও। সরকার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে সুন্দর সমন্বয় সাধন সম্ভব হলে, ন্যূনতম স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং পশুর বাজারে হয়রানি-ঝামেলা বন্ধ করা গেলে এবারো কোরবানি ঈদকে কেন্দ্র করে অর্থনীতিকে চাঙ্গা করার একটি ভালো সুযোগ সৃষ্টি হবে বৈকি।

 

মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

আরও