অপুষ্টি একটি প্রধান জনস্বাস্থ্য সমস্যা, যা অর্থনীতিকেও প্রভাবিত করে। দেশে অপুষ্টিজনিত কৃশকায় শিশুর হার ২০১৭ সালে ছিল ৮ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০১৯ সালে তা বেড়ে ৯ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একইভাবে খর্বকায় শিশুর হার ওই বছর ছিল ২৮ শতাংশ। উচ্চতা অনুযায়ী তীব্রতম অপুষ্টিতে ভোগা শিশুর হার ২ শতাংশ।
মানবপুঁজিতে বর্ধিত বিনিয়োগ মানুষের মধ্যে উন্নত জ্ঞান ও দক্ষতার মাধ্যমে অর্থনৈতিক বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করে। সুস্থ নারী ও শিশুরা একটি সমৃদ্ধ সমাজের স্তম্ভ। অর্থনৈতিক উন্নয়নের কার্যকর কৌশল হিসেবে নারী ও শিশুদের মঙ্গলে বিনিয়োগের কথাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। আর এতেই তৈরি হবে ভবিষ্যতের মানবপুঁজি। অর্থনৈতিক উন্নয়নের গতি বাড়াতে মানবপুঁজির মান উন্নত করতে হবে।
মানবপুঁজি রাষ্ট্রের সম্পদ এবং মানুষের স্বাস্থ্য, পুষ্টি, দক্ষতা এবং জ্ঞানের ওপর নির্ভরশীল। হিউম্যান ক্যাপিটাল ইনডেক্স অনুসারে বাংলাদেশ ১৭৪টি দেশের মধ্যে ১২৩তম স্থানে রয়েছে এবং তার স্কোর শূন্য দশমিক ৪৬। আলোচ্য স্কোর এ ইঙ্গিত করে যে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী একটি শিশুকে সম্পূর্ণ শিক্ষা এবং সুস্বাস্থ্য প্রদান করলে সে ৪৬ শতাংশ উৎপাদনশীল হবে।
বিশ্বব্যাংক পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, মানসম্পন্ন শৈশব তৈরির কর্মসূচিগুলোয় বিনিয়োগ করা প্রতিটি অতিরিক্ত ডলার ৬ থেকে ১৭ মার্কিন ডলার মুনাফা প্রদান করে। শিশুদের মধ্যে প্রাথমিক উদ্দীপনা তাদের ভবিষ্যৎ আয়ের ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি করে বলেও বিভিন্ন গবেষণায় উঠে এসেছে। কিন্তু শৈশবে খর্বতা মস্তিষ্কের বিকাশ, কম জ্ঞানগত দক্ষতা এবং শিক্ষার দিকে পরিচালিত করে, যা ভবিষ্যতে কম আয়ের কারণ।
বাংলাদেশে এখনো ২ কোটি ১০ লাখ (১৩ শতাংশ) মানুষ পুষ্টিকর খাবার খেতে পায় না। এ হিসাবে প্রতি আটজনের একজন পুষ্টির অভাবে ভুগছে। খাবার যে নেই একেবারে তাও বলা যাবে না। মূলত অসচেতনতার কারণে অসংখ্য মানুষ খাবার খেয়েও প্রয়োজনীয় পুষ্টি পায় না। পুষ্টিকর খাবার খেতে না পেয়ে এখনো ৩৩ শতাংশ শিশুর শারীরিক বিকাশ ঠিকমতো হচ্ছে না। ফলে উচ্চতার তুলনায় কম ওজন এবং ওজনের তুলনায় উচ্চতা কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে বৃদ্ধি পাচ্ছে না।
বাংলাদেশের শিশুদের পুষ্টি পরিস্থিতির এমন তথ্য বাংলাদেশ সরকার ও বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) যৌথ সমীক্ষায় বলা হয়েছে। ১৯৯৭ সালে যেখানে দেশে ৬০ শতাংশ শিশু খর্বাকৃতির ছিল, ২০১৮ সালে তা কমে ৩১ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে খর্বাকৃতির শিশুর সংখ্যা এখনো বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে অনেক বেশি। একটি দেশের সুস্থ ভবিষ্যৎ প্রজন্ম গড়ে তোলার দিক থেকে এ সমস্যা একটি বড় বাধা। অন্যদিকে দেশে নারীদের পুষ্টি পরিস্থিতি এখনো বেশ উদ্বেগজনক অবস্থায় আছে। ১০-৪৯ বছর বয়সী প্রতি তিনজনের একজন নারী প্রয়োজনীয় পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার পায় না। দারিদ্র্য ও খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে এমন পরিবারগুলোকে বিভিন্ন সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় পুষ্টিকর খাবার পৌঁছে দেয়াও জরুরি।
‘দ্য স্টেট অব ফুড সিকিউরিটি অ্যান্ড নিউট্রিশন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড টু থাউজেন্ড নাইনটিন’ শীর্ষক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি ছয়জনের একজন অপুষ্টিতে ভুগছে। জাতীয় পুষ্টি পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, দেশে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের মধ্যে দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টি বা খর্বতায় ভুগছে ৩১ শতাংশ। ৮ শতাংশ ভুগছে তীব্র অপুষ্টিতে। বয়স অনুপাতে কম ওজন ২২ শতাংশ শিশুর। ২০২০ সালের জুলাইয়ে খাদ্য অধিকার বাংলাদেশ পরিচালিত ‘দরিদ্র মানুষের খাদ্য ও পুষ্টির ওপর কভিড-১৯-এর প্রভাব’ শীর্ষক জরিপে বলা হয়েছে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ৮৭ শতাংশই খাদ্য ও পুষ্টি সংকটে রয়েছে। ২০২০ সালে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৯ দশমিক ৯ শতাংশ (৮১ কোটি ১০ লাখ) মানুষ অপুষ্টিতে ভুগেছে বলে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, যা ২০১৯ সালের তুলনায় ৮ দশমিক ৪ শতাংশ বেশি। এদিকে জনস্বাস্থ্য পুষ্টি প্রতিষ্ঠানের রিপোর্ট বলছে, গড়ে একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ স্বাভাবিক মানুষের দিনে ২ হাজার ১০০ কিলো ক্যালরির প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় ক্যালরি পূরণ করেও যদি কোনো ব্যক্তির প্রয়োজনীয় পুষ্টির চাহিদা পূরণ না হয়, সেটিও পুষ্টিহীনতা।
ড. সিদ্দিক আর ওসমানীর এক গবেষণায় বলা হয়েছে, অপুষ্টির কারণে প্রতি বছর বাংলাদেশের জনগণের উৎপাদনশীলতা কমছে, যার আর্থিক ক্ষতি বছরে প্রায় ১০০ কোটি ডলারের বেশি। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের খাদ্যনিরাপত্তা এবং পুষ্টি নিয়ে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। সঠিক পুষ্টির অভাবে স্থূলতা ও শহুরে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তার অভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের মতে, ‘শৈশবের খর্বতার কারণে প্রাপ্তবয়স্কদের উচ্চতার ১ শতাংশ হ্রাস অর্থনৈতিক উৎপাদনশীলতার ১.৪ শতাংশ ক্ষতির সঙ্গে সম্পর্কিত’, যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। তথ্য অনুযায়ী, খর্ব শিশুরা প্রাপ্তবয়স্ক হিসেবে সুস্থ শিশুর তুলনায় ২০ শতাংশ কম উপার্জন করে।
আর একটি জটিল কারণ হলো প্রায় ৫৭ শতাংশ অল্প বয়সী নারীর মধ্যে রক্তস্বল্পতা বিদ্যমান, যা তাদের ভবিষ্যতের গর্ভধারণ এবং প্রসবের ওপর দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে। পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়, যখন শিশুদের অপ্রতুল খাবার খাওয়ানো হয় এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা এবং স্বাস্থ্যবিধিও থাকে অপ্রতুল।
গ্লোবাল নিউট্রিশন প্রতিবেদন অনুযায়ী, অপুষ্টি প্রতিরোধ করার জন্য প্রতি ১ মার্কিন ডলার খরচের বিনিয়োগে ১৬ মার্কিন ডলার উঠে আসে, যা পুষ্টিতে বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে। বাংলাদেশের বিভিন্ন পরিকল্পনায় বলা হয়েছে যে মাতৃত্বকালীন এবং জীবনের প্রাথমিক পর্যায়ের পুষ্টিতে বিনিয়োগ করার অন্তর্নিহিত কারণ থাকলেও পুষ্টিসংক্রান্ত কর্মসূচিগুলোয় বিনিয়োগে অত্যন্ত উচ্চমূল্য পাওয়া সম্ভব।
শিশুদের শিক্ষা মানবপুঁজি সংগ্রহ, উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। জন্ম ও পুষ্টির ফলাফলের উন্নতির জন্য গর্ভধারণ থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত এক হাজার দিনের সময়সীমাকে লক্ষ্য নির্ধারণ করে বিভিন্ন কর্মসূচি নেয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এ সময়ের মধ্যে সর্বাধিক মস্তিষ্কের বিকাশ ঘটলে শিশুরা দ্রুত শেখে এবং এ গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে বিনিয়োগের অর্থনৈতিক নিরিখে একাধিক সুবিধা রয়েছে। গর্ভবতী নারীদের এবং ছোট শিশুদের পুষ্টিগত উন্নতির মাধ্যমে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের পুঁজি এবং স্বাস্থ্যের ওপর দীর্ঘমেয়াদি সুবিধা প্রদানের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। জীবনের প্রথম এক হাজার দিন হলো দ্রুত বৃদ্ধি ও বিকাশের সময় এবং ভালো পুষ্টির অভাব আজীবনের জন্য বিরূপ পরিণতির দিকে চালিত করতে পারে।
আর্থসামাজিক ভিন্নতার কারণে শহরাঞ্চলের তুলনায় বাংলাদেশের গ্রামীণ এলাকায় বেশি খর্ব শিশু রয়েছে। মায়ের শিক্ষা এবং পরিবারের আয়ের ওপর নির্ভর করে খর্বতার প্রবণতা পরিবর্তিত হয়। বাংলাদেশের শিশুদের সুশিক্ষা, পুষ্টি এবং স্বাস্থ্য পরিষেবাসহ মানবিক পুঁজিতে আরো বিনিয়োগের প্রয়োজনীয়তা আগের চেয়ে এ মুহূর্তে অনেক বেশি অনুভূত হচ্ছে। পুষ্টি সংবেদনশীল কর্মসূচির সঙ্গে পুষ্টি নির্দিষ্ট কর্মসূচিগুলোর সমন্বয় প্রয়োজন, যা অপুষ্টির মোকাবেলা করে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ক্রয়ক্ষমতা সংকোচনের কারণে নিম্ন আয়ের বিপুলসংখ্যক মানুষ অভুক্ত ও অর্ধভুক্ত থাকছে। এমনকি তারা আমিষজাতীয় খাবারও পরিভোগ কমিয়ে দিয়েছে। এটি দেশের পুষ্টি পরিস্থিতিকে আরো খারাপের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। এ সমস্যা সমাধানে নিম্ন আয়ের মানুষের আয় বাড়ানোর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। এজন্য তাদের কর্মসংস্থান নিশ্চিতে ব্যবস্থা গ্রহণ, উচ্চমূল্যস্ফীতির হার হ্রাস এবং কৃষিপণ্যের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে মূল্যহ্রাস। সেই সঙ্গে অন্য যেসব বিষয় পুষ্টিহীনতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হিসেবে কাজ করছে, সেগুলো দূরীকরণে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। অন্যথায় দেশে পুষ্টিহীনতা আরো প্রকট আকার ধারণ করবে এবং বৈশ্বিক পুষ্টি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান তলানিতে নেমে যাবে।
একটি স্বাস্থ্যবান, উচ্চদক্ষ কর্মীশক্তি তৈরি করা এবং তা বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশকে অবশ্যই শিশু স্বাস্থ্য, পুষ্টি এবং শিক্ষার উন্নতির উদ্দেশ্যে সাশ্রয়ী বিনিয়োগ করতে হবে। স্বাস্থ্য পরিষেবাসংক্রান্ত সুবিধাগুলোয় বিনিয়োগ মানবপুঁজি তৈরিতে সাহায্য করে, যা শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুস্থ, উৎপাদনশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
পুষ্টির জন্য বিনিয়োগের কাঠামোর ওপর করা বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুসারে, খর্বতা, নারীদের রক্তস্বল্পতা এবং ছোট শিশুদের মধ্যে মারাত্মক অপচয়ের চিকিৎসার জন্য বিশ্বব্যাপী লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের উদ্দেশ্যে ১০ বছরে ৭০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করতে হবে। তাই বাংলাদেশকে বিশেষ করে প্রথম এক হাজার দিনে অল্প বয়সী শিশুদের জন্য সাশ্রয়ী পুষ্টি নির্দিষ্ট হস্তক্ষেপের ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হবে, যাতে ‘সকল প্রকারের অপুষ্টির অবসান’ ঘটিয়ে স্থিতিশীল উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি)-২ অর্জন করা যায় এবং দেশটি মানবপুঁজি উন্নয়নে বিনিয়োগ করার লাভ তুলতে পারে।
এম এম মুসা: সহযোগী সম্পাদক, বণিক বার্তা