ডায়াবেটিক সেবা দিবস

ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের স্বাস্থ্যসেবা আদর্শ

মানবতাবোধ দ্বারা তাড়িত গতিশীল জীবনের অধিকারী জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম (জন্ম ৩১ ডিসেম্বর ১৯১১, মৃত্যু ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯) ছিলেন বাংলাদেশে সত্যিকারার্থে এমন একজন প্রতিভাধর ব্যক্তি যার মধ্যে নিহিত ছিল বহুমুখী মানবীয় গুণের সমাহার। তিনি আজীবন নিজেকে জড়িত রেখেছিলেন মানবকল্যাণমূলক বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে। একই সঙ্গে স্বপ্ন দেখা ও সর্বাঙ্গ সুন্দরভাবে সেই স্বপ্নকে

মানবতাবোধ দ্বারা তাড়িত গতিশীল জীবনের অধিকারী জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম (জন্ম ৩১ ডিসেম্বর ১৯১১, মৃত্যু ৬ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯) ছিলেন বাংলাদেশে সত্যিকারার্থে এমন একজন প্রতিভাধর ব্যক্তি যার মধ্যে নিহিত ছিল বহুমুখী মানবীয় গুণের সমাহার। তিনি আজীবন নিজেকে জড়িত রেখেছিলেন মানবকল্যাণমূলক বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে। একই সঙ্গে স্বপ্ন দেখা ও সর্বাঙ্গ সুন্দরভাবে সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার মোহনীয় ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন ডা. মোহাম্মদ  ইব্রাহিম। মানবিক মূল্যবোধে উজ্জীবিত এ মহানুভব মানুষটি মানবতার মহান উচ্চ আদর্শের প্রতি ছিলেন আজীবন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ এবং নিবেদিতচিত্ত। বাস্তবতায় দেখা যায় অনেক সময় এ জাতীয় মানুষের মধ্যে বাস্তব বুদ্ধির কিছুটা ঘাটতি থাকে, ফলে তাদের আদর্শবাদ জাগতিক উপযোগিতার ক্ষেত্রে আপাত সাংঘর্ষিকতায় তারা হয়তো কাঙ্ক্ষিত কোন অবদান প্রত্যক্ষভাবে রাখতে পারেন না। বিস্ময়ের ব্যাপার ডা. ইব্রাহিম ছিলেন এক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। তিনি সেবার যে উচ্চ আদর্শ তার সহকর্মীদের মধ্যে প্রতিনিয়ত সঞ্চারিত করতে সচেষ্ট ছিলেন, তা ছিল বাস্তবতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। ‘শুধু উপদেশ, আদেশ, নির্দেশ নয় আপন দৃষ্টান্ত দিয়ে তিনি তার স্বপ্ন, কল্পনা ও আদর্শকে বাস্তব রূপ দিতেন। কর্তব্য পালনে, শৃঙ্খলা রক্ষায়, ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি করায়, সময় মেনে চলায়, স্নেহ, মমতা ও সহানুভূতিতে তার মতো বড় মাপের মানুষ যেকোনো দেশে যেকোনা সমাজে বিরল।’ বস্তুত অদম্য প্রাণশক্তি, ইস্পাতকঠিন সংকল্প এবং সাংগঠনিক বিচক্ষণতার সঙ্গে শ্রম ও পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যোগ্যতার মহামিলন ঘটেছিল একসঙ্গে এই বহুমুখী প্রতিভাশালী ব্যক্তিত্বের বলয়ে। ৬ সেপ্টেম্বর জাতীয় অধ্যাপক ইব্রাহিমের মৃত্যু দিবসকে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি ডায়াবেটিক সেবা দিবস হিসেবে পালন করে।   

রক্তে শর্করার পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে বেশি দিন ধরে থাকলে ডায়াবেটিস দেখা দেয়। সাধারণত ডায়াবেটিস বংশগত কারণে ও পরিবেশের প্রভাবে হয়। কখনো কখনো অন্য রোগের কারণেও হয়ে থাকে। এ রোগ সব লোকেরই হতে পারে। ডায়াবেটিস একবার হলে আর সারে না। এটা সবসময়ের এবং আজীবনের রোগ। তবে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করে এ রোগকে ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন সম্ভব হয়। অতিরিক্ত প্রস্রাব, অত্যধিক পিপাসা, বেশি ক্ষুধা, দুর্বল বোধ করা এবং কেটেছিঁড়ে গেলে ক্ষত তাড়াতাড়ি না শুকানো হচ্ছে এ রোগের সাধারণ লক্ষণ। যাদের বংশে রক্তসম্পর্কযুক্ত আত্মীয়স্বজনের ডায়াবেটিস আছে, যাদের ওজন খুব বেশি, যাদের বয়স ৪০-এর ওপর এবং যারা শরীর চর্চা করেন না, গাড়ি চড়েন এবং বসে থেকে অফিসের কাজকর্মে ব্যস্ত থাকেন তাদের ডায়াবেটিস হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। অত্যধিক চিন্তা-ভাবনা, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব, আঘাত, সংক্রামক রোগ, অস্ত্রোপচার, অসম খাবার, গর্ভাবস্থা এবং ওজন বেশি বেড়ে গেলে এ রোগ বাড়তে পারে। এগুলোর প্রতি দৃষ্টি রেখে প্রথম থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে কোনো কোনো ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ বা বিলম্বিত করা যায়। ডায়াবেটিস প্রধানত দুই প্রকার। (ক) ইনসুলিন নির্ভরশীল এবং (খ) ইনসুলিন নিরপেক্ষ। ইনসুলিন নির্ভরশীল রোগীর ইনসুলিনের অভাবের জন্য ইনসুলিন ইনজেকশন নিতে হয়। ইনসুলিন নিরপেক্ষ রোগীদের দেহে কিছু পরিমাণ ইনসুলিন থাকে। তবে চাহিদার প্রয়োজনে তা যথেষ্ট নয় বা শরীর ইনসুলিন ব্যবহার করতে পারে না। এসব রোগীর খাদ্য নিয়ন্ত্রণ এবং প্রয়োজনে শর্করা কমানোর বড়ি সেবন করতে হয়। 

যে দেশ ও সমাজে সীমাহীন সার্বিক (অর্থনৈতিক, চিন্তা চেতনার, সহনশীলতার, সাধনার) দারিদ্র্যের কারণে বড় কিছু করা যায় না, মহৎ কিছু গড়ে ওঠে না এবং যেখানে চিন্তার দৈন্য, উদ্যম উদ্যোগের অভাব এবং ত্যাগ শিকারের অনীহা অন্যতম প্রতিবন্ধকতা সেদেশে জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম প্রমাণ করে দিয়েছেন উদ্দেশ্য যদি মহৎ হয়, লক্ষ্য যদি স্থির থাকে, প্রচেষ্টা যদি আন্তরিক হয়, তবে স্বল্পোন্নত দেশেও বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি তথা বারডেমের মতো প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায়। ১৯৫৬ সালে তার প্রতিষ্ঠিত ডায়াবেটিস চিকিৎসা কেন্দ্রের প্রথম বছরে মাত্র ৩৯ রোগীর চিকিৎসা সম্ভব হয়েছিল। সেখানে এখন শুধু বারডেমেই চিকিৎসাধীন নিবন্ধিত রোগীর সংখ্যা পাঁচ লাখের কাছাকাছি। শুধু ঢাকা শহর এবং এর উপকণ্ঠে নয়, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির ডায়াবেটিস চিকিৎসা কেন্দ্র আজ দেশের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে। উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সততা থাকলে অঙ্কুর কী করে মহামহীরূহে রূপ লাভ করতে পারে, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির অন্যতম প্রতিষ্ঠান শাহবাগের বারডেম এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। বারডেম এখন শুধু দেশে নয়, বিদেশেও বিস্ময়করভাবে সমাদৃত, এটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক এর একটি সহযোগী কেন্দ্র হিসেবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশন বাংলাদেশের ডায়াবেটিক চিকিৎসা ব্যবস্থাপনাকে বিশ্বব্যাপী ডায়াবেটিক চিকিৎসার মডেল বা অনুসরণীয় আদর্শ হিসেবে গণ্য করে। আর  ডায়াবেটিস রোগের চিকিৎসার সঙ্গে আমেরিকার জসলিন, ইংল্যান্ডের লরেন্স ও বাংলাদেশের ইব্রাহিমের নাম জড়িয়ে রয়েছে।

ডায়াবেটিক সেবা কার্যক্রমকে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে জাতীয় অধ্যাপক ইব্রাহিম চিকিৎসা মানবসম্পদ তৈরির স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য বারডেম একাডেমি এবং নার্সিং ইনস্টিটিউট, আরভিটিসি ও বারটান গড়ে তোলেন। এরই সূত্র ধরে বা ভিত্তিতে পরবর্তীকালে সমিতির ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, নর্থবেঙ্গল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতি মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস (বিইউএইচএস), বারডেম নার্সিং কলেজসহ বহু প্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও চিকিৎসা ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে। কেননা তিনি মনে করতেন, মানবিক গুণ এবং সামাজিক দৃষ্টিশক্তিসম্পন্ন দক্ষ চিকিৎসক নার্স ও টেকনেশিয়ান না থাকলে বা গড়ে না উঠলে কার্যকর ডায়াবেটিস চিকিৎসা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম ডায়াবেটিক চিকিৎসা কার্যক্রমের শুরু থেকেই পুষ্টিবিদ এবং স্বাস্থ্যশিক্ষা কার্যক্রম প্রবর্তন করেন। তিনি মনে করতেন ডায়াবেটিক রোগীকে তার লাইফস্টাইল নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে অর্ধেক চিকিৎসা শেষ। উপযুক্ত পরামর্শ পেলে খাদ্যমান বজায় রাখা এবং শৃঙ্খলা সহজসাধ্য হয়। ওষুধপত্র দেয়ার সঙ্গে রোগীকে খাদ্যের তালিকা—কোন খাদ্যে কী পরিমাণ শর্করা ও ক্যালরি/প্রোটিন আছে তার একটা সচিত্র স্পষ্ট ধারণা দেয়া হয়। গাইড বইয়ে প্রতিটি রোগীর কী ধরনের খাবার কী পরিমাণ খেতে হবে তার নির্দেশনা চার্ট দেয়া আছে। সমিতির প্রতিটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে হেলথ এডুকেটরের পদ এবং রোগীকে কাউন্সেলিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। 

ডা. ইব্রাহিম ডায়াবেটিক চিকিৎসা সেবার ক্ষেত্রে ‘ইম্পেথি’ শব্দটির ওপর অত্যধিক গুরুত্বারোপ করতেন। ইংরেজি ‘ইম্পেথি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো স্বীয় সত্তা অন্যের সত্তায় বিলীন করে দিয়ে, অন্যের শোক, দুঃখ ও ব্যথার অভিজ্ঞতা কল্পনায় নিজে অনুভব করার শক্তি। আর ‘সিম্পেথি’ শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো অন্যের শোক-দুঃখের সাথে সমবেদনা বা সমব্যথিত হওয়া। অন্যের শোক, দুঃখ এবং অন্যান্য অভিজ্ঞতা মনে না করলে যেমন দুঃখী বা অন্তর্নিহিত ভাবকে নিজের মনে প্রতিফলিত করে সেবা দানে মনোনিবেশ করতে। এরূপ মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে যখন কোনো সেবাদানকারী কোনো আর্তপীড়িতের সেবায় নিজেকে প্রয়োগ করবে সে সেবাদানকারীই আর্তপীড়িতের সত্তার সঙ্গে বিলীন হতে পারবে আর সেবাদান তখনই পূর্ণাঙ্গ হবে। এভাবেই  কোনো সেবাদানকারী সেবা গ্রহণকারীর গভীরে প্রবেশ করতে পারবে, আর যখন সেবাদানকারী মনে করবে আমি যদি এ আর্তপীড়িত লোকটির মতো হতাম, যে আমার কাছে তার আর্তপীড়ার উপশম চাইতে আসছে এবং আর্তপীড়িতটি যদি আমার জায়গায় হতো, যার কাছে থেকে আমি পীড়িত হয়ে সেবা গ্রহণ করতে এসেছি। এই মানবীয় গুণ আয়ত্ত করার জন্য তিনি সবাইকে সবসময় অনুপ্রাণিত করার জন্য বলতেন, ‘আপনাদের সেবা করতে আমাদের সুযোগ দেয়ার জন্য আমরা আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ।’ রোগীদের সেবা প্রদানকারীর এরূপ ধারণাই থাকা উচিত, তারা বিনা পয়সায় সেবা গ্রহণ করতে এসেছে, এবং এর জন্য তাদের সেবা প্রদানকারীর কাছে কৃতজ্ঞ থাকার চেতনাবোধ থাকতে হবে। পক্ষান্তরে ডা. ইব্রাহিম তার সেবাদানকারী সহকর্মীদের বলতেন, তারা যেন রোগীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে এজন্য, তারা (রোগীরা) এখানে আমাদের সেবা গ্রহণ করতে এসেছে এবং তারা না এলে আমাদের কাজ থাকত না।   

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সরকারের সাবেক সচিব ও এনবিআরের চেয়ারম্যান। বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির কাউন্সিল সদস্য

আরও