দ্বিতীয় মেয়াদে ২০ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব গ্রহণ করতে যাচ্ছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ২০২০ সালে জো বাইডেনের কাছে পরাজিত হওয়ার পর থেকেই আসলে নিরবচ্ছিন্ন নির্বাচনী প্রচারণার মধ্যে ছিলেন তিনি। তার প্রথম মেয়াদের পলিসির আরেকটু গোছালো পুনরাবৃত্তির ইঙ্গিত দিচ্ছেন অনেকে। অর্থনীতিকে গতিশীল করতে করহার কমানো, বৈদেশিক বাণিজ্যে নিজেদের লাভ বাড়াতে উচ্চ শুল্ক আরোপ, যত বেশি সম্ভব অভিবাসীদের দেশত্যাগে বাধ্য করার মাধ্যমে দেশীয় শ্রমিকদের জন্য আরো বেশি সুযোগ সৃষ্টি করা। কিন্তু এত দিনে জল অনেক গড়িয়েছে রেটরিকের সঙ্গে বাস্তবতার মিল খুব সামান্যই।
২০১৬ সালে যখন ট্রাম্প প্রথমবারের মতো প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন, তখন যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘস্থায়ী নিম্ন মুদ্রাস্ফীতির সময়কাল অতিক্রম করছিল। মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফেডারেল রিজার্ভ ট্রাম্পের পুরো মেয়াদকালে সুদের হার শূন্যের কাছাকাছি রেখেছিল। তবে এবার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। কভিড মহামারীর সময় মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে গিয়েছিল এবং ফেড এখনো মুদ্রাস্ফীতির উচ্চ হারের আশঙ্কা করছে। নিম্ন বেকারত্বের অর্থনীতির জন্য আর্থিক প্রণোদনা হতে পারে ট্রাম্প প্রস্তাবিত করহার কমানোর প্রস্তাব। নিম্ন বেকারত্বসহ একটি অর্থনীতির জন্য রাজস্ব উদ্দীপনা বোঝায়। আবার মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতির সময় কঠোর মুদ্রানীতির দ্বারস্থ হওয়া যেতে পারে।
ফেডের নেতৃত্ব পরিবর্তন নিয়ে বেশ হইচই করেছেন ট্রাম্প। তবে তিনি জেরোম পাওয়েলকে বরখাস্ত করলেও দীর্ঘমেয়াদি উচ্চ সুদহার এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির ঝুঁকি এড়াতে পারবেন না। ট্রাম্প দায়িত্ব নিয়েই কর কমাবেন এ বিষয়ে সন্দেহ নেই, তবে তা হবে ধনীদের জন্য। কিন্তু এতে সরকারের রাজস্ব হ্রাস দীর্ঘমেয়াদে আর্থিক টেকসইতা ক্ষুণ্ন করবে। বৃহত্তর ঘাটতি স্বাভাবিকের চেয়ে সুদের হার বেশি রাখবে এবং ডলার শক্তিশালী হতে পারে, যা মার্কিন রফতানিকারকদের এবং ডলারে ঋণ গ্রহণকারী দেশগুলোর জন্য সমস্যা সৃষ্টি করবে।
শুল্ক ইস্যুতে বিশ্বনেতারা ও আর্থিক খাতের কর্তাব্যক্তিরা এখন বুঝে গেছেন যে ট্রাম্প অনেক বড় বড় কথা বলতে পারেন। কিন্তু তার হাতে বড় আকারের নীতিগত পরিবর্তনের ক্ষমতা অনেক কম। তিনি নিশ্চয়ই চটকদার কিছু শুল্ক আরোপ করবেন, তবে মার্কিন ব্যবসায়িক স্বার্থগুলো অবিলম্বে নিয়মের ফাঁকফোকর খুঁজে বের করবে এবং বিশেষ ছাড়ের জন্য লবিং শুরু করবে। সফরকারী বিদেশী নেতারা ট্রাম্প মালিকানাধীন অবকাশযাপন কেন্দ্র মার-এ-লাগোতে যাবেন, গলফ খেলবেন এবং পারস্পরিক ছাড়ের ব্যাপারে আলোচনা করবেন। হয়তো বলবেন, আমরা আপনার বুর্বনের (মার্কিন হুইস্কি) ওপর কর আরোপ করব না, আপনি আমাদের কগনাকের (ফরাসি ব্রান্ডি) ওপর করারোপ করবেন না। আর আমরা তো আরো বেশি মার্কিন নির্মিত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কিনছিই।
ট্রাম্প হয়তো এসব বিশেষ অনুরোধ উপেক্ষা করে এবং সার্বিকভাবে শুল্ক বৃদ্ধি করতে চাপ দিতে পারেন। তবে এর ফলে বাণিজ্যিক অংশীদারদের কাছ থেকে পাল্টা প্রতিক্রিয়া পেতে পারেন। এতে বর্তমানে তাকে সমর্থন জোগালেও বড় বড় কোম্পানির কাছ থেকে তখন আরো প্রতিবাদ আসবে। ট্রাম্পের সবচেয়ে বড় চাওয়া হলো অভ্যন্তরীণ বাজারে চাকরি হারানো ঠেকানো। এমনটা ঘটতে পারে যদি যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানিগুলো আমদানি পণ্যের জন্য বেশি টাকা দিতে বাধ্য হয় এবং রফতানি বাজারে প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা হারায়। অথবা গলফ কোর্সে তাকে খারাপ খেলোয়াড় হিসেবে না দেখিয়ে যদি বিদেশী নেতারা তাকে আশ্বস্ত করেন তাদের কোম্পানিগুলো কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করছে তাহলে আলোচনার দরজা উন্মুক্ত থাকবে।
অবৈধ অভিবাসনের বিষয়টিতে ট্রাম্প নিশ্চিতভাবেই হস্তক্ষেপ করবে। সীমান্ত প্রাচীরের কোনো বাস্তব অস্তিত্ব ও অর্থ না থাকলেও ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ওপর এমন এক অদৃশ্য প্রাচীর নির্মাণ করবেন। অর্থাৎ কিছু দেশের ওপর যুক্তরাষ্ট্র থেকে তাদের অভিবাসী ফিরিয়ে নেয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ করবেন। এ নিয়ে এরই মধ্যে ট্রাম্প মেক্সিকো ও অন্যান্য দেশকে (এমনকি কানাডাও) উচ্চ শুল্ক আরোপ এবং বিভিন্ন পদক্ষেপের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত করার হুমকি দিয়েছেন। পাশাপাশি ট্রাম্প ভেনিজুয়েলায় আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা শিথিল করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা বিশ্ববাজারে তেলের সরবরাহ আরো বাড়াবে এবং ভেনিজুয়েলার অর্থনৈতিক অগ্রগতিতে সহায়ক হবে। এছাড়া ভেনিজুয়েলায় অভিবাসনের চাপ কমবে। কিন্তু ভেনিজুয়েলাকে সহযোগিতার পেছনে অন্যতম কারণ হতে পারে ইরান ও রাশিয়ার ওপর চাপ বাড়ানো। কারণ এ দুই দেশই চীন থেকে অস্ত্র ও ইলেকট্রনিক যন্ত্রাংশ কেনার জন্য তেল রফতানির ওপর নির্ভরশীল।
এর বাইরেও ট্রাম্প আরেকটি পদক্ষেপ নিতে পারেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাসরত লাখ লাখ অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়তে বাধ্য করতে পারেন। তবে গণহারে অভিবাসন প্রত্যাহার যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি ও নির্মাণের মতো অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ খাতগুলোর জন্যই চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে। একই সঙ্গে সামাজিক অস্থিরতা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ব্যবসার সহযোগীদের বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। অবশ্য এসবের মধ্যে সবার রাজনৈতিক নাটক ও চমকপ্রদ শিরোনাম দেখার সুযোগ হবে। কিন্তু বাস্তবতা তেমন পরিবর্তিত হবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া এরই মধ্যে অবৈধ অভিবাসনের হার কমে গেছে।
সব মিলিয়ে নানা প্রশ্ন জাগে। ডোনাল্ড ট্রাম্প আসলে কী করতে চলেছেন? তিনি কি গ্রিনল্যান্ড অথবা কানাডা কিনে ফেলবেন কিংবা পানামা খালের ওপর পুনরায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবেন অথবা ন্যাটোর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তার পরিমাণ কমাবেন? এসব বিষয়ে ট্রাম্পের সাম্প্রতিক মন্তব্যগুলো মোটেও অর্থহীন নয়। আবার একেবারে আক্ষরিক অর্থে নেয়ারও সুযোগ নেই। তবে এতটুকু নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে সব কিছুর ঊর্ধ্বে গিয়ে ট্রাম্প এমন কিছু পেতে চেষ্টা করবেন যা অন্তত তার কাছে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য অধিকতর ভালো বলে বিবেচিত হবে। তবে আসলেই কী চান সেটা স্পষ্ট করে না বলার অর্থ হতে পারে তিনি পরামর্শ শুনতে আগ্রহী। অথবা সবশেষ পরিণতিকে তিনি কৌশলগত বিজয় হিসেবে আখ্যায়িত করতে পারেন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদেও অনেকটা এগুলোই ঘটেছিল। বিশেষ করে যখন উত্তর আমেরিকার মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (নাফটা) মাধ্যমে মেক্সিকো ও কানাডার সঙ্গে পুনরায় আলোচনায় বসা হয় এবং বাণিজ্য চুক্তি সংশোধন করা হয়। এমনকি ট্রাম্প প্রথমে হুমকি দিয়েছিলেন যে একদিনের ব্যবধানে নাফটাকে বিলীন করে দেবে। যদিও শেষ পর্যন্ত তিনি ছোটখাটো পরিবর্তনের বিষয়ে একমত হন। তবে এর পরিপ্রেক্ষিতে নাফটা চুক্তি সংশোধনের পর যুক্তরাষ্ট্র-মেক্সিকো-কানাডা অ্যাগ্রিমেন্ট (ইউএসএমসিএ) করা হয়।
বিশ্ব বড় ধরনের রূপান্তরের দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু এটি ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ট্রাম্প এখনো চীন ও ইরানের ব্যাপারে আগ্রাসী। অথচ চীন ও ইরান উভয় দেশই অর্থনৈতিকভাবে খারাপ অবস্থানে রয়েছে। এ কারণে আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক শান্তি-শৃঙ্খলার জন্য দেশ দুটি মোটেও হুমকিস্বরূপ নয়। তাছাড়া ডোনাল্ড ট্রাম্পও তার প্রথম মেয়াদের মতোই এবারো বিদেশী হস্তক্ষেপ থেকে সরে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিন্তু ইউক্রেনে রাশিয়ার ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের প্রয়োজনীয়তা পুতিনকে চীনের কাছে পুরোপুরি নির্ভরশীল করে তুলেছে। সেক্ষেত্রে ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার রাজনৈতিক দল রিপাবলিকান কংগ্রেস কি সত্যিই ইউক্রেনে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংকে একটি অবৈধ ও রক্তাক্ত বিজয় তুলে দিতে চান?
যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান ভোটাররা মোটাদাগে ভালো চাকরি ও জীবনযাপনের ব্যয় নিয়ে চিন্তিত। কিন্তু ট্রাম্পের পপুলিস্ট এজেন্ডা মূলত আকাশকুসুম কল্পনা। এটি ভয় দেখিয়ে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এর পরও ডোনাল্ড ট্রাম্পের কল্পনাপ্রসূত শত্রুদের বিরুদ্ধে এ এজেন্ডা ব্যর্থ চেষ্টা বলেই অনুমান করা যায়।
আগে থেকেই শক্তিশালী এমন এক অর্থনীতি ডোনাল্ড ট্রাম্প উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। কিন্তু তার মৌলিক নীতিগুলো স্বল্পশিক্ষিত শ্রমিকদের জন্য তেমন ইতিবাচক কিছু বয়ে আনবে না। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের খুব বেশি নাগরিকের জীবনমানেও উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হবে। বরং ধনী আরো ধনী হবে, অতি ধনী ব্যক্তিরা আরো ধনী হবে। আর বাকিরা সম্ভবত উচ্চ মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করবে। পাশাপাশি জনসেবা নেয়ার তালিকা ছোট হয়ে আসবে।
[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]
সাইমন জনসন: ২০২৪ সালে অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ। এমআইটি স্লোয়ান স্কুল অব ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক