বাংলাদেশের অর্থনীতি কয়েক বছর ধরে সংকটকালীন সময় পার করছে। ২০২৩ সালে সেই সংকট প্রকট আকার ধারণ করে। গত বছর বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, আস্থার সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে দেশীয় মুদ্রার ব্যাপক অবমূল্যায়ন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, জাতীয় তথা মাথাপিছু ঋণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়া, ব্যাপক আয়বৈষম্য, অকল্পনীয় জ্বালানি সংকট, তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্পে তীব্র শ্রমিক অসন্তোষ, বেকারত্ব প্রভৃতি সমস্যা মোকাবেলা করতেই সরকারি ও ব্যক্তিগত পর্যায়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। বাংলাদেশের বিপর্যস্ত অর্থনীতিকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলেছে তীব্র জ্বালানি সংকট। শিল্প ও আবাসিক উভয় ক্ষেত্রে জ্বালানি গ্যাসের প্রাপ্যতা অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
এ পরিস্থিতিতে সরকার সমর্থিত সূত্র জানাচ্ছে, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) আমদানি কমে যাওয়ায় দেশে গ্যাসের সরবরাহ কমেছে। প্রশ্ন হলো, সরকার কি গ্যাস সংকটের বিষয়ে পূর্বানুমান করতে পারেনি? এ ব্যর্থতার জন্য কারা দায়ী? দেশী-বিদেশী কোনো গোষ্ঠীর অসৎ উদ্দেশ্য বাংলাদেশে গ্যাস ও জ্বালানি সংকটের কারণ কিনা তার অনুসন্ধান জরুরি। ভুলে গেলে চলবে না, শিল্পের উৎপাদন বন্ধ হলে অর্থনীতির প্রাণভোমরা তথা তৈরি পোশাক শিল্প ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং বাংলাদেশ পশ্চিমা বিশ্বের বাজার হারানোর ঝুঁকিতে পড়বে। একই সঙ্গে সারা দেশে বেকারত্ব বৃদ্ধি, শ্রমিক অসন্তোষের বিস্তার, আর্থসামাজিক পরিকাঠামো ভেঙে পড়া তথা সমগ্র বাংলাদেশের পরিবেশ হবে উত্তপ্ত ও চরম অস্থিতিশীল। এ সংকট যেকোনো সুযোগসন্ধানী রাষ্ট্র বা গোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থবিরোধী ট্রামকার্ড ফেলার সুযোগ সৃষ্টি করবে, যা কোনো অবস্থায় কাম্য অথবা গ্রহণযোগ্য নয়।
এ বছরের শুরুতে সুইজারল্যান্ড-ভিত্তিক অর্থনীতি বিশ্লেষক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যেসব বিপদের আশঙ্কা উপস্থাপন করা হয়েছে সে তালিকার প্রথমে স্থান পেয়েছে জ্বালানির জোগান সংকট। বাংলাদেশী গবেষণা সংস্থা সিপিডির সহায়তায় সম্পন্ন হওয়া এ জরিপের ফলে মূল্যস্ফীতি, অর্থনীতির গতিপথের নিম্নমুখী গন্তব্য, ধন ও আয়বৈষম্য, মাথাপিছু ঋণ বাড়ার চেয়ে অনাগত দিনগুলোয় জ্বালানি সংকট বাংলাদেশের জন্য বড় বিপদের কারণ হিসেবে উঠে এসেছে।
বাংলাদেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানের চাহিদার বিপরীতে গ্যাসের জোগান মাত্র ৬০ শতাংশে নেমে এসেছে। ফলে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে, কর্মসংস্থান কমে যাচ্ছে, সর্বোপরি অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। বিস্মৃত হলে চলবে না এ রকম পরিস্থিতিতে সরকার যদি তথ্যের নিরাপদ ও অবাধ প্রবাহ নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয় তখন ভুল এবং অপতথ্য বিস্তার হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হবে। ফলে দেশের মানুষের মাঝে সরকারের প্রতি অনাস্থা ও অবিশ্বাস জন্ম নেবে। মোদ্দাকথা এ সংকটাবস্থায় দেশের অভ্যন্তরে অরাজকতা বাড়বে এবং তখন শুধু আইনকানুনের কঠোর প্রয়োগ দিয়ে সে পরিস্থিতি মোকাবেলা সম্ভব হবে না, বরং অতি আমলাতান্ত্রিক নির্ভরতা অর্থনৈতিক সংকটকে আরো জটিল করে তুলবে।
বাংলাদেশে শিল্পে দৈনিক গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। তবে ৩০০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ পেলে শিল্পের উৎপাদনে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব রাখার মতো সংকট হয় না। এক সপ্তাহ আগে দৈনিক সরবরাহ ২৫০ কোটি ঘনফুটের নিচে নেমে এসেছে (প্রথম আলো/জানুয়ারি ১৭, ২০২৪)। ঢাকার নিকটবর্তী জেলাগুলোর মধ্যে গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও মানিকগঞ্জে বেশির ভাগ শিল্পের প্রডাকশন প্লান্ট অবস্থিত। ডায়িং, প্রিন্টিং অ্যান্ড ফিনিশিং, স্পিনিং মিলগুলোর উৎপাদন এক ধরনের ধসে পড়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন মোট সক্ষমতার ২৫ শতাংশে নেমে এসেছে। উৎপাদন চালু রাখতে সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার কিংবা ডিজেল ব্যবহার করতে বাধ্য হচ্ছেন অধিকাংশ শিল্প উদ্যোক্তা।
বিকল্প জ্বালানি প্রায় নিয়মিতভাবে ব্যবহার করার ফলে শিল্পের উৎপাদন ব্যয় বাড়ছে। তবু বিদেশী ক্রেতাদের বাজার ধরে রাখতে ক্ষতিন শিকার হয়ে অসংখ্য তৈরি পোশাক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান উৎপাদন চালিয়ে যেতে বাধ্য হচ্ছে। আশঙ্কার বিষয়, জ্বালানি গ্যাসের সংকট যদি দীর্ঘস্থায়ী হয় তবে অনন্তকাল এভাবে ক্ষতি গুণে ব্যবসা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। তখন নিশ্চিতভাবেই পশ্চিমা ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের ওপর অনাস্থা জ্ঞাপন করে ভারত, চীন, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, তুরস্কের মতো দেশের সঙ্গে ব্যবসা করতে আগ্রহী হবে। তখন বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভরকেন্দ্র তৈরি পোশাক শিল্পে এ ধরনের বিপর্যয় ঘটলে দেশের নাগরিকের সামগ্রিক জীবনযাত্রার মানে দ্রুতই ব্যাপক প্রভাব পড়তে শুরু করার আশঙ্কা রয়েছে। রফতানিমুখী শিল্প ছাড়াও অসংখ্য ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পেও গ্যাস প্রয়োজন হয়। গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত যানবাহনের রূপান্তরিত জ্বালানি হিসেবে সিএনজির বহুল ব্যবহার হয়। তাই জ্বালানি হিসেবে গ্যাস সংকটের তীব্র প্রভাব পড়তে বাধ্য।
বাংলাদেশে আমদানীকৃত এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশনের দায়িত্ব পেয়েছে সামিট গ্রুপ। বিপদের কথা হলো, জাতীয় গ্রিডে প্রক্রিয়াজাত গ্যাস সরবরাহে সামিটের দুটি ভাসমান টার্মিনালের (ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট বা এফএসআরইউ) একটি থেকে সংস্কারজনিত কারণে গত নভেম্বর থেকে সরবরাহ স্থগিত রয়েছে। অন্য ইউনিট থেকে ১৯ জানুয়ারি থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায় (বণিক বার্তা, ২০ জানুয়ারি, ২০২৪)। সামিট গ্রুপের পক্ষ থেকে কারিগরি ত্রুটির কারণে গ্যাস সরবরাহ স্থগিত হওয়ার ঘোষণা এলে এ ধরনের অবস্থার পূর্বানুমান করে কেন আগে থেকে বিকল্প ব্যবস্থা নেয়া হয়নি সে প্রশ্নের উদ্ভব ঘটে।
বাংলাদেশের মতো অতি ঘনবসতিপূর্ণ দেশের শিল্প ও আবাসিক খাতের জ্বালানি নিরাপত্তা দীর্ঘদিন ধরে যেকোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের গ্যাস সরবরাহের সক্ষমতার ওপর নির্ভর করা যৌক্তিক কিনা এ প্রশ্ন বিশেষজ্ঞদের চিন্তিত করছিল। এরই মধ্যে সামিট গ্রুপের সামিট অয়েল অ্যান্ড শিপিং কোম্পানি লিমিটেড এবং আরেকটি মার্কিন কোম্পানি (এক্সিলারেট এনার্জি বাংলাদেশ লিমিটেড) মিলে বাংলাদেশে এলএনজি আমদানির ক্ষমতা পেতে যাচ্ছে (প্রথম আলো, ৯ আগস্ট, ২০২৩) বলে সংবাদ আসে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৬ সাল থেকে এ যৌথ উদ্যোগ ১৫ বছর বাংলাদেশে এলএনজি সরবরাহ করার দায়িত্ব পাচ্ছে। রূপান্তরিত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিতের ক্ষেত্রে ব্যর্থতার প্রমাণ থাকার পরও কেন একই কোম্পানিকে রীতিমতো এলএনজি আমদানির অনুমতি ও ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে সে প্রশ্ন দৃঢ়ভাবে উত্থাপন হওয়া দরকার।
দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ক্ষমতার পালাবদলে প্রকল্প বদলে যাওয়া বা স্থগিত হওয়ার চর্চার প্রমাণ মেলে, কিন্তু গত ১৫ বছর একই দল বারবার সরকার গঠন করেছে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এ সময়ের মাঝে বাংলাদেশ সরকারকে ব্যাপকার্থে নতুন তেল-গ্যাস ক্ষেত্র সন্ধানের প্রতি আগ্রহী হতে দেখা যায়নি। প্রায় এক দশক আগে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরে নতুন সমুদ্রসীমার মালিকানা লাভ করেছে। ভারত ও মিয়ানমার উভয় দেশই তাদের মীমাংসিত সমুদ্রসীমায় ব্যাপকভাবে জ্বালানি তেল ও গ্যাসের উৎস খুঁজে উৎপাদনে গেলেও বাংলাদেশ বলার মতো কোনো উদ্যোগ নেয়নি, বরং দেশে জ্বালানি সংকট যখন তীব্র আকার ধারণ করেছে তখন বাংলাদেশের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় উচ্চ ব্যয়ের প্রসঙ্গ তুলে এ মুহূর্তে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান করা কেন ঝুঁকিপূর্ণ তা বোঝাতে চেষ্টা করছে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশের খনিজ তেল-গ্যাস আহরণে সফলতার হার অতিউচ্চ; প্রায় ৩৩ শতাংশ। সরকারের উচিত ছিল সময় থাকতেই বিকল্প জ্বালানির সন্ধান করে নিরাপদ উৎপাদনের পথে যাওয়া। সেটি তারা করেনি, বরং ব্যর্থতার দায় স্বীকার করতে কর্তৃপক্ষ একেবারেই অনাগ্রহী।
শিল্প ও আবাসিক জ্বালানি গ্যাসের পাশাপাশি সাম্প্রতিক সময়ে যানবাহনের জ্বালানি তেল, এমনকি উড়োজাহাজের জ্বালানির সংকটও দেখা গেছে। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে এবং একপর্যায়ে মাত্র এক-দুদিনের মতো জেট ফুয়েলের মজুদ থাকার তথ্য মিলেছে। এ ঘটনাগুলো প্রমাণ করে দেয় বাংলাদেশে জ্বালানি সংকট কেমন তীব্র এবং সামগ্রিকভাবে আমাদের অর্থনীতি কতটা ভয়ংকর বিপদের সম্মুখীন হয়েছে।
বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের মূল ক্ষেত্র মাত্র দুটি—তৈরি পোশাক রফতানি ও রেমিট্যান্স। দ্বিতীয়টির ওপর সরকারের সেই অর্থে নিয়ন্ত্রণ থাকে না। কারণ ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষ কীভাবে রেমিট্যান্স পাঠাবে তা নিজস্ব চিন্তা ও অভিরুচির ওপর নির্ভর করে। সাধারণত মানুষ মোটা অংকের লাভের প্রশ্নে বৈধ কিংবা অবৈধ উপায়ে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছে সেটি নিয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন হয় না। অন্তত প্রবাসে বসবাস করা অধিকাংশ বাংলাদেশী নাগরিকের নৈতিকতার মানদণ্ডের গড় বিবেচনায় নিলে এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে উৎপাদনক্ষম শিল্পের ওপর ইতিবাচক দৃঢ় সরকারি প্রভাব নিশ্চিত করা সম্ভব। সেজন্য দরকার সরকারের ইতিবাচক ও নিরপেক্ষ দৃষ্টভঙ্গি।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সংকট সমাধানে রাষ্ট্রীয়ভাবে নাগরিকের স্বাধীন ও নিশ্চিতভাবে মতপ্রকাশের অধিকার রক্ষা, তথ্যের অবাধ ও নিরাপদ প্রবাহ নিশ্চিত, নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্রযন্ত্রের আচরণ শ্রদ্ধাশীল হওয়া, ভিন্নমতকে অযৌক্তিকভাবে নাকচ করা থেকে বিরত থাকার মতো দায়িত্বশীল আচরণ করা জরুরি। তাহলে একদিকে যেমন সরকারের কাজের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত সম্ভব হয়, তেমনি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষের যেকোনো ভুল-ত্রুটি বড় ধরনের ক্ষতির কারণ হওয়ার আগে শুধরে নেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়।
আশা করি, সরকার জ্বালানি গ্যাসের সংকট মোকাবেলাসহ বাংলাদেশের অর্থনীতির সংস্কারের প্রশ্নে ক্ষুদ্র স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে শুরু করবে। অন্যথায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চলমান সংকট কেবল আরো ঘনীভূতই হবে না, বরং আমাদের জাতীয় জীবনে অকল্পনীয় বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসতে পারে। ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার মাত্রায় ভিন্নতা থাকলেও এ বিপর্যয়ের প্রভাব থেকে ধনী-দরিদ্র, প্রভাবশালী-ক্ষমতাহীন কেউই রক্ষা পাবে না। নিশ্চিতভাবে বাংলাদেশী নাগরিক হিসেবে এ অভিজ্ঞতা আমাদের জন্য সুখকর কিছু হবে না। এ মহাবিপদ থেকে রক্ষা করার একমাত্র উপায় সুশাসন নিশ্চিত করা। কীভাবে তা করা সম্ভব হবে সে সিদ্ধান্ত নেয়ার ভার জাতিগতভাবে সবার ওপর বর্তায়। বিশ্বাস করি, প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতি রক্ষা করতে সচেষ্ট হব।
কায়সুল খান: শিক্ষার্থী ও গবেষক
নোভা ইউনিভার্সিটি অব লিসবন, পর্তুগাল