শত পণ্যের শুল্ক-ভ্যাট বাড়াল অভ্যুত্থানের সরকার

অর্থনীতিতে গণমুখী যাত্রা প্রত্যাশার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়

রাজস্ব আয়ের একটি অন্যতম উৎস হলো কর। এ আয় বৃদ্ধিতে অনেক সময় শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানো হয়। রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি বাজেট ঘাটতি মেটাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে।

রাজস্ব আয়ের একটি অন্যতম উৎস হলো কর। এ আয় বৃদ্ধিতে অনেক সময় শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) বাড়ানো হয়। রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি বাজেট ঘাটতি মেটাতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। কিন্তু দুই বছরের বেশি সময় ধরে যে দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি বিরাজমান, সেখানে শুল্ক-ভ্যাট বাড়িয়ে রাজস্ব আয় বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মোটেও প্রত্যাশিত নয়। অথচ এমন বাস্তবতায় দাঁড়িয়েও সরকারের একশ পণ্য ও সেবার ওপর মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), সম্পূরক ও আবগারি শুল্ক আরোপ করাটা বেশিই হতাশাব্যঞ্জক। এমন সিদ্ধান্ত নিম্ন, মধ্যবিত্ত ও সীমিত আয়ের মানুষের জন্য অনেকটাই ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ এর মতো। বলা বাহুল্য, পণ্য ও সেবার বাড়তি মূল্য সাধারণ মানুষের ওপর আর্থিক চাপ বাড়াবে। যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, যেসব পণ্যের ওপর শুল্ক-ভ্যাট বাড়ানো হয়েছে তা মূল্যস্ফীতির ওপর প্রভাব ফেলবে না বা মূল্যস্ফীতিকে আরো স্ফীত করবে না। কেননা সেগুলো অত্যাবশকীয় পণ্য বা সেবা নয়। কিন্তু ওই শত পণ্যের তালিকায় যখন ওষুধ, এলপিজি, রেস্তোরাঁর খাবার, মিষ্টি, ফল, ডিটারজেন্ট, মোবাইল ফোন সেবা ইত্যাদির নাম দেখা যায়, তখন সহজেই অনুমেয় মানুষের জীবনযাপনের ব্যয় আরো বাড়তে চলেছে। বরং আশ্চর্য হতে হয়, যখন তথ্যপ্রযুক্তির যুগে, ইন্টারনেট সেবাকে অত্যাবশ্যকীয় পণ্যের তালিকায় রাখা হয় না। আর ওষুধ তো মানুষের জীবন ও সুস্বাস্থ্যের জন্য অতীব জরুরি।

এদিকে সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল এমন গণমুখী নীতির, যা তাদের আর্থিক কষ্ট থেকে মুক্তি দেবে। সরকার জনগণের মধ্যে আর্থিক স্বস্তি ফিরিয়ে আনবে। যদিও সে প্রত্যাশা এখনো পূরণ হয়নি।

শুল্ক-ভ্যাট আরোপের বিষয়ে সরকারের দিক থেকে যে যুক্তিই দেয়া হোক না কেন তা প্রশ্নবিদ্ধই রয়ে যায়। কেননা সারা বিশ্বে রাজস্ব আয় বাড়াতে মূলত প্রত্যক্ষ করের আওতা বাড়ানো হয়। অর্থাৎ যার আয় বেশি, সে আয়কর দেয়ার মাধ্যমে তুলনামূলক বেশি কর প্রদান করবে। এভাবে একটি সমাজে ধনী-গরিবের জীবনযাপনের ক্ষেত্রে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়। পরোক্ষ কর বাড়লে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দরিদ্ররা। এর তেমন কোনো প্রভাব পড়ে না ধনীদের ওপর। দেশের অর্থনীতিবিদরা, বিশেষত যারা দায়িত্বে রয়েছেন তারাও বরাবর রাজস্ব আয় বৃদ্ধি প্রসঙ্গে প্রত্যক্ষ করের ওপরই জোর দিয়ে আসছেন। কিন্তু এর পরও কেন এমন সিদ্ধান্ত তা নিয়ে শুরুতেই প্রশ্ন জাগে।

বণিক বার্তার এক সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দর্শনে চলছে দেশের অর্থনীতি। সে প্রতিবেদনের যথার্থতা বর্তমান সরকারের শুল্ক-ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে আরো একবার স্পষ্ট হয়ে উঠল। বাংলাদেশকে দেয়া ৪৭০ কোটি ডলারের চলমান ঋণ কর্মসূচির সঙ্গে জুড়ে দেয়া একটি শর্ত রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি। সংস্থাটির বেঁধে দেয়া রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে বর্তমান সরকার পরোক্ষ কর বাড়িয়েছে।

বিগত সরকারের আমলেও আইএমএফের শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে অনেক উদ্যোগ নিতে দেখা গেছে। জ্বালানি খাতে ভর্তুকি হ্রাসসহ কয়েক দফা বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ায় সে সরকার। আর্থসামাজিক খাতে এর গুরুতর প্রভাব পড়ে। জ্বালানির দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ ও উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে। যা মূল্যস্ফীতিকে আরো উসকে দিয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে আবারো পরোক্ষ কর বাড়ানো সমীচীন হয়েছে বলে মনে হয় না।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর থেকে চারদিকে বিভিন্ন খাত সংস্কারের প্রস্তাব উঠেছে। সংস্কারের কিছু কার্যক্রম চলমানও। কিন্তু রাজস্ব খাত সংস্কারের কাজ কতটা এগোচ্ছে? মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার কয়েকটি নিত্যপণ্যে শুল্ক করে ছাড় দিয়েছে। এতে রাজস্ব আয় কমতে পারে। কিন্তু যে উদ্দেশ্যে শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছিল, সে পরিস্থিতিতে তথা মূল্যস্ফীতিতে এর কোনো প্রভাব দৃশ্যমান নয়। এখানেও পরোক্ষ কর বাড়ানোর যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন জাগে। যেখানে প্রায় সব দেশেই রাজস্ব আদায়ের প্রধান খাত প্রত্যক্ষ কর, সেখানে এ দেশে কেবল পরোক্ষ কর বেড়ে চলেছে। প্রত্যক্ষ করের আওতা না বাড়িয়ে শুল্ক-ভ্যাটকে রাজস্ব আয়ের প্রধান হাতিয়ার করা হয়েছে।

অথচ সরকারের সুযোগ ছিল আয়করের পরিসর বাড়ানোর। গত অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১ কোটি ৪ লাখ করদাতা শনাক্তকরণ নম্বরধারী (টিআইএন) ছিল। কিন্তু আয়কর রিটার্ন জমা দিয়েছেন মাত্র ৪৩ লাখ। নিবন্ধিত করদাতার সংখ্যা বাড়লেও রিটার্ন জমা দেয়া ব্যক্তির সংখ্যা সেই তুলনায় বাড়েনি। এর জন্য বিশেষভাবে দায়ী অপর্যাপ্ত পর্যবেক্ষণ, স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়মিত করদাতা জরিপের অনুপস্থিতি এবং কর প্রশাসনের অটোমেশনের ধীরগতি। এছাড়া রিটার্ন দাখিলে প্রমাণও (পিএসআর) যথাযথভাবে তদারকি হচ্ছে না। সামগ্রিকভাবে দেশে কর আহরণ ব্যবস্থা যথাযথভাবে সম্প্রসারণ না হওয়ায় কর প্রদানে মানুষের আগ্রহ কম।

আবার আয়করের ক্ষেত্রে যেমন ফাঁকি রয়েছে, তেমনি ভ্যাট দেয়ার ক্ষেত্রেও অনিয়ম-দুর্নীতি রয়েছে। দেশে ভ্যাট নিবন্ধন নেয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫ লাখ ২৫ হাজার। এর মধ্যে গড়ে সাড়ে তিন লাখ প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ভ্যাট দেয়। এর বাইরে যে লাখ লাখ প্রতিষ্ঠান রয়েছে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে ভ্যাটের আওতায় আনা যায় তা নিয়ে কোনো কার্যকর উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না।

আয়কর-ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার এমন সংস্কৃতিতে শুল্ক-ভ্যাট বাড়িয়ে রাজস্ব আয়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা কঠিন হবে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন ছিল রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) দুর্বলতা নিয়ে কাজ করা এবং কর কাঠামোর সংস্কারে মনোনিবেশ করা। প্রত্যক্ষ কর আহরণের ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা হলো কর জমাদানের প্রক্রিয়াটি এখনো জটিল। করদাতাদের স্বেচ্ছায় কর প্রদানে উদ্বুদ্ধকরণের পাশাপাশি জটিলতা কমিয়ে আনায় কাজ করা গেলে হয়তো রাজস্ব আয় স্বাভাবিক নিয়মেই বাড়বে। তাছাড়া দেশে আগে থেকে বিদ্যমান ব্যবসায়িক ও অর্থনৈতিক সংকটগুলো রাজস্ব আয়ে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। মানুষ এমনিতেই তাদের ব্যয়ে অনেক কাটছাঁট করে চলছে। বিশেষ করে খাদ্যদ্রব্যে। এখন খাদ্যদ্রব্য-বহির্ভূত পণ্যেও কাটছাঁট করতে পারে। আর যদি এমন হয় তাহলে কি রাজস্ব আয় বাড়বে? রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে যেসব অনিয়ম-দুর্নীতি বিরাজ করছে, সেগুলো দূর করেও রাজস্ব আয় বাড়ানো সম্ভব হতো। কিংবা প্রকৃতপক্ষে যদি কেবল অনাবশ্যকীয় পণ্যে শুল্ক-ভ্যাট বাড়ত সেটিও অন্তত মানানসই পদক্ষেপ হতে পারত। আমদানি শুল্ক বাড়ালে দেশীয় শিল্পের বিকাশেও তা কাজে লাগানো যেত। কিন্তু বাস্তবে এর কোনোটাই হচ্ছে না।

আরও