নগরায়ণ এখন দেশের অর্থনৈতিক তথা সামাজিক উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ, এক বিশেষ শর্তও বটে। এ চিন্তার পরিসরে এখন আর কেবল পানি-জঞ্জাল পরিষ্কার ও পয়োনিষ্কাশনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, রাষ্ট্র ও নাগরিকের জানমাল রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তাই বৃহত্তর আর্থরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটের বাইরে আজকের নগরজীবন নাগরিকের প্রাত্যহিক চাহিদা পূরণে সক্ষম কিনা, তা সিটি করপোরেশন, রাজউক, স্থানীয় সরকারসহ সংশ্লিষ্টদের পরিচালনার কার্যকলাপে আসা উচিত।
একজন নাগরিক তার দৈনন্দিন জীবনে সামাজিক, মানসিক ও শারীরিকভাবে কতটা স্বাচ্ছন্দ্যে আছেন, সেই সামগ্রিক বিকাশকেই চাহিদা নির্দেশ করে। সুতরাং পরিষেবা নয়, নাগরিক জীবনের সামগ্রিক বিকাশই নগর পরিকল্পনার লক্ষ্য হওয়া উচিত। আধুনিক রাষ্ট্রের ইতিহাসে নগর পরিকল্পনার উদ্ভব হয়েছে জনস্বাস্থ্যজনিত সংকট থেকে। শিল্পবিপ্লবের সময় থেকেই বোঝা গিয়েছিল, ইউরোপ ও আমেরিকায় শহরগুলোর ঘিঞ্জি, নোংরা পরিবেশে শ্রমিকদের গাদাগাদি বসবাসই রোগ সংক্রমণের প্রধান কারণ। তার ফলে জনস্বাস্থ্যসংক্রান্ত সমস্যার সমাধানই নগর পরিকল্পনার প্রধান অংশ হয়ে ওঠে, যা পয়ঃপ্রণালি, পানীয় জলের সংযোগ থেকে বসতবাড়ির নকশা—সবই নির্ধারণ করত। শহরের পরিচ্ছন্নতা, বাসস্থানকে আলো-বাতাসময় ও বসতি অঞ্চলকে রোগমুক্ত রাখাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য।
কিন্তু বিশ শতকের শুরু থেকেই নগর পরিকল্পনায় জনস্বাস্থ্যের গুরুত্ব কমতে থাকে। কারণ ততদিনে ‘জার্ম থিওরির’ আবির্ভাবের কারণে জনস্বাস্থ্যের অভিমুখ সংক্রামক রোগের জীবাণু নিয়ে গবেষণা এবং টিকা আবিষ্কারের দিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে। তার ফলে রোগ প্রতিরোধে টিকা প্রদানই মুখ্য হয়ে ওঠে; রোগ নির্মূলের জন্য পরিবেশের যে সার্বিক উন্নয়ন দরকার, তা অবহেলিত হতে শুরু করে। জনস্বাস্থ্যের এ বিবর্তনই নগর পরিকল্পনা থেকে তাকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে এবং এখন কেবল কিছু বিক্ষিপ্ত পরিষেবায় (যেমন জল সরবরাহ, জঞ্জাল পরিষ্কার, টিকা প্রদান কর্মসূচি ইত্যাদি) পর্যবসিত করেছে।
অপরিকল্পিত নগরায়ণের ইঁদুরদৌড় ঢাকা-চট্টগ্রামের মতো শহরকে আড়ে-বহরে-উচ্চতায় ক্রমেই বাড়িয়ে চলেছে। পুকুর থেকে মাঠ সব হারিয়ে যাচ্ছে, ফুটপাত-রাস্তা বেদখল হচ্ছে, খাল থেকে নালা-নর্দমা জনসংখ্যার ক্রমবর্ধমান চাপ নিতে না পেরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। বাসস্থান আয়তনে ছোট হতে হতে আলো-বাতাসহীন হয়ে পড়ছে, বসতি অঞ্চলেই পরিবেশ দূষণকারী ব্যবসা গজিয়ে উঠছে। আপাতদৃষ্টিতে এসব অনিয়মকে প্রশাসনিক ব্যর্থতা বলে পার পেয়ে যাওয়া যেতে পারে। কিন্তু খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে, আজকের নগরজীবন হচ্ছে সামাজিক ও অর্থনৈতিক লড়াইয়ে বেঁচে থাকার জন্য নাগরিকদের পারস্পরিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার এক যান্ত্রিক পদ্ধতি। এ যান্ত্রিকতা কেবল শহরের সার্বিক উন্নয়নকেই বাধাপ্রাপ্ত করছে না, নাগরিকের সামগ্রিক বিকাশেরও অন্তরায় হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বাংলাদেশের নগর পরিকল্পনার সঙ্গে সুস্থায়িত্বের সম্পর্ক অতি ক্ষীণ। বাংলাদেশের শহরগুলো ‘আরবান হিট ট্র্যাপ’ তৈরি করছে। তার ফল আজ অনুভব করছে ঢাকাসহ অন্যান্য বড় শহর। ৪০ ডিগ্রির ওপর থাকছে ঢাকার তাপমাত্রা। এমনভাবে শহর গড়ে উঠেছে যে ভূপৃষ্ঠ থেকে তাপ প্রতিফলিত হয়ে শূন্যে ফিরতে পারছে না, আটকা পড়ছে ভবনে। অপ্রতুল পানি ও পয়োনিষ্কাশন—এসবের সঙ্গেই নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য, সুরক্ষা এবং পরিবেশগত সুস্থায়িত্বের প্রত্যক্ষ বিরোধ রয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, কোনো এলাকায় বাড়ি তৈরির আগে সেখানকার মাটির চরিত্র, গাছপালার সংখ্যা, আলো-হাওয়ার পরিমাণ, উপযুক্ত নিকাশি ব্যবস্থা ইত্যাদি বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন। একটি এলাকায় জনঘনত্বের কী অনুপাত থাকা উচিত, তা এলাকার পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য পরিষেবার সুযোগ-সুবিধার নিরিখেই নির্ধারিত হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশে এসব নিয়মের কোনো বালাই নেই।
প্রতিদিন শহরে যে বাড়তি মানুষের তাপ উৎপন্ন হচ্ছে, সেটা নিয়ে নীতিনির্ধারকদের কোনো পরিকল্পনা আছে বলে মনে হয় না। তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য জলবায়ুকে দায়ী করেই কর্তৃপক্ষ দায় এড়াতে চাইছে। কিন্তু শহরের তাপমাত্রা বৃদ্ধির জন্য জলবায়ু পরিবর্তন কম দায়ী, বড় সমস্যা জনসংখ্যা ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন। গবেষণায় দেখা গেছে, বিশ্বজুড়ে তাপমাত্রা বৃদ্ধি যেখানে দেড় ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা হচ্ছে, ঢাকার তাপমাত্রা গত ২০ বছরে প্রায় ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। জলবায়ু পরিবর্তন নয়, বরং অন্য শহরগুলোর তুলনায় ঢাকার তাপমাত্রা সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধির পেছনে এর জনসংখ্যা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, জলাভূমি ভরাট ও গাছপালা কেটে ফেলাকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। শহরগুলোর আশপাশের অঞ্চলে দিনের তাপ হারিয়ে রাতের তাপমাত্রা যতটা কমে আসতে পারে, শহরগুলোয় আর আগের মতো রাতের তাপমাত্রা সেভাবে কমতে পারছে না। শহরকে ইট ও কংক্রিট দিয়ে ভরে ফেলা, পর্যাপ্ত জলাধার ও গাছ না থাকার ফলে ঢাকাসহ অন্য মহানগরগুলো পরিণত হচ্ছে ‘হিট আইল্যান্ড’ বা উত্তপ্ত দ্বীপে। এ দ্বীপের আশপাশে তাপমাত্রা কম থাকলেও দ্বীপটি থাকছে দিন-রাতই উত্তপ্ত। ভবনগুলো তৈরির উপাদানগুলো তাপনিরোধী নয়, গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে। বিল বা জলাশয় দখল ও দূষণে বিপর্যস্ত। এর ফলে তাপ জমা হচ্ছে, যার প্রভাব এখনই দেখা যাচ্ছে। আগামী দিনগুলোয় পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনবে।
ঢাকায় জলাভূমি কমে যাওয়া এবং গাছপালা কম থাকায় গরমের অনুভূতি প্রকৃত তাপমাত্রার চেয়ে বেশি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় কার্যালয় আগারগাঁওয়ে অবস্থিত। সেখানে ঢাকা শহরের অন্যান্য স্থানের তুলনায় জলাভূমি ও গাছপালা বেশি। ফলে ঢাকার যেকোনো স্থানের তুলনায় সেখানে কম তাপমাত্রা অনুভূত হয়। কিন্তু আগারগাঁওয়ের কাছে ফার্মগেট ও কারওয়ান বাজারের তাপমাত্রা সেখানকার চেয়ে ২ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সমীক্ষা অনুযায়ী, ১৯৯৯ সালে ঢাকা শহরের ৬৫ শতাংশ কংক্রিট বা অবকাঠামোয় আচ্ছাদিত ছিল। ২০১৯ সালে তা বেড়ে হয় প্রায় ৮২ শতাংশ। এ সময়ে জলাশয় ও খোলা জায়গা প্রায় ১৪ থেকে কমে ৫ শতাংশের নিচে নেমেছে। যে কারণে ঢাকার তাপমাত্রা দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বেশি থাকছে। ঢাকা শহরের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এখানে এত গরম হওয়ার কথা নয়। কারণ এখানে ছয়টি নদী, শতাধিক খাল ও অসংখ্য জলাশয় ছিল। ফলে তাপমাত্রা বেশি হলে এখানে অভ্যন্তরীণভাবে জলীয় বাষ্প তৈরি হয়ে মেঘ সৃষ্টি হতো। প্রাকৃতিক উপায়ে তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত হতো। কিন্তু সব জলাভূমি ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় এখন শহরে ভবনের ভেতর শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বা এসি ছাড়া অন্য কোনো উপায়ে তাপমাত্রা কমানো যাচ্ছে না। এসি ব্যবহারের ফলে তাপমাত্রা আরো বাড়ছে।
ঢাকা এখনো পুনর্গঠনমুখী। ঢাকার উন্নয়নের ৩০ শতাংশ গত ৩০-৪০ বছরে হয়েছে। অর্থাৎ ঢাকার অবকাঠামো সাময়িক উন্নয়ন দিয়ে ভরাট হয়ে আছে। এখনো সম্ভাবনা রয়েছে। জাপান আকারে বাংলাদেশের তুলনায় প্রায় তিন গুণ বড় হলেও দেশটির ২০ শতাংশ জমি ব্যবহারযোগ্য। অন্যদিকে বাংলাদেশের জনসংখ্যা জাপানের চেয়ে কিছুটা বেশি হলেও ব্যবহারযোগ্য জমির পরিমাণ দেশের প্রায় ৭০ শতাংশ। নগর পরিকল্পনা ও তদারকির সঙ্গে যুক্ত কর্তৃপক্ষকে সজাগ হতে হবে। দুঃখজনক বিষয় হলো, এমন একটা ব্যবস্থা তারা করতে পারে না, যেটা মানুষ মানতে বাধ্য হয়। জার্মানিতেও কেউ কারো কাজ করে দিচ্ছে না। বরং সবাইকে আইন মানতে বাধ্য করা হয়। বাসার সুনির্দিষ্ট উপকরণ না থাকলে বাসাই তৈরি করতে দেয়া হয় না। বাংলাদেশেরও তেমন ব্যবস্থা রয়েছে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সেটা বাস্তবায়ন করা যায় না। মহানগরকে রক্ষায় জলাশয় নির্মাণ ও পুনরুদ্ধার, পার্ক নির্মাণ, কেমন জমিতে কেমন ভবন তৈরি করা যাবে, কী পরিমাণ গাছ লাগাতে হবে, এমনকি ভবন তৈরির উপকরণও নির্দিষ্ট করে দেয়া এবং সেটি বাস্তবায়নে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
একটি নগরে স্থাপনা থাকবেই। তার সঙ্গে সবুজ ২৫ ভাগ এবং ওয়াটার বডি ১৫ ভাগ; মোট ৪০ ভাগ জায়গা ছেড়ে দিতে হবে। এক গবেষণায় দেখা গেছে, ঢাকার মোট ভূমির ৮০ শতাংশ কংক্রিটে আচ্ছাদিত। ফলে এখানে তাপমাত্রা কমানো যায় না। সবুজ ও ওয়াটারবডি থাকলে ৩-৪ ডিগ্রি তাপ কমে যেত। বাংলাদেশের পরিবেশ বিবেচনা না করে একের পর এক এয়ার টাইট উঁচু উঁচু ভবন তৈরি করা হচ্ছে। ভবনগুলো কাচে আচ্ছাদিত। এগুলো উল্টো তাপ উৎপাদন করে। আবার যেসব নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করা হয় তা-ও তাপ উৎপাদন করে। এসব কারণে গ্রাম ও শহরের তাপমাত্রায় ২-৩ ডিগ্রি পার্থক্য থাকে। কারণ গ্রামে গাছপালা আছে, জলাশয় আছে। ঢাকা শহরে অপরিকল্পিত নগরায়ণ হয়েছে। ফলে তাপমাত্রা বেশি অনুভূত হয়। আর পরিবেশ দূষণ তো আছেই। নগর পরিকল্পনায় যদি পর্যাপ্ত গাছপালা, জলাশয় যোগ করা যায়, পরিবেশের উপযোগী করে যদি ভবন নির্মাণ করা যায়, তাহলে তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি পর্যন্ত কমানো যায়। শুধু গাছপালা বা জলাধার থাকলেই পরিবেশ ভালো হবে, তা কিন্তু না। এটি কোনো একক বিষয় না। রাজধানী ঢাকায় জনসংখ্যার পরিমাণ ধারণক্ষমতার চেয়েও বেশি। এখানে যথাযথ নগর পরিকল্পনা প্রয়োজন। দাবদাহসহ যেকোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় ঘাটতি রয়েছে। কোনো দুর্যোগ এলে বিষয়গুলো নিয়ে হইচই হয়। কিন্তু পরে সেগুলো আর বিবেচনায় থাকে না।
এম এম মুসা: সহযোগী সম্পাদক, বণিক বার্তা