পোশাক শিল্পে ‘সামর্থ্যের ফাঁদ’

বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তিপ্রস্তর, পোশাক শিল্প, এ মুহূর্তে সুস্পষ্টভাবে একটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। সেটি হলো কিছু পণ্য উৎপাদনে অতিরিক্ত সামর্থ্য অর্জন। এসব পণ্যের ক্ষেত্রে অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ এবং

বাংলাদেশের অর্থনীতির ভিত্তিপ্রস্তর, পোশাক শিল্প, এ মুহূর্তে সুস্পষ্টভাবে একটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে। সেটি হলো কিছু পণ্য উৎপাদনে অতিরিক্ত সামর্থ্য অর্জন। এসব পণ্যের ক্ষেত্রে অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ এবং অতিরিক্ত সামর্থ্য অর্জন শিল্পের জন্য একটি বড় ফল্ট লাইন তৈরি করেছে। আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে, শিল্পটি প্রধানত তিনটি প্রধান পণ্যের (টি-শার্ট, ট্রাউজার ও সোয়েটার) মধ্যেই কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে এবং এ পণ্যগুলোয় কয়েক দশক ধরে ব্যাপক বিনিয়োগ হয়ে একটি ক্যাপাসিটি ট্র্যাপ বা সামর্থ্যের ফাঁদ তৈরি হয়েছে।

  • এই ক্যাপাসিটি ট্র্যাপ তৈরির সূচনা ঘটেছিল শিল্পের প্রথম দিকের দিনগুলোয়। বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় মাল্টি-ফাইবার অ্যারেঞ্জমেন্টের (এমএফএ) আওতায় কোটা সুবিধা, ২০০৪ সালের শেষাবধি যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের পোশাকের জন্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করে। কোটা বিলুপ্তির পর চাহিদায় একটি বড় ধরনের ছন্দপতন ঘটবে, এ রকম একটি আশঙ্কা থেকে কারখানাগুলো নতুন বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থায় শুল্কের ওপর প্রভাব বিবেচনায় নিয়ে সুনির্দিষ্ট কোটা বিভাগে সামর্থ্য ও সক্ষমতা আরো বাড়িয়েছে, যা শিল্পকে ধীরে ধীরে অতিরিক্ত ঘনীভূত পরিস্থিতির দিকে নিয়ে গেছে।
  • শিল্পের একটি প্রধানতম দুর্বলতা হচ্ছে ওভারক্যাপাসিটি, যা দরকষাকষির সক্ষমতায় এবং দরকষাকষির আলোচনায় প্রস্তুতকারীদের সামর্থ্য কমিয়ে দেয়। কারখানাগুলো তখন টিকে থাকার লড়াইয়ে মার্জিন কমিয়ে কম মূল্যের অফারগুলো গ্রহণ করার মাধ্যমে বিদ্যমান সক্ষমতা ব্যবহারের ওপর অগ্রাধিকার প্রদান করে এবং সীমিত পরিসরের মধ্যে উচ্চ মূল্যের পণ্যগুলোকে আটকে রাখে। এ প্রবণতা শিল্পে একটি দুষ্টচক্র তৈরি করেছে; কম মূল্য মৌলিক পোশাকের অর্ডার আরো ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করেছে, যা প্রকারান্তরে ওভারক্যাপাসিটি ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বাড়িয়ে দিচ্ছে। ওভারক্যাপাসিটি কারখানাগুলোর মধ্যে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, এর ফলে পণ্যের মূল্য কমে যায়।
  • এটি প্রতীয়মান যে মৌলিক পোশাক পণ্যগুলোর অর্ডারের সহজলভ্যতার পাশাপাশি কারখানাগুলোর উদ্ভাবনে বিনিয়োগ এবং জটিল পণ্যগুলোয় কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়ে উৎসাহের অভাব রয়েছে। এখন পর্যন্ত সম্ভাবনাময় অনাবিষ্কৃত ক্ষেত্রগুলো অনুসন্ধান এবং প্রবৃদ্ধির পথগুলো এড়িয়ে যাওয়ার প্রবণতা, বিশ্ববাজারের পণ্য বিভাগগুলোয় বাংলাদেশের অগ্রগতিকে সীমাবদ্ধ রেখেছে, এটিকে মূল্য গ্রহণকারী করে তুলেছে।
  • বাংলাদেশের পোশাক শিল্পে ওভারক্যাপাসিটি দিন দিন বাড়ছে, যা এরই মধ্যে শিল্পের দীর্ঘমেয়াদি প্রতিযোগী সক্ষমতা ও প্রবৃদ্ধির জন্য হুমকি তৈরি করেছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য এবং শিল্পের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়তে একটি বহুমুখী পদ্ধতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যার মধ্যে কৌশলগত পরিকল্পনা এবং সক্রিয় হস্তক্ষেপ উভয়ই অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
  • সবচেয়ে আগে যে পদক্ষেপ নেয়া অপরিহার্য, সেটি হলো একটি ব্যাপক জাতীয় ক্যাপাসিটি ম্যাপিং অনুশীলন। এর মধ্যে থাকবে শিল্পজুড়ে বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে কারখানাগুলোর সামর্থ্যের তথ্য সংগ্রহ করা, বিনিয়োগের ধরন বিশ্লেষণ ও সম্ভাব্য ঘাটতিগুলো চিহ্নিত করা। এ জ্ঞানসহকারে সরকারসহ শিল্পের অংশীজনরা সময়োপযোগী সঠিক বিনিয়োগের সুবিধার্থে লক্ষ্যযুক্ত কৌশলগুলো নির্ধারণ করতে পারে। এভাবে প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে শিল্পের সামর্থ্য বাড়ানো নিশ্চিত করে।
  • বাংলাদেশ কম মূল্যের উৎপাদনে আটকে থাকার সামর্থ্য রাখে না; মজুরি গতিশীলতা এবং সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রবণতা এ ধরনের ‘গতানুগতিক ব্যবসা’ পরিস্থিতিকেও সমর্থন করে না। অটোমেশন ও রোবোটিকসের মতো অত্যাধুনিক প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে দক্ষতা বাড়াতে পারে, উৎপাদন খরচ কমাতে পারে এবং পণ্যের গুণমান উন্নত করতে পারে। ডেডিকেটেড উদ্ভাবন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা এবং (গবেষণা ও উন্নয়ন) আরঅ্যান্ডডি উৎসাহিত করা প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে আরো ত্বরান্বিত করবে।
  • যেকোনো সফল শিল্পের অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে একটি দক্ষ ও অভিযোজিত কর্মী বাহিনী। দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিকে মৌলিক সেলাই এবং মেশিন পরিচালনার দক্ষতার বাইরে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত করে এতে ডিজাইন, মান নিয়ন্ত্রণ ও উন্নত উৎপাদন কৌশলগুলোর মতো ক্ষেত্রগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি। এ কর্মসূচিগুলো এমনভাবে সাজাতে হবে, যাতে কর্মীরা জটিল উৎপাদন প্রক্রিয়াগুলো পরিচালনা ও উচ্চ মানের পণ্য উৎপাদন করতে প্রয়োজনীয় দক্ষতা অর্জন করতে পারে।
  • সরকারেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। আরঅ্যান্ডডি ও দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচিতে বিনিয়োগের জন্য কর সুবিধা বা ভর্তুকি প্রদান বৈচিত্র্যকরণ এবং উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করতে পারে। উপরন্তু প্রযুক্তি গ্রহণ ও দক্ষতা বৃদ্ধির উদ্যোগ গ্রহণের জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান করা হলে কারখানাগুলো কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে সমর্থ হবে।
  • যদিও এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন নিঃশর্ত নগদ প্রণোদনার ক্ষেত্র সীমাবদ্ধ করে, তার পরও সমাধান হিসেবে শিল্পে কর সুবিধা, ভর্তুকি প্রদান, এন্টারপ্রাইজভিত্তিক দক্ষতা প্রশিক্ষণ কর্মসূচি প্রভৃতি ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন রয়েছে। সুস্পষ্টভাবে বাজারের সুযোগ রয়েছে এবং অর্থনীতিতে উচ্চ মূল্য যোগ করতে পারে এমন ধরনের কাঙ্ক্ষিত পণ্য বিভাগে বিনিয়োগ করতে হবে, যাতে ডব্লিউটিও অনুমোদিত পদ্ধতিতে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে সরকার সহায়তা দান করবে।
  • ওভারক্যাপাসিটি কোনো অপ্রতিরোধ্য চ্যালেঞ্জ নয়। শিল্পের অংশীজন, নীতিনির্ধারক এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পৃক্ত করে একটি সহযোগিতামূলক প্রচেষ্টা গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক শিল্প এ ওভারক্যাপাসিটি ফাঁদ থেকে মুক্ত হতে পারে এবং একটি টেকসই ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে পারে। শিল্পে উদ্ভাবনকে উৎসাহিতকরণ, প্রযুক্তি গ্রহণ, পণ্যের পোর্টফোলিওতে বৈচিত্র্য আনয়ন, কর্মীদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সরকারি সহায়তা লাভ করে বাংলাদেশ তার পোশাক শিল্পকে পরবর্তী দশকের জন্য একটি গতিশীল ও প্রতিযোগিতামূলক উদ্যোগে রূপান্তর করতে পারে।

মো. মহিউদ্দিন রুবেল: বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক

আরও