বাজেট সবসময় সরকারের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দলিল হিসেবে বিবেচিত হলেও নতুন শতকের আগে বাজেট প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন প্রায় পুরোপুরিই সরকারি কর্মকর্তাদের করায়ত্ত ছিল। অর্থ বিভাগের পদস্থ কর্মকর্তারাই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে সঙ্গে নিয়ে কিংবা কিছু সময় বাজেট বক্তৃতা রচনা বা বাজেট দলিলের বিন্যাসের জন্য দু-একজন উপদেষ্টা বা পরামর্শক নিয়ে বাজেট দলিলটি তৈরি বা সংসদে উপস্থাপনের জন্য প্রস্তুত করতেন। মরহুম অর্থমন্ত্রী শাহ কিবরিয়া অর্থ মন্ত্রণালয়ের একটি পরামর্শক পরিষদ মনোনীত করে মূলত তাদেরসহ কয়েকজন সমমনাদের নিয়ে প্রাক-বাজেট আলোচনা শুরু করলেও মূলত এই শতকের শুরুতে মরহুম অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান কিছুটা বৃহৎ পর্যায়ে বাজেটকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের নিয়ে প্রাক-বাজেট আলোচনা বিস্তৃত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কথিত আছে, তিনি ব্যবসায়ী ও সুধীজনদের সঙ্গে প্রাক বাজেট আলোচনা ছাড়াও ট্রেনে করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে মৌলভীবাজারে নিজ গৃহে গিয়ে অর্থবিলের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা করতেন। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত এই প্রাক-বাজেট আলোচনাকে অনেক বিস্তৃত করেন এবং বিভিন্ন অংশীজনের সুপারিশকে আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনায় নেয়ায় সচেষ্ট ছিলেন। তার পরও বাজেট নিয়ে আলোচনা বা বাজেট প্রাধিকার নির্ণয়ের বিষয়টি মূলত সরকারি কর্মকর্তা, অর্থমন্ত্রী এবং কিছু দিকনির্দেশনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। সংসদে বা সংসদের বাইরে কার্যকরভাবে কখনো বাজেটের প্রাধিকার, বরাদ্দ বা কার্যকরণ নিয়ে বৃহৎ আলোচনা হয় না। এমনকি এ বিষয়ে কোনো আইনি বাধ্যবাধকতাও নেই। অনেক ক্ষেত্রে কাঠামোগত বিন্যাসের ক্ষেত্রে অংকের গরমিল বা একই ভুল বছরের পর বছর চলতে থাকে কিংবা বাজেটের স্বচ্ছতা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উত্থাপিত হয় না।
সাধারণত স্বচ্ছতা, জনসাধারণের অংশগ্রহণ ও তদারকি—এ তিনটি বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে গণতান্ত্রিক বিশ্বে একটি সরকারের বাজেটের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়। আন্তর্জাতিক সমীক্ষা বলছে, বাজেটের জবাবদিহিতা নিশ্চিতে বাংলাদেশের অবস্থান সুখকর নয়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যেও বাংলাদেশের অবস্থান সবার পেছনে।
২০০৬ সাল থেকে প্রতি দুই বছর পর বিশ্বের শতাধিক দেশের বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন নিয়ে জরিপ চালিয়ে আসছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল বাজেট পার্টনারশিপ। বিশ্বের ছয়টি মহাদেশের ১১৭টি দেশের বাজেটের ওপর ‘ওপেন বাজেট সার্ভে’ চালিয়ে প্রতিষ্ঠানটি যে চিত্র দিয়েছে, তা বাংলাদেশের জন্য বেশ হতাশার। এক্ষেত্রে ১১৭টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭৯তম।
আগেই বলেছি বাজেটের জবাবদিহিতা নিশ্চিতের মৌলিক তিনটি স্তম্ভের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন। ২০১৯ সালে এতে ১০০-তে বাংলাদেশ পেয়েছে মাত্র ৩৬। এক্ষেত্রে আফগানিস্তানের নম্বর ৫০, ভারতের ৪৯, নেপালের ৪১, পাকিস্তানের ৪৪ এবং শ্রীলংকার ৪৭। ‘ওপেন বাজেট সার্ভের’ প্রাপ্ত নম্বরের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বৈশ্বিক গড়ের তুলনায়ও কম। এক্ষেত্রে বৈশ্বিক গড় হলো ৪২।
জরিপের ফল বলছে, গত কয়েক বছরে বাজেটের জবাবদিহিতা নিশ্চিতে বাংলাদেশের অবস্থানের ধারাবাহিক অবনমন হয়েছে। ২০১৫ সালে ওপেন বাজেট সার্ভেতে বাংলাদেশের প্রাপ্ত নম্বর ছিল ৫৬। ২০১৭ সালে এটি ৪১-এ নেমে আসে।
ইন্টারন্যাশনাল বাজেট পার্টনারশিপ বলছে, একটি সরকারের বাজেটের স্বচ্ছতা আটটি সমায়োপযোগী ও বিস্তৃত দলিল প্রকাশের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। এগুলো হলো প্রাক-বাজেট বিবৃতি, নির্বাহীর বাজেট প্রস্তাব, প্রণীত বাজেট, নাগরিক বাজেট, বার্ষিক প্রতিবেদন, মধ্যমেয়াদি পর্যালোচনা, বছরের শেষ প্রতিবেদন এবং নিরীক্ষা প্রতিবেদন। এসব দলিলের ওপর ভিত্তি করে একটি দেশের বাজেটের স্বচ্ছতা প্রকাশ পায়। এছাড়া বাজেটের তদারকি, আইনসভা, জাতীয় নিরীক্ষা অফিস এবং স্বতন্ত্র আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মতো আনুষ্ঠানিক তদারকি সংস্থাগুলোর ভূমিকা এবং কার্যকারিতার ওপর ভিত্তি করেই বাজেটের জবাবদিহিতা নিশ্চিত হয়।
সরকার কোন পন্থায় জনগণ থেকে অর্থ সংগ্রহ করবে এবং কী পন্থায় সংগৃহীত অর্থ ব্যয় হবে, সেটি একটি গণতান্ত্রিক দেশের নাগরিকদের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক নির্ধারণে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জনসম্পদ একত্রীকরণ ও ব্যয়ের প্রক্রিয়াই হলো বাজেট। আর বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মূল বিবেচ্য হলো জনগণের অংশগ্রহণ। এ বিবেচনায় ২০১৯ সালে বাংলাদেশের বাজেট পেয়েছে ১০০ নম্বরের মধ্যে মাত্র ১৩। জনগণের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে আছে নেপাল, এক্ষেত্রে দেশটির প্রাপ্ত নম্বর ২২। শ্রীলংকা ১৭ আর আফগানিস্তান ১৫ নম্বর পেয়েছে। তবে কিছুটা আশার ব্যাপার হলো, বাজেট প্রণয়নে জনগণের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়েও খারাপ পরিস্থিতি ভারত ও পাকিস্তানের।
বাংলাদেশের বাজেট ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সরকারের বাইরের অংশীজনরা প্রায়ই তিন মাস অন্তর প্রাধিকার বিবেচনায় বাজেটের ব্যবহার নিয়ে সংসদে রিপোর্ট পেশসহ সামগ্রিক বাজেট প্রণয়ন ও বরাদ্দের কার্যকরণে ন্যূনতম স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার কথা বলে আসছেন এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় সংসদ ও বিভিন্ন জনপ্রতিনিধিকে আরো সম্পৃক্ত করার ওপর জোর দিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে সত্যিকারের পরিস্থিতি খুব একটা এগিয়েছে বলে অনেকেই মনে করেন না। এমনকি প্রাক-বাজেট আলোচনায় সুপারিশমালায়ও গুণগত পরিবর্তন অনুপস্থিত। যারা বছরের পর বছর প্রাক-বাজেট আলোচনায় অংশ নিচ্ছেন, তাদেরও বেশির ভাগের কোনো পূর্বপ্রস্তুতি লক্ষণীয় নয়। অর্থ বিভাগ থেকেও বাজেট সুপারিশকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় ঘাটতি লক্ষণীয়।
মামুন রশীদ: অর্থনীতি বিশ্লেষক