মহান মুক্তিযুদ্ধের গৌরবোজ্জ্বল বিজয়ের পর বাংলাদেশের অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য বলতে উঠে আসত জনসংখ্যার ঘনত্ব, চরম দারিদ্র্য ও দীর্ঘস্থায়ী অপুষ্টি। যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন ও অবকাঠামো বিনির্মাণ ছিল একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছিল ভারত থেকে ফিরে আসা ৮-১০ মিলিয়ন মানুষের পুনর্বাসন, যারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী এবং তার দোসরদের অত্যাচার ও নির্যাতন এড়াতে শরণার্থী হয়েছিল।
১৯৭০-এর নভেম্বরে এ অঞ্চলে আঘাত হেনেছিল এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। এতে আড়াই লাখের মতো মানুষ প্রাণ হারায়। নতুন দেশটিকে এ ঘূর্ণিঝড় থেকে পুনরুদ্ধারের বিশাল কাজও করতে হচ্ছিল। ছিল খাদ্যশস্য ও অন্যান্য ত্রাণসামগ্রীর তীব্র সংকট। অভিজ্ঞ উদ্যোক্তা, ব্যবস্থাপক, প্রশাসক, প্রকৌশলী বা প্রযুক্তিবিদ ছিলেন মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন। ঠিক সে সময়ে অপর্যাপ্ত সরবরাহ এবং সিন্থেটিক শিল্পের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণে দেশের অন্যতম অর্থকরী ও রফতানি পণ্য পাটের বৈশ্বিক বাজারও মন্দা। যৎসামান্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ও প্রাকৃতিক গ্যাস ছাড়া কোনো শিল্পের অস্তিত্বই ছিল না। উপরন্তু সড়ক ও রেলপথসহ পুরো অবকাঠামো ব্যবস্থাই ভেঙে পড়েছিল।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানি শিল্প মালিকরা তাদের কল-কারখানা ফেলে চলে গেলে বাংলাদেশ সরকারের হাতে পশ্চিম পাকিস্তানি মালিকদের প্রায় ৩০০টি ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এসে পড়ে, যা ছিল দেশের মোট শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রায় ৯০ শতাংশ। সরকার গুরুত্বপূর্ণ শিল্পগুলো দেখভালের জন্য পাবলিক করপোরেশনগুলো ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেয়। তখন শিল্পের পুনর্বাসন ও উন্নয়নের পথনকশা প্রণয়নের জন্য পরিকল্পনা কমিশনই ছিল একমাত্র প্রতিষ্ঠান। এ কমিশনের সুপারিশে সরকার পাঁচ বছরের জন্য অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করে স্বাধীনতার এক বছর বিরতির পর প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (জুলাই ’৭৩-জুন ’৭৮) গৃহীত হয়। পরবর্তী সময়ে এর ওপর ভিত্তি করে একটি দ্বিবার্ষিক (১৯৭৯-৮০) পরিকল্পনাও গ্রহণ করা হয়। এরপর এক বছর এমনিতে কাটিয়ে দিয়ে আগের ধারাবাহিকতায় দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৮১-৮৫) এবং তৃতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (১৯৮৫-৯০) গ্রহণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে চতুর্থ (১৯৯০-৯৫), পঞ্চম (১৯৯৭-২০০২), এর মাঝে দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র ও ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১১-১৫) বাস্তবায়ন হয়। সপ্তম (২০১৬-২০) পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার ব্যাপক উদ্দেশ্য ছিল দারিদ্র্য হ্রাস, জনসংখ্যা বৃদ্ধির উচ্চহার কমিয়ে আনা, বৈদেশিক রফতানি বৃদ্ধি এবং দেশজ সঞ্চয়, খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন এবং মোট দেশজ উৎপাদনের বার্ষিক প্রবৃদ্ধি অর্জন। এ উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যগুলোর অর্জন অতীতের তুলনায় ভালো।
গত ৫২ বছরে বাংলাদেশ প্রবৃদ্ধি এবং উন্নয়নের এক অনন্য মাইলফলক স্পর্শ করেছে। ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ থেকে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের সব মানদণ্ড পূরণ করেছে। ২০২০ সালে দেশের জনসংখ্যা ছিল ১৬৮ দশমিক ৩১ মিলিয়নেরও বেশি এবং মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় ছিল ১ হাজার ৯৪০ ডলার (২০১৯)। মানব উন্নয়ন সূচকে ১৮৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৫তম।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশ সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি উভয় ক্ষেত্রেই মিশ্র উন্নয়নের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। ১৯৮০-এর দশকের শেষ পর্যন্ত সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকটের পটভূমিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার একটি ভিত্তি সূচিত হয়। যে ধারাবাহিকতায় ১৯৯০-এর দশকের শুরুতে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরে আসতে শুরু করে। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের অর্থনীতি ১৯৯০-এর দশকে গড় জিডিপি বৃদ্ধির হার ৪ দশমিক ৮ শতাংশ দাঁড়ায়, যা আগের দশকে অর্জিত প্রবৃদ্ধির (৩ দশমিক ৮ শতাংশ) ১ শতাংশের বেশি। এত চিত্তাকর্ষক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২০০৭-০৮ পর্যন্ত বহু বছর ধরে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে সর্বনিম্ন এবং স্বল্পোন্নত দেশগুলোর গড় মাথাপিছু আয়ের থেকেও কম ছিল।
সত্তরের দশকের সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকটের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি বরাবরই কঠিন পরিস্থিতি পার করছিল। অধিকন্তু একসঙ্গে দুটি ধাক্কা সাফল্যকে হুমকির মুখে ফেলে দেয়। প্রথমত, রাজস্ব ঘাটতি এবং দ্বিতীয়ত, ব্যালান্স অব পেমেন্ট পরিস্থিতির অধোগতি। এ দুটি ঝুঁকি বাংলাদেশের আর্থিক খাতে অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা প্রকাশ করে। প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশে অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য সংস্কার ব্যবস্থা গৃহীত হওয়ায় অর্থনীতির আন্তঃখাতগুলোর মধ্যে, বিশেষ করে কৃষির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে শিল্প খাত নব্বই দশকে চমৎকার প্রবৃদ্ধি প্রদর্শন করে। প্রকৃতপক্ষে ১৯৯০-এর দশক থেকেই সেবা খাতের তুলনায় কৃষি ও শিল্প খাত জিডিপির প্রধান উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়। পরবর্তী সময়ে গুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে সেবা খাত জিডিপিতে একটা উল্লেখযোগ্য স্থান দখল করে নেয়।
উন্নত প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও টেকসই প্রবৃদ্ধি এবং আয়ের ন্যায্য বণ্টনের বিপরীতে বাংলাদেশের অর্থনীতি আধুনিক শিল্পায়নের দিকেই বেশি ঝুঁকে পড়ছে। দেশীয় কাঁচামালের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান কাঠামোগত বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। যদিও ১৯৭৮ থেকে ২০২০ অর্থবছরে জিডিপিতে রাজস্বের অবদান (কর ও কর-বহির্ভূত একসঙ্গে) ৭ দশমিক ৫ থেকে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু অনেক উন্নয়নশীল দেশের তুলনায় এ অনুপাত খুবই সীমিত।
১৯৯০-এর দশকের গোড়ার দিকে ভ্যাট ব্যবস্থার প্রবর্তন রাজস্ব খাতের এক নতুন দুয়ার উন্মোচন করেছে। বিশেষ করে দেশীয় উৎপাদনের ক্ষেত্রে আয়করের তুলনায় ভ্যাট রাজস্ব আয়ের একটি বড় উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। ২০০৭ থেকে ২০১২ সালের মধ্যে এনবিআরের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে অসাধারণ সাফল্যের জন্যই এটি সম্ভব হয়েছে। কর-বহির্ভূত রাজস্বের সবচেয়ে বড় অংশ অর্থাৎ ১৫-২০ শতাংশ আসে অর্থনীতির দেশীয় খাত থেকে। যেমন স্থানীয় শিল্প উদ্যোগ, ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি ইত্যাদি।
রাজস্ব ও মুদ্রানীতি উভয়ই বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশের আর্থিক কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে বহুল ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সরকারের চাহিদা অনুসারে বাংলাদেশ ব্যাংক অর্থ সরবরাহ এবং সুদের হার নিয়ন্ত্রণের জন্য মুদ্রানীতি প্রণয়ন করে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বিকল্প হিসেবে মোট প্রকৃত দেশীয় উৎপাদন (আর জিডিপি) ব্যবহৃত হয়ে এলেও বিনিময় হার, সুদের হার, মুদ্রাস্ফীতির হার, সরকারি রাজস্ব এবং সরকারি ব্যয় উল্লেখযোগ্য নীতিগত সূচক হিসেবে বিবেচিত হয়। বিভিন্ন বছরে এ সূচকগুলো বিভিন্ন মাত্রায় ওঠানামা করে। কিন্তু লক্ষ করা গেছে, মোট প্রকৃত দেশীয় উৎপাদনের সঙ্গে ন্যারো মানি, ব্রড মানি, বিনিময় হার এবং রাজস্ব ও সরকারি ব্যয়ের ইতিবাচক সম্পর্ক রয়েছে। অর্থাৎ একক বৃদ্ধির এ পরিবর্তনে জিডিপিও কিছুটা বৃদ্ধি পায়। অন্যদিকে জিডিপিতে মুদ্রাস্ফীতি এবং সুদের হার নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা ১ শতাংশ সম্ভাবনার স্তরে উল্লেখযোগ্য। মুদ্রানীতির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হলো রিজার্ভের পরিবর্তনশীলতার নিম্নহার, ক্রেডিট বরাদ্দে নমনীয়তা এবং কম মার্জিন নির্ধারণ।
সরকার কর্তৃক প্রণীত করনীতি এবং মুদ্রানীতি সমাজের বৈষম্য কমাতে যথেষ্ট সময়োপযোগী ছিল না। অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বিভিন্ন অব্যাহতি এবং ছাড়, সুদে প্রদত্ত কর সুবিধাগুলো, পরোক্ষ করের ওপর উচ্চনির্ভরতা এবং স্বাস্থ্য, শিক্ষার পাশাপাশি অন্যান্য সামাজিক খাতে বিনিয়োগ সরকারকে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনে সামান্যই সাহায্য করতে পারে। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় লক্ষ করা গেছে যে বৈষম্য সর্বকালের উচ্চতায় পৌঁছেছে, যা অর্থনৈতিক সাম্যের পথে প্রধান বাধা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এটি দেশের বহুল প্রশংসিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুবিধার সুষম বণ্টনকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ২০২০ সালে কভিড-১৯ পূর্বকালে অনুমিত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ।
রাজস্বের আকার বৃদ্ধির জন্য উচ্চ সুদের সঙ্গে আরো সরকারি বন্ড বিক্রি করে অর্থপ্রবাহ ঠিক রাখা হয়। এটি শুরুতে বিনিয়োগ এবং পরবর্তী সময়ে আউটপুট বৃদ্ধিকে স্তিমিত করে দেয়। কিন্তু এর ফলে বেশ কয়েক বছর ধরে থেমে থাকা প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি এক বছরের পর বৃদ্ধি পায়। উৎপাদকদের মুনাফা প্রণোদিত মূল্যনীতির কারণে সাধারণভাবে দামের স্তরে প্রভাব পড়ে। অন্যদিকে এটি আর্থিক সংকোচন প্রভাবের আউটপুট হ্রাস করে। সিমুলেশন স্টাডিতে আরো দেখা যায়, একটি সীমাবদ্ধ মুদ্রানীতি প্রকৃত জিডিপি এবং মূল্যের মাত্রা হ্রাস করে, কিন্তু ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্যমান বৃদ্ধি করে।
যা-ই হোক, নন-পলিসি ভেরিয়েবল, যেমন প্রকৃত জিডিপি, মূল্যস্তর এবং বিনিময় হারের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অর্থ সরবরাহ এবং কর রাজস্বে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। বাংলাদেশের মুদ্রাবাজারের লেনদেন আগের চেয়ে আরো সংহত হওয়া প্রয়োজন। যাতে সরকারি মুদ্রানীতিকে আরো কার্যকর করা যায়। অন্যদিকে সরকার তার কর রাজস্ব এবং মূলধন ব্যয়কে আরো বিচক্ষণতার সঙ্গে পরিচালনার মাধ্যমে তার আর্থিক নীতিকে আরো কার্যকরী করতে পারে।
স্বাধীনতার পর থেকেই আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশকে সাহায্যনির্ভর দেশ হিসেবে দেখে। এরই ধারাবাহিকতায় অক্টোবর, ১৯৭৪-এ বিশ্বব্যাংকের অধীনে ‘বাংলাদেশ এইড গ্রুপ’ গঠন করা হয়। এর অংশগ্রহণকারী দেশ ২৬টি। এই কনসোর্টিয়াম গঠনের পরই প্রাথমিক বছরগুলোয় বাংলাদেশে সাহায্যপ্রবাহের হার বেড়ে যায়। ১৯৮০-এর দশকে খাদ্য সহায়তার মূল্য (বেশির ভাগ অনুদান হিসেবে দেয়া) প্রতিশ্রুতির প্রায় ১১ থেকে ১৮ শতাংশে নেমে আসে। এর মধ্যে ২৫ শতাংশ ছিল পণ্য সহায়তা যা সে সময়ের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য খুব জরুরি ছিল। এসব উপাদানের মধ্যে ছিল সার, সিমেন্ট, ইস্পাত, পাম্প ও অন্যান্য যন্ত্রপাতি। প্রতিশ্রুতির ৫০ শতাংশেরও বেশি জুড়ে ছিল প্রকল্প সহায়তা। বৈদেশিক সাহায্যের এ রূপরেখা বড় বড় দাতাকে আকৃষ্ট করে। কারণ নীতিগত উদ্দেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে তহবিলগুলো কাজ করছিল। বাংলাদেশ সরকারের অব্যাহত প্রচেষ্টার ফলে বার্ষিক তহবিলের পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। শুধু সময়মতো বিতরণ বা ব্যবহার না হওয়ায় এ তহবিলের বার্ষিক আয়তন ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে।
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে উন্নয়ন বাজেটের একটি বড় অংশের অর্থায়ন হয়েছিল বৈদেশিক দাতাদের মাধ্যমে। এজন্য বাংলাদেশ সরকারকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে প্রকল্পগুলোর জন্য অর্থায়ন আকর্ষণ করতে হচ্ছিল। বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশ এইড গ্রুপের নেতা হিসেবে প্রতি বছর বাংলাদেশে দাতাদের বৈঠক আয়োজন করে। এ সভাগুলোয় অন্য অনেক সমস্যার মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা, যাদের সম্পদ নেই তাদের উৎপাদনশীল কর্মসংস্থান প্রদান, নারীদের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য-পুষ্টি এবং জনসংখ্যা কর্মসূচির সামাজিক ও অর্থনৈতিক অপ্রতুলতা দূর করার ওপর সবচেয়ে বেশি গুরুত্বারোপ করা হয়। বাংলাদেশে দ্বিতীয় বৃহত্তম দাতা গ্রুপ এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি), যার প্রায় অর্ধেক তহবিল কৃষি ও কৃষি শিল্পে বিনিয়োগ করা হয়। এডিবি পরিবহন অবকাঠামো (স্থানীয় বাজার যোগাযোগ, অভ্যন্তরীণ জলপথ ও রেলপথ) এবং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষার জন্য সামাজিক কল্যাণ প্রকল্প নিয়ে কাজ করছে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি তার নিজস্ব উন্নয়ন প্রকল্প পরিচালনা করে এবং অন্যান্য এজেন্সির কার্যক্রমকে সমন্বয় করে, যার মধ্যে রয়েছে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, জাতিসংঘ শিল্প উন্নয়ন সংস্থা এবং জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিষয়ক ফান্ড। সাধারণত এ সংস্থাগুলো প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করে। তারা প্রায়ই বাংলাদেশ সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণমূলক এবং উন্নয়ন কাজের প্রভাবক হিসেবে পরামর্শ দিয়ে থাকে। অন্যান্য দাতা এমনকি বাংলাদেশের রাজস্ব থেকে মূলধন ব্যয়ের জন্য প্রয়োজনীয় সুপরিকল্পিত কর্মসূচির ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়। ১৯৮০ দশকের গোড়ার দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় দাতা রাষ্ট্র। একই সময়ে জাপানি সাহায্যও একই মাত্রায় পৌঁছেছিল। তৎকালীন সময়ে বাংলাদেশ বৈদেশিক সহায়তার জন্য মুখিয়ে ছিল। ব্রিটেন, জাপান ও পশ্চিম জার্মানির কর্মসূচি ছাড়াও কানাডা, সুইডেন, ফিনল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, সুইজারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, চীন, ভারত এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ দাতা রাষ্ট্র সহায়তা কর্মসূচির আওতায় বিশেষভাবে বাংলাদেশকে বিবেচনা করেছে।
একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠীর খাদ্য জোগান দেয়ার টেকসই সক্ষমতা; শিল্পের জন্য শক্তি এবং প্রাকৃতিক সম্পদের অভাব সত্ত্বেও বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্ভাবনার ক্ষেত্রে প্রাথমিক হতাশাকে কাটিয়ে উঠেছে। ৫০ বছর আগেও এর অর্থনীতি ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত: পুনর্বাসন এবং পুনর্গঠনের মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। সব বাধা পাশ কাটিয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে এবং সাম্প্রতিক দশকগুলোয় দেশের গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার প্রতি বছর ৭ শতাংশে পৌঁছেছে এবং এ প্রবৃদ্ধি অন্তর্ভুক্তিমূলক (জিইডি, পরিকল্পনা কমিশন, ২০১৫)। এরই মধ্যে বাংলাদেশ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদায় উন্নীত হয়েছে। ২০১৪ সালে মাথাপিছু মোট জাতীয় আয় ছিল যেখানে ১ হাজার ৮০ ডলার তা ২০১৯ সালে ১ হাজার ৯৪০ ডলারে এসে দাঁড়িয়েছে। আর্থসামাজিক সূচকেও বাংলাদেশের সাফল্য ঈর্ষণীয়।
বাংলাদেশের এখন ক্রমবর্ধমান আর্থসামাজিক বৈষম্যের ওপর নজর দিতে হবে। সেই সঙ্গে কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারকে আগামী ৫০ বছরে প্রধান এজেন্ডা হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। আয় ও সম্পদভিত্তিক কর সংগ্রহ জোরদার করা, অর্থনৈতিক বৈচিত্র্য আনার জন্য বেসরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধি এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য কাজ করতে হবে। দেশের সাম্প্রতিক সাফল্যকে আরো টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক করতে পাঁচটি বিষয় বিবেচনার ওপর গুরুত্ব দেয়া যেতে পারে:
১. ভূমি ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বনসহ ক্রয়-বিক্রয় পদ্ধতি ও শর্তাবলি সংস্কার, দারিদ্র্য নিরসনধর্মী সামাজিক ব্যয় বৃদ্ধি ইত্যাদি সহায়ক নীতির মাধ্যমে প্রবৃদ্ধির প্রাগ্রসরমাণতা বজায় রাখতে হবে এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রয়োজনীয় কাঠামোগত এবং সুশাসন ও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠাকল্পে প্রশাসন পদ্ধতিতে সংস্কার সাধন প্রয়োজন।
২. বাণিজ্য শুল্কের সমস্যা চিহ্নিত করে বাণিজ্য কাঠামো আরো বেশি সুশৃঙ্খল করা এবং বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ বৃদ্ধির জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড প্রস্তুত করা। নীতিগত সংস্কারের মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করা।
৩. দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত সর্বনিম্ন। প্রান্তিক ও গড় করহারের পরিবর্তনসহ কর প্রশাসন এবং কর কাঠামোর সংস্কারের মাধ্যমে আর্থিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। জিডিপি এবং কর আয়ের মধ্যে পার্থক্য কমাতে হবে, কর ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠাসহ করজাল বাড়াতে হবে, কর ব্যবস্থা বিশ্লেষণ এবং এনবিআরের সক্ষমতা ও দক্ষতা বাড়াতে হবে।
৪. ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদে জীবনমানের উন্নয়নের জন্য একটি টেকসই উন্নয়ন কৌশল বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
৫. বেসরকারি খাতে ব্যবসা-বাণিজ্য, শিল্প উদ্যোগ ও বিনিয়োগের পোষক প্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘নিয়ন্ত্রক সংস্থা’গুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। পাশাপাশি ব্যবসায়িক পরিবেশ তৈরি করা, আর্থিক ব্যবস্থাগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রাখা, দেশীয় ও বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ নিশ্চিত করা, এফডিআই আকৃষ্ট করা, দক্ষতা উন্নয়নের মাধ্যমে মানব মূলধন উন্নত করা, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর উন্নয়নে এবং দক্ষ আর্থিক খাতের মাধ্যমে সেবা নিশ্চিত করতে হবে।
আর্থিক ব্যবস্থাপনা ব্যতীত অন্যান্য ক্ষেত্রে উন্নতিসহ, উপরোক্ত কর্মসূচিগুলো সোনার বাংলা তৈরির দিকে একটি দীর্ঘস্থায়ী যাত্রায় বাংলাদেশ নেতৃত্ব দিতে পারবে এবং ২০৪১ সালের মধ্যে এটি একটি উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করবে।
ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ: সরকারের সাবেক সচিব
এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান