অভিমত

লিসবন যেভাবে ইইউর স্টার্টআপ হাব হলো

শিল্প-সংস্কৃতি, বিস্তৃত সমুদ্রসৈকত, উষ্ণ আবহাওয়া কিংবা দৈত্যাকৃতির জাহাজ সমাগমের জন্য পর্তুগালের রাজধানী লিসবন বিখ্যাত হলেও একুশ শতকে এসে এটি ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী লিসবন শহরে ক্রমে স্টার্টআপ জনপ্রিয় হচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারি সহায়তার ফলে এখানে নিত্যনতুন

শিল্প-সংস্কৃতি, বিস্তৃত সমুদ্রসৈকত, উষ্ণ আবহাওয়া কিংবা দৈত্যাকৃতির জাহাজ সমাগমের জন্য পর্তুগালের রাজধানী লিসবন বিখ্যাত হলেও একুশ শতকে এসে এটি ইউরোপের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আটলান্টিক মহাসাগরের তীরবর্তী লিসবন শহরে ক্রমে স্টার্টআপ জনপ্রিয় হচ্ছে। সরকারি বেসরকারি সহায়তার ফলে এখানে নিত্যনতুন বিনিয়োগ হচ্ছে। লিসবনের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা বিবেচনায় বিশ্বের নানা প্রান্তের তরুণ উদ্যোক্তারা এখানে ভিড় জমাচ্ছেন। ঐতিহাসিকভাবে পর্যটকনির্ভর একটি অর্থনীতি ক্রমে শিল্প সেবানির্ভর অর্থনীতিতে পরিণত হচ্ছে। ফলে ইউরোপের অন্যতম অর্থনৈতিক সম্ভাবনাময় শহরে পরিণত হয়েছে লিসবন।

প্রিমিয়াম স্টার্টআপের দর্শন নিয়ে লিসবনের যাত্রা শুরু হয়েছিল প্রায় এক দশক আগে। লিসবনের তত্কালীন মেয়র বর্তমান প্রধানমন্ত্রী অ্যান্তনিয় কস্তা সর্বপ্রথম লিসবনকে স্টার্টআপ লিসবোয়া ধারণার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। প্রকল্পের শুরুর দিকে ছোট ছোট কোম্পানিকে সরকারি-বেসরকারিভাবে সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে লিসবনে নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি এবং সামাজিক অর্থনৈতিক বিকাশ সাধনের প্রয়াস নিয়ে উদ্যোগ গৃহীত হয়। অন্য সব প্রকল্পের মতো স্টার্টআপ লিসবোয়াও শুরুর বছরগুলোয় পায়ের নিচে মাটি খুঁজে পেতে সমস্যার শিকার হয়। তবে সাত বছর ধরে প্রকল্প প্রায় ৪০০ নতুন বিনিয়োগ এবং হাজার ৫০০ নতুন চাকরির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। সময় বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশের উদ্যোক্তা লিসবনে তাদের কার্যক্রম শুরু করেন। ইউনিপ্লেসেস এমনই একটি স্টার্টআপ প্রকল্প, যেটি স্টুডেন্ট হাউজিং নিয়ে কাজ করে। লিসবনে শুরু হওয়া ব্যবসায় উদ্যোগটি এখন ইউরোপের নানা দেশে তাদের কার্যক্রম বিস্তৃত করেছে। ফলে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীরা সহজে তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি বসবাসের স্থান খুঁজে পাচ্ছেন। শুধু অনলাইন অ্যাপে রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমেই ভিন্ন একটি দেশে বা শহরে আবাসস্থল খোঁজার মতো ঝক্কির কাজটি শিক্ষার্থীরা খুব সহজেই করতে পারছেন। স্টার্টআপ লিসবোয়া লিসবন শহরে গৃহীত অসংখ্য নতুন বিনিয়োগ প্রকল্প টিকিয়ে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

স্টার্টআপ ভিসা প্রকল্পের আরো একটি চমত্কার উদাহরণ। ২০১২ সালে সর্বপ্রথম পর্তুগাল সরকার পর্তুগালে নতুন বিনিয়োগের অর্থসংস্থান করতে নন-ইইউ রেসিডেন্টদের জন্য গোল্ডেন ভিসা প্রকল্প চালু করে। বিনিয়োগকারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে এবং পর্তুগালের বিভিন্ন অর্থনৈতিক খাতকে অর্থ লগ্নিতে উৎসাহিত করতে প্রকল্প গৃহীত হয়। স্টার্টআপ ভিসা চালুর ইউরোপীয় দেশগুলোর মধ্যে সর্বপ্রথম ধারণা বাস্তবায়ন করে পর্তুগাল। স্কিম চালুর পর বিদেশী বিনিয়োগকারীদের পর্তুগালে মিলিয়ন ইউরো বিনিয়োগের শর্তে পর্তুগালের গোল্ডেন ভিসা প্রদান করা শুরু হয়। এরই মধ্যে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উদ্যোক্তারা প্রকল্পের আওতায় পর্তুগালে অর্থ বিনিয়োগ এবং এখানকার রেসিডেন্সি গ্রহণ করেছেন। পাশাপাশি গুগলের মতো টেক জায়ান্ট কোম্পানিও অর্থ বিনিয়োগের মাধ্যমে লিসবনে ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য আফ্রিকায় কার্যক্রম পরিচালনা বিস্তৃতির জন্য নতুন অফিস স্থাপন করেছে। যেখানে প্রায় ৫০০ নতুন কর্মক্ষেত্র সৃষ্টি হয়েছে।

লিসবনের উষ্ণ আবহাওয়া, অপেক্ষাকৃত কম খরচে উন্নত জীবনযাপনের সুযোগ, সরকারি প্রণোদনা, বন্দর সুবিধা প্রভৃতি কারণে এটি ইউরোপের নতুন বিনিয়োগ কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে। এছাড়া গত বছরগুলোয় পর্তুগিজ শিক্ষা ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি ইউরোপীয় মানদণ্ডে এটি উন্নীত হয়েছে। পর্তুগালে বিজ্ঞান প্রযুক্তিশিক্ষার প্রসারের ফলে এখানে সহজে কম খরচে দক্ষ কর্মী পাওয়া সম্ভব হচ্ছে। ফলে লন্ডন, ডাবলিন, স্টকহোম থেকে লিসবনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব ক্রমে বৃদ্ধি পাচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রেও পর্তুগাল বেশ ওপরের দিকে রয়েছে। তাই বিনিয়োগ ব্যবসা প্রসারের জন্য লিসবন প্রতিনিয়ত বিশ্বের নানা প্রান্তের বিনিয়োগকারীদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে গুরুত্ব পাচ্ছে।

পর্তুগালের অর্থনৈতিক অবস্থাও দেশটিতে নতুন বিনিয়োগের পক্ষে কাজ করছে। ২০১৮ সালের তথ্যমতে পর্তুগালের জনগণের মাথাপিছু জিডিপি ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত অন্যান্য দেশের তুলনায় বার্ষিক প্রায় ১০ হাজার ইউরো কম ছিল। একই সঙ্গে এখানকার ন্যূনতম মজুরিও অত্যন্ত কম। ফলে সস্তা শ্রমে এখানে প্রচুর কর্মী পাওয়া যায়। ফলে নতুন বিনিয়োগকারীরা পর্তুগালের লিসবন কিংবা পোর্তোর মতো শহরে বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হচ্ছেন। ফলে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় পর্তুগালের অর্থনীতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। ২০১৩ সালে যেখানে পর্তুগালের বেকারত্ব ছিল ১৭ দশমিক শতাংশ, সেটা ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর নাগাদ মাত্র দশমিক শতাংশে নেমে এসেছে। নতুন নতুন বিনিয়োগের ফলে পর্তুগালের অর্থনৈতিক, সামাজিক রাজনৈতিক পরিবেশের উন্নতি ঘটছে। আইবেরীয় উপত্যকার দেশটির চিরাচরিত রূপ দ্রুত বদলে যাচ্ছে।

ব্রেক্সিটের মাধ্যমে ব্রিটেন ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর ইউরোপের মাঝে লিসবনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব আরো বেড়ে গেছে। এখানে ক্রমে প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসার প্রসার ঘটছে। লিসবন ক্রমে ইউরোপের সিলিকন ভ্যালিতে রূপ নিচ্ছে, যার দরুন বিশ্বে লিসবন তথা পর্তুগালের ভাবমূর্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে। লিসবনভিত্তিক নতুন নতুন বিনিয়োগের ফলে এখানে যেমন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি পর্তুগালের অর্থনীতিও পর্যটক নির্ভরশীলতার একমাত্রিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারছে। ফলে পর্তুগালের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এখানকার জীবনযাত্রার মান উন্নত হচ্ছে।

ইইউ স্টার্টআপ মনিটরের ২০১৮ সালের তথ্যমতে, বিনিয়োগকেন্দ্র হিসেবে লন্ডন, প্যারিস, বার্লিন কিংবা কোপেনহেগেনের পাশাপাশি অবস্থান করছে লিসবন। ১০ মিলিয়ন জনসংখ্যার দেশ পর্তুগাল নিশ্চিতভাবেই ইউরোপের মধ্যে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে সবচেয়ে উন্নত দেশ নয়, কিন্তু তার পরও সাম্প্রতিক সময়ে বিনিয়োগ কেন্দ্র হিসেবে লিসবন তথা পর্তুগালের অগ্রগতি চিত্তাকর্ষক বিস্ময়জাগানিয়া।

পর্তুগাল ইউরোপের অন্যতম শান্তিপ্রিয় দেশ। এখানকার জনগণ অত্যন্ত নম্র ভদ্র। ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় পর্তুগালে রেসিজম নেই বললেই চলে। ফলে বিদেশী বিনিয়োগকারীরা সহজেই পর্তুগালকে নতুন বিনিয়োগের ক্ষেত্র বসবাসের স্থান হিসেবে বেছে নিতে পারছেন। ২০১৮ সালে করা এক জরিপে ইউরোপের তিন হাজার শহরের মাঝে লিসবন ইউরোপের পঞ্চম গুরুত্বপূর্ণ বিনিয়োগ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব শ্রম সংস্থাসহ নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান লিসবনকে বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নিত করেছে। ফলে ক্রমে লিসবন হয়ে উঠছে ইউরোপের নতুন স্টার্টআপ হাব।

 

কায়সুল খান: শিক্ষার্থী, ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক পলিসি

নোভা স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকস, পর্তুগাল

আরও