১৯৫৩ সালের ২৫ এপ্রিল, বিজ্ঞানী জেমস ওয়াটসন ও ফ্রান্সিস ক্রিক ডিএনএর ডাবল হেলিক্স গঠন আবিষ্কার করে মানবসভ্যতাকে উপহার দেন এক যুগান্তকারী মাইলফলক। এ আবিষ্কার শুধু বিজ্ঞানের ইতিহাসে নয়, মানবজাতির জিনগত গবেষণার পথেও এক নতুন দিক উন্মোচন করে। সেই স্মরণে প্রতি বছর ২৫ এপ্রিল পালিত হয় ‘বিশ্ব ডিএনএ দিবস’। দিনটি শুধু ইতিহাসের স্মারক নয়, বরং বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে গবেষণাগার থেকে মাঠপর্যায় পর্যন্ত জিনোম প্রযুক্তির অপার সম্ভাবনারও প্রতীক। ডিএনএর গোপন সংকেত উন্মোচন থেকে শুরু করে জিনোম এডিটিং প্রযুক্তির বিকাশ—এ যাত্রা কৃষি, চিকিৎসা, পরিবেশ জ্বালানি এবং ফরেনসিক বিজ্ঞানে এক অভাবনীয় বিপ্লব ঘটাতে চলেছে। এ প্রবন্ধে আমরা বিশ্ব ডিএনএ দিবসের তাৎপর্য এবং বাংলাদেশে এ প্রযুক্তির সম্ভাব্য প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করব।
ডিএনএ কী এবং কেন এটি এত গুরুত্বপূর্ণ? প্রতিটি জীবের গঠনগত একক হচ্ছে কোষ। বহুকোষী জীবের প্রতিটি অঙ্গ অসংখ্য কোষ দ্বারা গঠিত। এ কোষগুলোর কেন্দ্রেই থাকে জীবনের মূল নকশা—ডিএনএ (ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক অ্যাসিড)। এটি একটি অতি ক্ষুদ্র অণু, যার মধ্যে জীবের সব জৈবিক বৈশিষ্ট্য, আচরণ ও কার্যাবলি কোড আকারে লেখা থাকে। মানবসহ অধিকাংশ বহুকোষী প্রাণীর কোষে ডিএনএ প্রধানত নিউক্লিয়াসে অবস্থান করে এবং এটি ক্রোমোজোমে হিস্টোন নামক প্রোটিনের চারপাশে প্যাঁচানো অবস্থায় সুরক্ষিত থাকে। এছাড়া ডিএনএর একটি অংশ কোষের শক্তিকেন্দ্র মাইটোকন্ড্রিয়াতেও থাকে। উদ্ভিদের ক্ষেত্রে, ডিএনএ নিউক্লিয়াস ও মাইটোকন্ড্রিয়ার পাশাপাশি প্লাস্টিডেও বিদ্যমান। অন্যদিকে ব্যাকটেরিয়াসহ কিছু এককোষী প্রোক্যারিওটিক জীব, যাদের সুগঠিত নিউক্লিয়াস নেই, তাদের ডিএনএ কোষের সাইটোপ্লাজমে অবস্থান করে। আর ভাইরাসের ক্ষেত্রে, জিনগত উপাদান হিসেবে ডিএনএ বা তার ঘনিষ্ঠ আত্মীয় আরএনএ (রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড) থাকে, যা প্রোটিন আবরণে আবৃত থাকে। আরএনএকে অনেক সময় ডিএনএর ‘কাজিন’ বলা হয়ে থাকে, কারণ তা অনেক কাজেই ডিএনএর সহায়ক হিসেবে কাজ করে।
ডিএনএকে প্রায়ই কোষের ‘মুখ্য নির্বাহী’ (সিইও) বলা হয়, কারণ এটি কোষের সব কার্যকলাপ নিয়ন্ত্রণ করে। প্রশ্ন উঠতে পারে—একটি অণু কীভাবে এত বিশাল দায়িত্ব পালন করে? আসলে, একটি ডিএনএ অণুর মধ্যে থাকে হাজার হাজার জিন, যেগুলো একেকটি নির্দিষ্ট কাজের নির্দেশনা বহন করে। এ জিনগুলো সক্রিয় হলে বা প্রকাশ পেলে (gene expression), কোষে প্রোটিন তৈরি হয়। প্রথম ধাপে, ডিএনএ থেকে মেসেঞ্জার আরএনএ (mRNA) তৈরি হয়—এ প্রক্রিয়াকে বলা হয় ট্রান্সক্রিপশন। এরপর, mRNA কোষের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ রাইবোজোমে গিয়ে নির্দেশনা অনুযায়ী অ্যামাইনো অ্যাসিড একত্র করে প্রোটিন তৈরি করে—এ ধাপকে বলা হয় ট্রান্সলেশন। এভাবে তৈরি হওয়া প্রোটিনই কোষে সমস্ত গাঠনিক ও বিপাকীয় কাজ করে। ডিএনএ থেকে প্রোটিন তৈরির এ পুরো প্রক্রিয়াকে জীববিজ্ঞানে সেন্ট্রাল ডগমা (Central Dogma) বলা হয়।
ডিএনএর গঠন প্রকৃতি এক অসাধারণ সৃষ্টি। এটি দুটি পলিনিউক্লিওটাইড শৃঙ্খল দ্বারা গঠিত, যা একে অন্যের চারপাশে পাকানো থাকে—দেখতে অনেকটা পেঁচানো সিঁড়ির মতো। প্রতিটি ধাপে থাকে চারটি নাইট্রোজেন বেসের জোড়া—অ্যাডেনিন (A) সবসময় যুক্ত হয় থাইমিনের (T) সঙ্গে আর সাইটোসিন (C) জোড়া গঠন করে গুয়ানিনের (G) সঙ্গে। এ চার অক্ষরের (A, T, C, G) বিন্যাসই জীবনের সমস্ত জিনগত নির্দেশনা লিখে দেয়। মানবদেহের প্রতিটি কোষে রয়েছে প্রায় ৩ বিলিয়ন বেস জোড়া ডিএনএ, যা প্রায় ২০-২৫ হাজার জিন দ্বারা নানা ধরনের প্রোটিন তৈরি করে। ২০০৩ সালে মানব জিনোম প্রকল্প সফলভাবে শেষ হওয়ার মাধ্যমে এ জিনগত ‘গ্রন্থ’ পাঠযোগ্য হয়, যা চিকিৎসা বিজ্ঞানে এনেছে এক ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিকিৎসা বিপ্লব। তবে এ জিনগত নির্দেশনায় একটি মাত্র বেসের ভুল, যাকে মিউটেশন বলা হয়, সেটাই হতে পারে থ্যালাসেমিয়া বা সিকল সেল অ্যানিমিয়ার মতো জটিল রোগের কারণ। এ জেনেটিক কোডে পরিবর্তন এনে জীবের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তনের কৌশলকেই বলা হয় জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বা জিন প্রকৌশল।
কোনো জীবের জেনেটিক কোড পরিবর্তন কিংবা জেনেটিক কোডের ভিত্তিতে উদ্ভাবিত প্রযুক্তিকে আধুনিক জীবপ্রযুক্তি বলা হয়। এ প্রযুক্তি বর্তমান শিল্প বিপ্লবের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আধুনিক জীবপ্রযুক্তি আজ ন্যানোবায়োটেকনোলজি, মেশিন লার্নিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও কম্পিউটেশনাল বায়োলজির সঙ্গে একত্রিত হয়ে আমাদের স্বাস্থ্য, খাদ্য, পুষ্টিনিরাপত্তা, পরিবেশ, জ্বালানি, প্রাণবৈচিত্র্য এবং অর্থনীতিতে নতুন এক বিপ্লবের সূচনা করেছে।
জীবপ্রযুক্তি শুধু প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিক থেকেই নয়, বরং জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবেলা এবং বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসে সম্ভাবনার নতুন দ্বার উন্মোচন করেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি হিসেবে বিবেচিত। জীবপ্রযুক্তি ও জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং কভিড-১৯ মহামারী মোকাবেলায় কার্যকর প্রমাণ হয়েছে। অত্যাধুনিক কভিড শনাক্তকরণে ব্যবহৃত পিসিআর প্রযুক্তি ও mRNA-ভিত্তিক ভ্যাকসিন—দুটিই জীবপ্রযুক্তির ফসল।
ডিএনএ গবেষণার অগ্রগতি রোগ নির্ণয়ে বিপ্লব এনেছে। আজ আমরা রোগের লক্ষণ প্রকাশের আগেই নির্ভুলভাবে রোগ শনাক্ত করতে পারছি, যা ক্যান্সারসহ নানা জটিল রোগ প্রতিরোধে অত্যন্ত কার্যকর। বাংলাদেশেও ডিএনএ বা আরএনএভিত্তিক প্রযুক্তি ক্যান্সার স্ক্রিনিং, থ্যালাসেমিয়া নির্ণয়সহ নানা রোগে ব্যবহার করা হচ্ছে। স্বতন্ত্র ডিএনএ সিকুয়েন্সের ওপর ভিত্তি করে গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (আইবিজিই) উদ্ভাবন করেছে মহামারী সৃষ্টিকারী গমের ব্লাস্ট রোগ দ্রুত শনাক্তকরণের এক যুগান্তকারী প্রযুক্তি, যা গেটস ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে আজ সারা বিশ্বে ব্যবহার হচ্ছে। ঢাকার জাতীয় থ্যালাসেমিয়া হাসপাতালে প্রতি বছর প্রায় ৭ হাজার শিশু ডিএনএ টেস্টিংয়ের মাধ্যমে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে। BRCA জিন টেস্ট ব্যবহার করে স্তন ক্যান্সারের ঝুঁকি নির্ধারণ এবং জিন থেরাপি প্রয়োগ শুরু হয়েছে। এছাড়া ফরেনসিক ল্যাবে ডিএনএ প্রোফাইলিং ব্যবহার করে হত্যা, ধর্ষণ ও পরিচয় শনাক্তকরণের মামলায় সাফল্যের হার ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে।
আজ আমরা ডিএনএ কোডে ইচ্ছামতো পরিবর্তন এনে কোনো জীবের কাঙ্ক্ষিত বৈশিষ্ট্য অর্জন করতে পারি। এটি অনেকটা কম্পিউটার সফটওয়্যার সম্পাদনার মতো—নতুন জিন সংযোজন, অপকারী জিন অপসারণ বা ভুল কোড সংশোধনের মাধ্যমে জীবের উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব। এ প্রক্রিয়াগুলোকে বলা হয় জিন প্রকৌশল, জিন এডিটিং, কিংবা বায়োইঞ্জিনিয়ারিং।
গত ৫০ বছরে ধান, ভুট্টা, সয়াবিন, তুলা, ক্যানোলা, পেঁপেসহ বহু গুরুত্বপূর্ণ ফসলের জেনেটিক্যালি মডিফায়েড জাত উদ্ভাবিত হয়েছে, যা বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ভারত, পাকিস্তান, অস্ট্রেলিয়া ও বাংলাদেশসহ অনেক দেশে জিএম ফসল বাণিজ্যিকভাবে চাষ হচ্ছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে জমিতে পোকা-প্রতিরোধী জিএম বিটিবেগুন ও বিটিতুলা চাষের অনুমোদন দিয়েছে, যা কৃষক ও ভোক্তা উভয়ের কাছেই ইতিবাচকভাবে গৃহীত হয়েছে। জিএম প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা এমন ফসলের জাত উদ্ভাবন করতে পারি, যেগুলো জৈব ও এবায়োটিক চাপ (Abiotic stress)—যেমন খরা, লবণাক্ততা, রোগ ও পোকার আক্রমণ—সহ্য করতে পারে এবং পাশাপাশি উচ্চ পুষ্টিগুণ ও ঔষধি বৈশিষ্ট্য ধারণ করে।
স্বাধীনতার পর গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ কৃষি ও খাদ্যনিরাপত্তায় অসাধারণ সাফল্য অর্জন করেছে, যা আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন। এ সাফল্যের পেছনে রয়েছে সমস্যাভিত্তিক গবেষণা, প্রযুক্তির খামার-পর্যায়ে কার্যকর প্রয়োগ এবং কৃষকের হাতে সময়োপযোগী সমাধান পৌঁছে দেয়ার কৌশল। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, ভূমি হ্রাস এবং পুষ্টির সংকটের মতো নানা চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে এ সাফল্য টিকিয়ে রাখা একটি কঠিন কাজ। কৃষিতে এসব নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় উন্নত প্রযুক্তির, যেমন জীবপ্রযুক্তি, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, জিনোম এডিটিং, ন্যানোপ্রযুক্তি, ইন্টারনেট অব থিংস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমন্বয় প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় নির্ভুল কৃষি নিশ্চিত করতে বাংলাদেশকে বহুবিভাগীয় বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে চাহিদাভিত্তিক গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। সেই সঙ্গে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যক্রমে আধুনিক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তি জরুরি। এক্ষেত্রে ইতিবাচক অগ্রগতি দেখা গেছে—গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এরই মধ্যে ন্যানোবায়োটেকনোলজি ও জিনোম এডিটিংসহ অগ্রসরমান আধুনিক বিজ্ঞান অন্তর্ভুক্ত করে তাদের পাঠ্যক্রম হালনাগাদ করেছে।
বর্তমানে বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬৪ মিলিয়ন এবং প্রতি বছর গড়ে ২০ লাখ মানুষ যুক্ত হচ্ছে। এ প্রবণতা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে জনসংখ্যা ২৩-২৫ কোটিতে পৌঁছতে পারে। একই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের মারাত্মক প্রভাব পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে, ফলে ভবিষ্যতে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। গ্লোবাল ক্লাইমেট রিস্ক ইনডেক্স ২০১৮ অনুসারে, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত জিডিপি ক্ষতির ঝুঁকিতে থাকা শীর্ষ ১০ দেশের একটি। দেশে বর্তমানে মোট ৮ দশমিক ৭৭৪ মিলিয়ন হেক্টর চাষযোগ্য জমি রয়েছে, যার ৮৮ শতাংশ এরই মধ্যে আবাদ করা হয়। ফলে নতুনভাবে চাষযোগ্য জমি বৃদ্ধির সুযোগ অত্যন্ত সীমিত। এর পাশাপাশি, ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, নগরায়ণ এবং লবণাক্ত পানির অনুপ্রবেশের কারণে প্রতি বছর প্রায় ১ শতাংশ কৃষিজমি হ্রাস পাচ্ছে।
জিনোম এডিটিং আধুনিক জীবপ্রযুক্তির অন্যতম যুগান্তকারী আবিষ্কার। এটি এমন এক প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে জীবের জিন বা ডিএনএর নির্দিষ্ট অংশকে অত্যন্ত নির্ভুলভাবে পরিবর্তন, মুছে ফেলা বা যুক্ত করা সম্ভব—ঠিক যেন জীবনের কোডকে একটি সফটওয়্যারের মতো সম্পাদনা করা হচ্ছে। এ প্রযুক্তি বর্তমানে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের এক গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচিত।
বাংলাদেশে এরই মধ্যে একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাতীয় কৃষি গবেষণা সংস্থার (NARS) প্রতিষ্ঠানগুলো জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি ব্যবহার করে নতুন ফসল উদ্ভাবন এবং স্মার্ট ডায়াগনস্টিক পদ্ধতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা শুরু করেছে। উল্লেখযোগ্য কিছু উদ্যোগ হলো: (১) গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং গমে ব্লাস্ট রোগ প্রতিরোধের লক্ষ্যে গমের জিন সম্পাদনার কাজ করছে। তারা এরই মধ্যে ক্রিসপার প্রযুক্তি ব্যবহার করে একটি নির্ভুল এবং দ্রুত পয়েন্ট-অব-কেয়ার ডায়াগনস্টিক কিট উদ্ভাবন করেছে, যা মাঠ পর্যায়ে গমের ব্লাস্ট রোগ নির্ণয়ে সহায়তা করছে। (২) বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট এমন ধানের জাত উদ্ভাবনের কাজ করছে, যেখানে সেরোটোনিন উৎপাদক জিন অপসারণ করে পোকা-প্রতিরোধী বৈশিষ্ট্য সৃষ্টি করা হচ্ছে। এছাড়া BADH2 জিন সম্পাদনার মাধ্যমে একটি উচ্চফলনশীল ও সুগন্ধি ধানের জাত তৈরির গবেষণাও চলছে। (৩) ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি এমন বেগুন ও ধানের জাত উদ্ভাবনে কাজ করছে, যেগুলো অ্যাবায়োটিক স্ট্রেস—যেমন খরা, লবণাক্ততা—সহ্য করতে সক্ষম। পাশাপাশি, স্টার্চ ব্রাঞ্চিং এনজাইম সম্পাদনার মাধ্যমে তারা ডায়াবেটিস-বান্ধব ধান উদ্ভাবনের কাজ করছে, যাতে অ্যামাইলোজ ও অ্যামাইলোপেক্টিনের অনুপাত পরিবর্তনের মাধ্যমে রক্তে গ্লুকোজ নিঃসরণ ধীর হয়। (৪) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রি অ্যান্ড মলিকুলার বায়োলজি বিভাগ বর্তমানে ধানে লবণাক্ততা সহনশীলতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জিনোম সম্পাদনার গবেষণা করছে। বাংলাদেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জলবায়ু-সহনশীল এবং পুষ্টিসমৃদ্ধ ফসল উদ্ভাবনের লক্ষ্যে ক্রিসপার-কাস প্রযুক্তির প্রতি আগ্রহ ক্রমেই বাড়ছে। দ্রুততম সময়ে নির্ভুল প্রজননের জন্য এটি এক যুগান্তকারী সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে।
বাংলাদেশে ডিএনএ এবং আরএনএভিত্তিক আধুনিক প্রযুক্তির সুফল পেতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবন্ধকতা রয়েছে: উন্নত প্রযুক্তির অভাব: উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ডিএনএ সিকোয়েন্সিং এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতির অভাব, পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তির ঘাটতি। জিনোমিক ডাটার অভাব: দেশের মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণী, উদ্ভিদসহ প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য জিনোম সিকোয়েন্স ডাটার অভাব এবং ডাটা শেয়ারিংয়ের সুষ্ঠু ব্যবস্থা না থাকা। ভ্রান্ত ধারণা: জিএম (জেনেটিক্যালি মডিফায়েড) ফসল, মলিকুলার রোগ নির্ণয় এবং জিন থেরাপি সম্পর্কে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি। বায়োসেফটি নীতি: বায়োসেফটি নীতি থাকলেও বিশেষজ্ঞের অভাব এবং আমলাতন্ত্রের জটিলতায় নিয়মিত সভা ডাকা হয় না। পুরনো নীতি: ২০১২ সালের পর জাতীয় জীবপ্রযুক্তি নীতি হালনাগাদ না হওয়ায় দ্রুত বিকাশমান প্রযুক্তি যেমন জিনোম এডিটিং অন্তর্ভুক্ত হয়নি। গ্র্যাজুয়েটদের চাকরি: জীবপ্রযুক্তি ও জিন প্রকৌশল বিষয়ে প্রতি বছর গ্র্যাজুয়েটদের জন্য কার্যকর নীতির অভাব, যার ফলে মেধাবীরা হতাশ হয়ে বিদেশে চলে যাচ্ছে।
এগুলো সমাধান করতে এবং উন্নত জীবপ্রযুক্তির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে জরুরি পদক্ষেপ হতে পারে: জীবপ্রযুক্তি নীতিমালা হালনাগাদ: দেশের বর্তমান জীবপ্রযুক্তি নীতিমালাকে হালনাগাদ করা এবং বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর কৌশল গ্রহণ করা। এতে মেধাবী গ্র্যাজুয়েটদের জন্য কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ সৃষ্টি হবে। জিনোমিক্স প্রকল্প: দেশের আদিবাসী, প্রাণী, উদ্ভিদ, অণুজীব ইত্যাদির জিনোম সিকুয়েন্সিং করে একটি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ডাটাবেজ তৈরি করা। এজন্য মাল্টিডিসিপ্লিনারি টিম গঠন এবং পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারত্বের মাধ্যমে ডিএনএ-ভিত্তিক শিল্পের বিকাশ করা। বায়োইকোনমি শক্তিশালীকরণ: জীবপ্রযুক্তি পার্ক স্থাপন এবং দেশের জল, স্থল ও বঙ্গোপসাগরের প্রাণবৈচিত্র্যের অনুসন্ধান করা, যার মাধ্যমে বায়োইকোনমি শক্তিশালী করা যাবে। ক্রিসপার প্রযুক্তি: জলবায়ু-স্মার্ট ফসল, মৎস্য এবং পশুপাখির জাত উন্নয়ন করতে ক্রিসপার ও অন্যান্য আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো, যা ভবিষ্যৎ খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
জিনোম এডিটিং প্রযুক্তি শুধু কৃষিতেই নয়, রোগ নির্ণয়, মানুষের জেনেটিক এবং বিপাকীয় রোগ নিরাময়, জ্বালানি উৎপাদন এবং খাদ্যনিরাপত্তা বৃদ্ধিতেও বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম। ক্রিসপার-কাস সিস্টেম মৌলিক গবেষণার জন্য একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হয়ে উঠেছে, যা বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করতে পারে। বাংলাদেশ সরকারকে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং যথাযথ নীতি গ্রহণ করতে হবে। জাতীয়ভাবে গবেষণার জন্য একটি দক্ষ দল গঠন এবং তাদের জন্য অর্থায়ন নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। লাভজনক কৃষি ও টেকসই লক্ষ্য অর্জনের জন্য এ প্রযুক্তির ব্যবহারে দেশকে প্রস্তুত করতে হবে।
বিশ্ব ডিএনএ দিবস শুধু বিজ্ঞানের এক অর্জন নয়, এটি আমাদের জন্য একটি অনুস্মারক, যার মাধ্যমে আমরা একটি স্বাস্থ্যবান, খাদ্যনিরাপদ এবং ন্যায়বিচারসম্পন্ন সমাজ গঠন করতে পারি। ডিএনএ শুধু অতীতের রহস্য নয়, এটি ভবিষ্যতের সম্ভাবনার চাবিকাঠি। আমাদের লক্ষ্য থ্যালাসেমিয়া-মুক্ত প্রজন্ম গঠন, জলবায়ুসহিষ্ণু কৃষি বিপ্লব এবং ডিজিটাল ফরেনসিক সিস্টেম প্রতিষ্ঠা। বাংলাদেশের জন্য প্রয়োজন: জিনোমিক গবেষণায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি, জনসচেতনতা সৃষ্টি এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করা।
ড. মো. তোফাজ্জল ইসলাম: প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও অধ্যাপক, ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, গাজীপুর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ফেলো, বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিজ্ঞান একাডেমি