বাংলাদেশের মানুষের প্রধান খাদ্যশস্য চাল। সেজন্য পণ্যটির সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা খুবই জরুরি। এর সংকট দেশে খাদ্যনিরাপত্তাকে হুমকিতে ফেলবে। সরকারি হিসাব অনুসারে, দেশে বর্তমানে চাহিদার চেয়ে চাল উৎপাদন বেশি হচ্ছে। কিন্তু কৃত্রিম সরবরাহ সংকট ও সাম্প্রতিক বন্যাসহ নানা কারণে চালের সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় পণ্যটির দাম বেড়ে যায়। আর এর দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি ভোগে নিম্ন ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষ। চালের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে প্রায় শুল্কমুক্ত আমদানির অনুমোদন দেয় সরকার। কিন্তু পণ্যটির আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি হওয়ায় এবং আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে দেশীয় বাজারে চালের মূল্য বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীদের চাল আমদানিতে আগ্রহ তেমন লক্ষ করা যায়নি। সরকারি মজুদ থেকেও বাজারে চাল সরবরাহ শুরু করে সরকার। তার পরও চালের দাম সেভাবে কমেনি। গত রোববার পর্যন্ত চালের সরকারি মজুদ দাঁড়িয়েছে ৭ লাখ ৭২ হাজার টনে।
- দেশের কৃষি উৎপাদন ও খাদ্য মজুদ সম্পর্কে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর যথাসময়ে নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান সরবরাহ করা উচিত। সঠিক নীতি ও পরিসংখ্যানের অভাবে চালের বাজার যেকোনো সময় অস্থিতিশীল হতে পারে। কিন্তু যথাসময়ে নির্ভুল পরিসংখ্যান প্রকাশে নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে অনেক ঘাটতি থাকে। যেমন চালের মোট উৎপাদনের কথা বলা যায়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে চালের মোট উৎপাদন ধরা হয়েছে ৪ কোটি ৭ লাখ ৫০ হাজার টন। তাতে এ ডিসেম্বর পর্যন্ত চালের সরবরাহ সংকট ও মূল্যবৃদ্ধির কোনো আশঙ্কা ছিল না। কিন্তু বাস্তবে তা-ই হয়েছে। অনেকে মনে করেন, এ পরিসংখ্যান অতিমূল্যায়িত, স্ফীত। অন্যদিকে সরকারি পরিসংখ্যান বিভাগ কৃষি উৎপাদনের হালনাগাদ তথ্য দিতে প্রায়ই বেশি সময় ক্ষেপণ করে। যেমন গত মে মাসে বোরো ধান উৎপাদনের কাজ শেষ হয়েছে। তার পরিসংখ্যান এসেছে এ সেপ্টেম্বরের শেষ প্রান্তে। যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণে নির্ভুল ও হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়ে যথাসময়ে নির্ভুল পরিসংখ্যান প্রকাশে প্রতিষ্ঠানগুলোর আরো দায়িত্বশীল হওয়া উচিত।
- সম্প্রতি চালের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়লে আমদানির অনুমতি দেয়া ও শুল্ক কর কমানো হয়। সরকার শুল্ক কর তুলে নিয়ে প্রায় ১৫ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেয়। কিন্তু জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে জানা গেছে, আমদানি হয়েছে মাত্র ১৫ হাজার টন চাল। চাল আমদানি কম হওয়ার কারণ রফতানিকারক দেশে দাম বেশি এবং দেশে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি। দুই বছরে ডলারের দাম বেড়েছে প্রায় ৪০ শতাংশ। ফলে শুল্ক কমিয়েও চাল আমদানি লাভজনক হচ্ছে না। এদিকে গত ৩১ অক্টোবর চাল আমদানির শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়েছে। সরকারের শুল্ক কর তুলে নিয়ে চালের আমদানির মাধ্যমে সরবরাহ বৃদ্ধির প্রচেষ্টাটিও অনেক দেরি হয়ে গেছে। কারণ এরই মধ্যে আমন চাল বাজারে আসা শুরু করেছে। এ অবস্থায় বিলম্বে আমদানি উৎসাহিত করে প্রকারান্তরে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত কৃষকদেরই নিরুৎসাহিত করা হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে যারা কাজ করেন তাদের এ সময়জ্ঞান সম্পর্কে উদাসীনতা সবসময়ই লক্ষ করা যায়। যে উদ্দেশ্যে সিদ্ধান্ত নেয়া তা সেভাবে কোনো কাজে আসে না। নভেম্বরের মধ্যভাগ থেকে আমাদের দেশেই আমন ধান সংগ্রহ শুরু হয়। এমন সময় খুচরা বাজারে চালের দাম নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে চাল আমদানির অনুমতি দেয়াও প্রশ্নসাপেক্ষ। সরকারি গুদামে যে পরিমাণ চাল মজুদ ছিল, তা আমন ধান কাটার আগ মুহূর্তে সরবরাহ করা দরকার ছিল। সর্বোচ্চ দু-তিন লাখ টন চাল মজুদ রেখে বাকি চাল খোলাবাজারে ছেড়ে দেয়া উচিত ছিল। তাতে কোনো আমদানি ছাড়াই উৎপাদন মৌসুমের শুরুতেই উচ্চ মূল্য নিয়ন্ত্রণ করা যেত। আমন মৌসুম থেকে ন্যায্যমূল্যে চাল সংগ্রহ করে মজুদ বাড়ানো যেত। ফলে দেশের কৃষকরাও লাভবান হতেন। দেশের কৃষকরা গ্রামীণ অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হলেও তাদের কমই মূল্যায়ন করা হয়।
- সরকার আমন ধান ও চাল সংগ্রহ শুরু করেছে ১৭ নভেম্বর থেকে। চলবে ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। আতপ চাল সংগ্রহ করা হবে ১৫ মার্চ পর্যন্ত। এবার ধান সংগ্রহ করা হবে ৩ লাখ ৫০ হাজার টন। সেদ্ধ চাল ৫ লাখ ৫০ হাজার টন ও আতপ চাল এক লাখ টন। মোট সংগ্রহ ১০ লাখ টন। ধানকে চাল হিসেবে বিবেচনায় ধরে মোট চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা হলো ৮ লাখ ৮০ হাজার টন, যা সম্ভাব্য মোট চাল উৎপাদনের প্রায় সাড়ে ৫ শতাংশ। সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি কেজি ধান ৩৩ টাকা, সেদ্ধ চাল ৪৭ ও আতপ চাল ৪৬ টাকা। এ দাম উৎপাদন খরচের প্রায় সমান। এ দামে সরকারি গুদামে ধান-চাল সরবরাহ করার ক্ষেত্রে উৎপাদকদের উৎসাহ থাকে কম। বিশেষ করে গুদামে ধান সরবরাহের ক্ষেত্রে কৃষকদের আগ্রহ থাকে না বললেই চলে। এ কারণে তিন-চার বছর ধরে ধান সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্ধেকও অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না।
- দেশের অনেক কৃষকই এখনো বিভিন্ন উৎস থেকে ঋণ নিয়ে বা দোকান থেকে সার-ডিজেল বাকি নিয়ে কৃষিকাজ পরিচালনা করেন। কৃষকের এ ঋণ পরিশোধে নানা চাপ থাকে। ফলে সরকার নির্ধারিত মূল্যের অনেক কম দামে কৃষক ব্যবসায়ীদের কাছে ধান বিক্রি করে দেন। তারা সারা বছর যে পরিশ্রম করে ফসল ফলান তারা সেই শ্রমের ন্যায্যমূল্য পান না। এছাড়া উপজেলা শহরের খাদ্যগুদামে গিয়ে তারা ধান বিক্রির ধকল পোহাতে চান না। এক্ষেত্রে সরকার পরিবর্তনীয় আর্দ্রতায় পরিবর্তনশীল মূল্যে কৃষকের খামার প্রান্ত থেকে ধান সংগ্রহ করতে পারে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে চালের প্রতি টন মূল্য ৪১০-৫২০ ডলার। বাংলাদেশে এর প্রতি কেজি আমদানি খরচ পড়ে ৫৫-৬৫ টাকা। তার চেয়ে অনেক কম দামে আরো বেশি পরিমাণে চাল অভ্যন্তরীণভাবে সংগ্রহ করা গেলে দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে এবং কৃষকও উপকৃত হবেন। এ বিষয়ে কৃষি, খাদ্য ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দেশের কৃষকদের স্বার্থ বিবেচনায় সমন্বিত উদ্যোগ নিতে পারে। আমাদের মোট উৎপাদনের ন্যূনতম ১০ শতাংশ চাল সরকারিভাবে সংগ্রহ করা হলেও চলতি আমন মৌসুমে মোট চাল সংগ্রহের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১৫ লাখ টন। তাতে উৎপাদন মৌসুমে চালের দাম পড়ে যাওয়া এবং নিষ্ফল সময়ে মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে সরকারের হস্তক্ষেপ কার্যকরভাবে প্রভাব বিস্তারে সক্ষম হবে।