বন্দর দিবস

বন্দরের গতিশীলতায় দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন

আজ ১৩৮তম বন্দর দিবস, অন্তর্বর্তী সরকার আমলে প্রথম। ইংরেজ শাসনামলে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার অ্যাক্ট-১৮৮৭ (বেঙ্গল) কার্যকর হওয়ার পর থেকে দিনটিকে বন্দর দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়।

আজ ১৩৮তম বন্দর দিবস, অন্তর্বর্তী সরকার আমলে প্রথম। ইংরেজ শাসনামলে ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল চট্টগ্রাম পোর্ট কমিশনার অ্যাক্ট-১৮৮৭ (বেঙ্গল) কার্যকর হওয়ার পর থেকে দিনটিকে বন্দর দিবস হিসেবে উদযাপন করা হয়। এ বছর দিনটি আরো তাৎপর্যপূর্ণ, কারণ সরকারের মাত্র আট মাস সময়কালে  বন্দর খাত অগ্রাধিকার হিসেবে গুরুত্ব পেয়েছে। বন্দরকে গতিশীল করার নানা প্রচেষ্টা দৃশ্যমান হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রদূত এবং বৈশ্বিক টার্মিনাল পরিচালনাকারী (জিটিও) প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহীরা দেশ-বিদেশে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বারবার সাক্ষাৎ করছেন। নিউমুরিং টার্মিনালে বিদেশী অপারেটর নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। বে-টার্মিনাল নির্মাণের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে অবকাঠামো উন্নয়নের প্রকল্প অনুমোদিত হয়েছে। মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল নির্মাণকাজ শুরু হতে যাচ্ছে। মোংলা বন্দর সম্প্রসারণ ও উন্নয়নে ৪ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নেয়া হয়েছে।

গত বছর বন্দর দিবসে চট্টগ্রাম বন্দরের ওয়েবসাইটে লেখা হয়েছিল, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রাম বন্দরকে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নতির শিখরে। প্রকৃত বাস্তবতা জানা না গেলেও এ কথা সত্য যে আওয়ামী লীগ সরকার শাসনামলের সূচনায় ২০০৯ সালে যে ধরনের পরিপাটি বন্দর পেয়েছিল এ দেশে আর কোনো সরকারের সে সৌভাগ্য হয়নি। ওয়ান-ইলেভেনের সরকারের কোনো কৃতিত্ব যদি নির্মোহভাবে পর্যালোচনা করা হয় তবে প্রথমেই আসবে চট্টগ্রাম বন্দরের নাম। বন্দরের বিভিন্ন কার্যক্রমে, ট্রাক-লরি প্রবেশ থেকে জাহাজে মালামাল ওঠানো-নামানো প্রায় প্রত্যেক ক্ষেত্রেই সেনাবাহিনীর প্রচেষ্টায় অতুলনীয় সংস্কার হয়েছিল। দায়িত্বরত সেনাবাহিনীর যে অবদান বন্দরের ইতিহাসে অম্লান হয়ে থাকবে তা হচ্ছে ডক শ্রমিক বোর্ড বিলুপ্ত করে বার্থ অপারেটর পদ্ধতি চালু করা, কোনো রাজনৈতিক সরকারের পক্ষে যা প্রায় অসম্ভব ছিল। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় নবনির্মিত নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) বিদেশী বিনিয়োগের জন্য অপেক্ষমাণ ছিল।

স্বাধীনতার পর বন্দরের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডির নাম সম্ভবত এনসিটি। ২০০১ সালে বিএনপির শাসনামলে এক হাজার মিটার দৈর্ঘ্যের পাঁচটি জেটি সংবলিত এ টার্মিনালের নির্মাণকাজ শুরু হয়। বাংলাদেশে প্রথম বন্দরকেন্দ্রিক বিদেশী বিনিয়োগ হওয়ার কথা ছিল এ টার্মিনালে। ৫৬৬ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০০৭ সালে নির্মাণ শেষ হলে তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার সব কাজ গুছিয়ে আনে। বৈশ্বিক টার্মিনাল অপারেটর নিয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। ডিপি ওয়ার্ল্ড, এপিএম ইন্টারন্যাশনালসহ বিশ্বখ্যাত চারটি প্রতিষ্ঠানকে প্রাথমিকভাবে বাছাই করা হলেও আওয়ামী লীগ শাসনামলে নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়। দফায় দফায় প্রাকযোগ্যতার শর্তাবলি সংশোধনের পরও ২০১০ সালে বন্দর কর্তৃপক্ষ ওই দরপত্র বাতিল করে। বৈশ্বিক অপারেটর নিয়োগের মাধ্যমে বন্দরকে গতিশীল করে অর্থনীতির বাঁক পরিবর্তনের ওই সুযোগ ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর স্বার্থে নষ্ট করা হয় বলে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে।

নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার পর আট বছর পর্যন্ত এনসিটি আর পুরোপুরি সচল হয়নি। নিজস্ব তহবিলে  যন্ত্রপাতি কিনে ডিপিএম পদ্ধতিতে দেশীয় অপারেটর নিয়োগ করে টার্মিনাল পরিচালনার পথে হাঁটে বন্দর কর্তৃপক্ষ। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত যন্ত্রপাতি কেনার দরপত্র বাতিল করার জন্য চিঠি দিয়েছিলেন বন্দর কর্তৃপক্ষকে। তার পরও ২ হাজার কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হয়। এভাবে দীর্ঘ সময়কাল বন্দরের নিয়ন্ত্রণে রেখে দেশীয় প্রতিষ্ঠান দিয়ে কনটেইনার ওঠানো-নামানোর কাজ করার পর ২০২৩ সালের ১২ জুন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ-দুবাই জয়েন্ট পিপিপি প্লাটফর্ম সভায় এনসিটি ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে এক চুক্তির মাধ্যমে এনসিটির ভাটিতে নির্মিত পিসিটি (পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল) পরিচালনার দায়িত্ব সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালকে দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি সব যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করে পূর্ণমাত্রায় অপারেশনে যেতে আরো কয়েক বছর সময় লাগবে।

পিপিপি পদ্ধতিতে এনসিটির দায়িত্ব ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেয়ার কার্যক্রম বর্তমান সরকারের সময়ে বেগবান হয়েছে। এ ডিপি ওয়ার্ল্ডই প্রথম বৈশ্বিক টার্মিনাল অপারেটর হিসেবে ভারতে বিনিয়োগ করে ১৯৯৯ সালে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশ কনটেইনার টার্মিনালে বৈশ্বিক অপারেটরকে (জিটিও) স্বাগত জানায় বন্দরকে গতিশীল করার জন্য। আমাদের দেশে এর প্রয়োজনীয়তা ছিল অনেক বেশি। ২০০৭ থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত কোনো বৈশ্বিক অপারেটর বাংলাদেশে পূর্ণমাত্রায় অপারেশনে যেতে পারেনি। বন্দর তথা সম্পূর্ণ অর্থনীতিকে গতিশীল করার যে সুযোগ আমরা হারিয়েছি তার পর্যালোচনা প্রয়োজন। অপূরণীয় এ ক্ষতির দায় কাদের, দেশের সম্ভাবনার দ্বার রুদ্ধ করে কারা নিজেদের উন্নতির দুয়ার খুলেছিল তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনা প্রয়োজন।

বাংলাদেশকে আরেকটি বড় স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দরের নামে। ২০১৩ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক ভিত্তিফলক স্থাপনের পর থেকে বিভিন্ন সময় দেশী-বিদেশী বিশেষজ্ঞরা মতামত দিচ্ছিলেন যে পায়রায় সমুদ্রবন্দর করা সম্ভব নয়, ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ রাবনাবাদ চ্যানেল পলিমুক্ত রাখা সম্ভব হবে না। তাছাড়া ড্রেজিংও অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে। কিন্তু স্বার্থান্বেষী কিছু রাজনীতিবিদ ও দুর্নীতিবাজ আমলা সমুদ্রবন্দর নির্মাণের নামে দেশের প্রায় ১৯ হাজার কোটি টাকা নষ্ট করে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায়। এর বড় অংশ লুটপাটের মাধ্যমে বিদেশে পাচার হয়ে গেছে বলে অভিযোগ আছে। চট্টগ্রাম বন্দরের তহবিল থেকেও ৬৫০ কোটি টাকা অনুদান দেয়া হয়েছিল পায়রা বন্দর নির্মাণে। চট্টগ্রাম বন্দরের তৎকালীন শীর্ষ নির্বাহী প্রকাশ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের বিকল্প হিসেবে পায়রা বন্দরকে বর্ণনা করতেন। বর্তমান সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে প্রকৃত সত্যটি প্রকাশ পায় গত ২৩ মার্চে। একনেক সভা শেষে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, সমুদ্রবন্দর তো দূরের কথা নদীবন্দরও হবে না পায়রা, অনেকটা ঘাটের মতো হতে পারে। এখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব হয়ে পড়েছে পায়রার বিশাল দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা যাতে ভবিষ্যতে মেগা প্রকল্পের নামে লুটপাট বন্ধ হয়।

চট্টগ্রাম বন্দরের সর্ববৃহৎ প্রকল্প ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ বে-টার্মিনাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল ২০১৩ সালে। ২০১৮ সালের ১ নভেম্বর প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী, কিন্তু সাত বছর পরও মূল কাজ শুরু হয়নি। ২০ এপ্রিল সাড়ে ১৩ হাজার কোটি টাকার অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দেয়া হয়েছে একনেক বৈঠকে। বে-টার্মিনালের বিষয়ে ২০১৭ সালে জার্মানির হামবুর্গ পোর্ট কনসালট্যান্ট, ২০২১ সালে কোরিয়ার কুনহুয়া কোম্পানি দ্বারা সম্ভাব্যতা সমীক্ষা এবং মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করা হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের পরিসংখ্যানের ভিত্তিতেই বাস্তবায়নযোগ্যতা যাচাই করা হয়েছিল। ওই সময়কালের অনেক পরিসংখ্যান প্রশ্নবিদ্ধ বিধায় সম্পূর্ণ বিষয়টি বাস্তবতার নিরিখে সঠিক পরিসংখ্যান দ্বারা পুনরায় পর্যালোচনা করা প্রয়োজন ছিল। বন্দরে এনসিটি, পিসিটি ও লালদিয়ায় বিশ্বখ্যাত তিনটি বিদেশী টার্মিনাল অপারেটর কাজ শুরু করতে যাচ্ছে, মাতারবাড়ীর একটি টার্মিনালের কাজ শুরু হচ্ছে। এর মাধ্যমে বন্দরের সামর্থ্য বহুগুণ বেড়ে যাবে। ভবিষ্যতে অনেক এফডিআই আসবে কিংবা আঞ্চলিক বন্দর হয়ে উঠবে চট্টগ্রাম—এ স্বপ্ন দেখে আমরা ব্যয়বহুল বে-টার্মিনাল নির্মাণকাজে নামছি। কিন্তু সতর্ক থাকতে হবে, অদূরেই গড়ে ওঠা কর্ণফুলী টানেলের মতো পরিণতি যেন না হয়।

চট্টগ্রাম বন্দরের সার্বিক মান নিয়ে ব্যবসায়ী মহল ও চেম্বারগুলো সাধারণত কিছু বলতে চায় না। দেশে শীর্ষ বিনিয়োগকারী ইয়াংওয়ানের চেয়ারম্যান কিহাক সাং গত ১৪ জানুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাতে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে শিপমেন্ট আরো দ্রুত করার ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, দেশের বৃহত্তম বন্দরে ধীরগতির টার্নঅ্যারাউন্ড টাইম বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় ব্র্যান্ডগুলোর উচ্চমানের ও ফ্যাশন পোশাকের অর্ডার না হওয়ার জন্য অনেকাংশে দায়ী। এ বক্তব্যের মাধ্যমে আমাদের বন্দর ব্যবস্থাপনার সার্বিক মান সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। ধীরগতি দূর করার জন্য অনেক কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ভেঙে দিতে হবে বিভিন্ন স্তরে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট। পরামর্শ নিতে হবে বন্দর ব্যবহারকারী সব মহল ও বিশেষজ্ঞের কাছ থেকে। আমদানি-রফতানিতে গতিশীলতা, এফডিআই এবং জাতীয় উন্নয়নের প্রয়োজনে সরকারকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিয়ে দ্রুত আগাতে হবে। উন্নতির শিখরের দিকে যাত্রা শুরু করার এখনই সময়।

মহীউদ্দিন আল ফারুক: এমএসসি (পোর্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড শিপিং), ওয়ার্ল্ড মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, সুইডেন; অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব

আরও