মূল্যস্ফীতি বোঝার একটি সহজ উদাহরণ হলো একজন ব্যক্তি হয়তো গত বছর কোনো একটি খাবার ১০০ টাকা দিয়ে কিনতেন। ফলে ৫০০ টাকায় তিনি পাঁচটি খাবার কিনতে পারতেন। কিন্তু বর্তমান মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিলে সেটার দাম হয়েছে ১০৯ টাকা। এখন ওই ব্যক্তির আয়ের কোনো পরিবর্তন না হলে ৫০০ টাকায় তিনি এখন আর পাঁচটি খাবার কিনতে পারবেন না, তাকে কম কিনতে হবে। সুতরাং মূল্যস্ফীতি হলে খাদ্যদ্রব্য, পোশাক, বাড়ি ভাড়া, নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্যান্য জিনিসের দাম বেড়ে যায়। মানুষকে এসব সেবা বা পণ্য কিনতে আগের চেয়ে বেশি টাকা খরচ করতে হয়। আয়ের পরিবর্তন না হলে তখন মানুষ এগুলো প্রয়োজনের চেয়ে কম কিনতে বাধ্য হন। তাদের সঞ্চয় কমে যায় এবং অন্যান্য খাতের খরচ কমিয়ে ফেলতে হয়।
এবারে আসি আমাদের দেশের মূল্যস্ফীতির কী অবস্থা? গত অর্থবছরের প্রথম মুদ্রানীতি ঘোষণা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল, আগামী জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমে ৭ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে আসবে। কিন্তু সর্বশেষ গত মে মাসে দেশে গড় মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৮৯ শতাংশ ছিল। প্রায় দুই বছর ধরেই মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য আশা প্রকাশ করেছিল, জুনের পর ধীরে ধীরে কমে তা ৬ শতাংশের ঘরে আসবে এবং মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে নেমে না আসা পর্যন্ত সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি অব্যাহত থাকবে।
মূল্যস্ফীতি কমানোর অন্যতম প্রধান হাতিয়ার নীতি সুদহার বাড়ানো, যাতে বাজারে মুদ্রার প্রবাহ কমে আসে। মুদ্রার প্রবাহ কমে এলে মুদ্রাস্ফীতি ধীরে ধীরে অবশ্যই কমে আসবে। যেটা করে দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, আমাদের এশিয়ার দেশ শ্রীলংকা ও পাকিস্তান। নীতি সুদহার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি কমানো অর্থনীতির সূত্র। এটি যথাসময়ে যথাযথভাবে প্রয়োগ না করলে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা কঠিন। যারা সময়ের কাজ অসময়ে করে তাদের কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হয় না। তা যা-ই হোক উচ্চ মূল্যস্ফীতি কমানোর উদ্যোগ দেরিতে নেয়া হলেও বাংলাদেশ ব্যাংক জানুয়ারির মুদ্রানীতিতেও নীতি সুদহার বাড়ায়। ২৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়ে তা ৮ শতাংশে উন্নীত করা হয়। এরপর প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে আরো দুবার নীতি সুদহার বাড়িয়েছে সংস্থাটি। বর্তমান নীতি সুদহার সাড়ে ৮ শতাংশ। নতুন মুদ্রানীতিতে এ হার ৯ শতাংশে উন্নীত করা হতে পারে। এতে করে সরকারি-বেসরকারি উভয় খাতে ঋণ আরো মূল্যবান হয়ে উঠবে। এজন্য বেসরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যও কমানো হয়।
গত জুন পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য ছিল ১০ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, গত এপ্রিলে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ৯ দশমিক ৯০ শতাংশ। অন্যদিকে সরকারি খাতের ঋণ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছিল ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। সরকারের ঋণ নেয়া কমাতে হবে। বাজারে টাকার সরবরাহ কমাতে হবে। টাকা ছাপিয়ে তারল্য বাড়ানোর দিকে যাওয়া যাবে না। এ মুহূর্তে মুদ্রাস্ফীতি কমানোর জন্য অবশ্যম্ভাবীভাবে টাকাকে অতি মূল্যবান করে তুলতে হবে। তবে উৎপাদনশীল খাত বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ঋণপ্রবাহ অব্যাহত রাখতে হবে। কারণ দেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের এ খাতে কর্মসংস্থান হয়। এছাড়া পণ্যের উৎপাদন বাড়িয়েও মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা যায়। এটিও একটি পরীক্ষিত পদ্ধতি। বাজারে যাতে এককভাবে বা কোনো সিন্ডিকেটের আধিপত্য না থাকে সেদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নজর রাখতে হবে। মুদ্রানীতিতে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট বার্তা থাকতে হবে।
অন্যদিকে ব্যাংক ঋণের সুদহার এরই মধ্যে ৯ শতাংশ থেকে বেড়ে প্রায় ১৪ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এর পরও নীতি সুদহার বাড়িয়ে টাকাকে আরো দামি করে তোলা হতে পারে আসন্ন মুদ্রানীতিতে। এতে ঋণের সুদের হার আরো বাড়বে। তাতে যদি অনুৎপাদনশীল খাতে ঋণপ্রবাহ কমে তবে মূল্যস্ফীতিতে কিছুটা ফল আসতে পারে। এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্রমাগত ক্ষয় অর্থনীতির ভিতকে ধারাবাহিকভাবে দুর্বল করছে। এতে ডলার সংকট আরো তীব্র হচ্ছে।
সম্প্রতি আইএমএফ ও অন্যান্য সংস্থা থেকে পাওয়া ঋণ, রিজার্ভ কিছুটা বাড়িয়েছে। রিজার্ভের ক্ষয় রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া উচিত। অবশ্য নিকট অতীতে ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দেয়ার ব্যবস্থা হয়েছে, তাতে করে রেমিট্যান্সের পালে কিছুটা হলেও হাওয়া লেগেছে। ব্যাংকিং চ্যানেলে যাতে রেমিট্যান্স বাড়ানো যায় তার জন্য টাকা পাচার রোধে শক্ত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। টাকা পাচারকারীদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। ব্যাংক খাতের সুশাসন নিশ্চিতে পদক্ষেপ নেয়া এখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। আশা করা যায়, যদি উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়ন করা যায় তবে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে একটা ভারসাম্যপূর্ণ পরিবেশ তৈরি হতে পারে।
আনোয়ার ফারুক তালুকদার: অর্থনীতি বিশ্লেষক