চট্টগ্রাম বন্দরের নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়া নিয়ে প্রশ্ন উঠছে

পণ্য হ্যান্ডলিং সক্ষমতায় দেশের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি (নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল)।

পণ্য হ্যান্ডলিং সক্ষমতায় দেশের সবচেয়ে বড় টার্মিনাল চট্টগ্রাম বন্দরের এনসিটি (নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল)। বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়নে এ টার্মিনালের যাবতীয় অবকাঠামো নির্মাণ ও ইকুইপমেন্ট স্থাপন করেছে। ব্যয়বহুল যন্ত্রপাতিতে এটি এখন পুরোপুরি প্রস্তুত। টার্মিনালটি বিদেশী অপারেটরের মাধ্যমে পরিচালনার সিদ্ধান্ত এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। যদিও বিশ্বজুড়ে বন্দরগুলোতে বেসরকারি অপারেটররাই যন্ত্রপাতি কিনে টার্মিনাল পরিচালনা করছে। মূলত এ পদ্ধতিতেই অপারেটরের দক্ষতার সুফল পাওয়া যায়। উপযুক্ত বিনিয়োগের ক্ষেত্র নিশ্চিত না করেই সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের (পিপিপি) ভিত্তিতে এর পরিচালন কার্যক্রমে আর্থিকভাবে বন্দর কতটা লাভবান হবে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। 

নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, সরকার এখন পিপিপির মাধ্যমে অপারেটর নিয়োগ দিয়ে এনসিটি পরিচালনা করতে চায়। টার্মিনালটিতে আন্তর্জাতিক অপারেটর নিয়োগে বন্দরের প্রকল্প প্রস্তাবটিও এরই মধ্যে নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে। আন্তর্জাতিক ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজারের তৈরি করা বিজনেস মডেল এবং আরএফপির (রিকোয়েস্ট ফর প্রপোজাল) ভিত্তিতেই আগ্রহী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলোচনা করবে কর্তৃপক্ষ। যদিও এনসিটি পরিচালনার বিষয়ে সরকারের সঙ্গে অনেক আগে থেকেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইভিত্তিক বন্দর পরিচালনাকারী কোম্পানি ডিপি ওয়ার্ল্ড আলোচনা চালিয়ে আসছে। 

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, পণ্য ওঠানো-নামানোর কাজে সবচেয়ে ভারী ও ব্যয়বহুল ইকুইপমেন্ট হলো ‘কি গ্যান্ট্রি ক্রেন’ (কিউজিসি)। চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে সব মিলিয়ে মোট ১৮টি ‘কি গ্যান্ট্রি ক্রেন’ দিয়ে পণ্য ওঠানো-নামানো হচ্ছে। এর মধ্যে এককভাবে শুধু এনসিটিতেই স্থাপন করা হয়েছে ১৪টি ‘কি গ্যান্ট্রি ক্রেন’। এ ১৪টি কি গ্যান্ট্রি ক্রেনের পেছনে চট্টগ্রাম বন্দরের ব্যয় হয়েছে ১ হাজার ১০০ কোটি টাকা। কনটেইনার ওঠানামায় ব্যবহৃত ভারী ইকুইপমেন্টের মধ্যে এর পরপরই রয়েছে রাবার টায়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেন (আরটিজি)। চট্টগ্রাম বন্দরে এ রকম মোট ৪৭টি আরটিজি স্থাপন করা হয়েছে। এর মধ্যে শুধু এনসিটিতেই বসানো হয়েছে ৩০টি। এ ৩০টি আরটিজির পেছনে বন্দরের ব্যয় হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। এর বাইরে জেটি, জেটির পেছনের কনটেইনার রাখার চত্বর ইত্যাদি বাবদ টার্মিনাল কনস্ট্রাকশন ব্যয় প্রায় ৮০০ কোটি টাকা। এ হিসেবে নির্মাণ ও যন্ত্রপাতিসহ সব মিলিয়ে নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনালে (এনসিটি) সরকারের ব্যয় ২ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। এর পুরোটাই হয়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের অর্থায়নে। ফলে বড় বিনিয়োগ হয়ে যাওয়ার পরই কেন বেসরকারি খাতে এ টার্মিনাল ছেড়ে দেয়ার পদক্ষেপ?

বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চলতি বছরের পাঁচ মাসে (জানুয়ারি-মে) চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে মোট ১০ লাখ ৩৬ হাজারটি (প্রতিটি ২০ ফুট দীর্ঘ হিসাব করে)। এর মধ্যে শুধু এনসিটিতেই এককভাবে কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ৪ লাখ ৪৬ হাজার কনটেইনার। অর্থাৎ পুরো বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের প্রায় অর্ধেক পরিমাণই সামাল দেয়া হচ্ছে এনসিটির মাধ্যমে। ফলে বন্দরের অপারেশনাল রাজস্বের দিক থেকে প্রতি টিইইউ হ্যান্ডলিং বাবদ চট্টগ্রাম বন্দরের আয়ের বড় অংশও আসে এনসিটি থেকে। এছাড়া বড় জাহাজ (১০ মিটারের) ভেড়ানোর জন্য চট্টগ্রাম বন্দরে ছয়টি জেটি উপযুক্ত। এর মধ্যে চারটি জেটিই এনসিটিতে। বেসরকারি অপারেটরের হাতে গেলে বড় জাহাজ ভেড়ানোর জন্য দুটি জেটি অবশিষ্ট থাকবে সরকারের পক্ষে।

এনসিটির ব্যাপারে নেয়া পদক্ষেপ নিয়ে নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছে বণিক বার্তা। নাম না প্রকাশের শর্তে তারা জানান, বিদেশী ভালো অপারেটরদের দ্বারা টার্মিনাল পরিচালনা হলে বন্দরের দক্ষতা বাড়বে এটা নিয়ে প্রশ্ন নেই। এক্ষেত্রে বন্দরের নিজের টাকায় যন্ত্রপাতি কেনার চেয়ে সরকার টু সরকার ভিত্তিতে বা বেসরকারি অপারেটরের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও পরিচালনা করা হলে দক্ষতার সঙ্গে টার্মিনালটি পরিচালনার যথেষ্ট সুযোগ আছে। এতে আধুনিক প্রযুক্তি, যন্ত্রপাতি ও দক্ষ জনবলের মাধ্যমে ভালো ফলাফল আসবে। কিন্তু এনসিটিতে এরই মধ্যে অবকাঠামো ও ইকুইপমেন্ট দুই জায়গায়ই বন্দর কর্তৃপক্ষ সব ধরনের বিনিয়োগই করে ফেলেছে। যদি আগেই এ বিনিয়োগ বেসরকারি খাতের অপারেটররের মাধ্যমে করিয়ে উপযুক্ত সক্ষমতা তৈরির পদক্ষেপ নেয়া হতো তাহলে এ নিয়ে প্রশ্ন উঠত না। 

চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক পর্ষদ সদস্য (পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম এ প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘসময় কর্মরত থাকার সুবাদেই বিশ্বের বিভিন্ন বন্দরের ব্যবস্থাপনা দেখা কিংবা এ নিয়ে কাজ করার সুযোগ আমার হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতার আলোকেই আমি বলব চট্টগ্রাম বন্দর এখনো টুল পোর্ট মডেলের ভিত্তিতে পরিচালিত হচ্ছে। এখন অবশ্যই ল্যান্ড লর্ড মডেলের প্ল্যান নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে বন্দর। কিন্তু টুল পোর্ট মডেলের কনসেপ্টে থাকার পরিপ্রেক্ষিতে এখানে তো অনেক ইনভেস্টমেন্ট হয়ে গেছে। ফলে এ মুহূর্তে ল্যান্ড লর্ড মডেলে যাওয়ার যে হিসাব-নিকাশ এটা অনেক কঠিন একটা ব্যাপার হবে। তাই বলব হিন্টারল্যান্ড কানেক্টিভিটিকে অ্যাড্রেস না করেই শুধু এনসিটিতে প্রাইভেট অপারেটর দিয়ে সরকারের দিকটায় কতটা লাভবান হবে সেটা আসলে ম্যাটার অব স্টাডি। আমার কাছে মনে হয় না খুব ভালো কিছু হবে এতে। কারণ যেখানে কমলাপুর ছোট হয়ে যাচ্ছে, আর নতুন আইসিডি নেই তাহলে পণ্য নামবে কোথায়। আগে পুরো সাপ্লাই চেইনটাকে অ্যাড্রেস করতে হবে। দক্ষতা আনতে হলে হিন্টারল্যান্ড কানেক্টিভিটিতে জোর দিতেই হবে। এনসিটির ব্যাপারে ডিপি ওয়ার্ল্ডের প্রস্তাবেও এ বিষয়গুলো উল্লেখ আছে। 

পিপিপির ভিত্তিতে পরিচালনের উদ্যোগের বিষয়ে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ ধরনের প্রক্রিয়ায় সরকারের অনেক উইং কাজ করে। লাভ-ক্ষতি কিংবা শেয়ারিংয়ের বিষয়ে সবকিছু চিন্তাভাবনা করেই নিশ্চয়ই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যাবে সরকার, যেখানে দেশের স্বার্থ সমুন্নত থাকবে। এখানে আমাদের কী অ্যাসেট আছে আর অপারেটর কী আনবে বা যুক্ত করবে এগুলো নিয়ে একটা ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার নিয়োগ হবে। এতে কী ধরনের প্রফিট শেয়ারিং হবে এর সবকিছু বিবেচনা করেই দেশের স্বার্থ সমুন্নত রেখেই নিশ্চয়ই পদক্ষেপ নেয়া হবে।’

অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্দর ব্যবস্থাপনায় বিদেশী অপারেটর নিয়োগ হলে এতে দক্ষতা বাড়বে এটা ঠিক আছে। প্রকল্প বিদেশী অপারেটরকে দেয়ার ব্যাপারে পক্ষে-বিপক্ষে অনেক যুক্তি আছে, কিন্তু নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল এটা অত্যন্ত আধুনিক। যেটা বিদেশী অপারেটরের হাতে ছেড়ে দেয়ার কী যুক্তি থাকতে পারে সেটি আমার কাছে পরিষ্কার নয়। তবে এটা সন্দেহ করার কারণ রয়েছে যে এখানে মার্জিন ভাগাভাগির একটা ব্যাপার আছে।’

আরও