নকল মোড়কে আমদানি হচ্ছে রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা ১৫টি প্রতিষ্ঠানের রেফ্রিজারেন্ট গ্যাসের চালান গত ২৬ জুন কায়িক পরীক্ষা করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি করা ১৫টি প্রতিষ্ঠানের রেফ্রিজারেন্ট গ্যাসের চালান গত ২৬ জুন কায়িক পরীক্ষা করেছে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, গ্যাস সিলিন্ডারগুলোর গায়ে নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান ও সিলিন্ডার স্ট্যান্ডার্ড স্পেসিফিকেশনের নাম নেই। এমনকি গ্যাস উৎপাদনকারী বা ভর্তিকারী প্রতিষ্ঠানের নাম, ঠিকানা ও ওয়েবসাইটের ঠিকানাও লিপিবদ্ধ নেই। কিছু চালানের মোড়কে কিউআর কোড থাকলেও সেগুলো কাজ করছে না। এছাড়া কায়িক পরীক্ষায় বিশ্বখ্যাত ও প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের নকল মোড়কে রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস আমদানির সত্যতা মিলেছে। 

শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) থেকে একের পর এক বিস্ফোরণজনিত দুর্ঘটনা বড় ধরনের শঙ্কা তৈরি করেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম বন্দরে রেফ্রিজারেন্ট গ্যাসের বেশ কিছু চালান আটকে দিয়ে কায়িক পরীক্ষার উদ্যোগ নেয় কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় বন্দরের অভ্যন্তরে এসব চালান পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে বিস্ফোরক অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার উপস্থিতি নিশ্চিত করা হয়। 

অন্যদিকে আমদানি প্রক্রিয়ায় পাইপলাইনে আছে এমন আরো অর্ধশতাধিক কনটেইনার। 

দেশে আমদানি করা রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস মূলত এসি ও ফ্রিজে ব্যবহার করা হয়। বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমোদন নিয়েই এ গ্যাস আমদানি করতে হয়। এসব অনিয়ম সামনে এলে চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ পুনরায় বন্দর থেকে রেফ্রিজারেন্ট গ্যাসের চালান খালাসের বিষয়ে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের মতামত জানতে চায়। তাতে সংস্থাটি ১৫ প্রতিষ্ঠানের রেফ্রিজারেন্ট গ্যাসের চালান কাস্টমস কর্তৃক বা তৎকর্তৃক স্বীকৃত ল্যাবে পরীক্ষা করে সঠিক পাওয়া গেলে এবারের মতো (গ্যাসপূর্ণ রেফ্রিজারেটর সিলিন্ডার) ছাড় করা যেতে পারে বলে মত দেয়। যদিও জাতীয় নিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এ ধরনের চালান আমদানির ক্ষেত্রে বড় ধরনের অনিয়ম চিহ্নিত হয়েছে।

কায়িক পরীক্ষার ওপর ভিত্তি করে নিজ সংস্থার জন্য একটি, আমদানিকারকের জন্য তিনটি ও কাস্টমসের জন্য দুটি করণীয় তুলে ধরে মতামত দিয়েছে বিস্ফোরক পরিদপ্তর। কাস্টমসের জন্য করণীয় হলো বিস্ফোরক পরিদপ্তর কর্তৃক ইস্যু করা গ্যাস সিলিন্ডার আমদানির লাইসেন্সে (গ্যাস সিলিন্ডার বিধিমালা-১৯৯১-এর তফসিল-১ অনুসারে ইস্যুকৃত) উল্লেখিত সিলিন্ডারের সংখ্যা, সিলিন্ডারের স্ট্যান্ডার্ড স্পেসিফিকেশন, সিলিন্ডার প্রস্তুতকারীর নাম, ঠিকানা ও প্রতীক, ইউএন লেভেলিং (প্রতীক) নিশ্চিত করা। অপরটি হলো ঘোষণা প্রদত্ত পণ্য এইচএস কোডে উল্লেখিত কোডভিত্তিক সুনির্দিষ্ট রেফ্রিজারেন্ট গ্যাসের পণ্য চালান কিনা তা স্বীকৃত ল্যাবে পরীক্ষা করে ছাড় করা। 

বিস্ফোরক পরিদপ্তরের সহকারী বিস্ফোরক পরিদর্শক (ঢাকা) মুহাম্মদ মেহেদী ইসলাম খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা চট্টগ্রাম কাস্টমসকে চিঠি দিয়ে আমাদের মতামত তুলে ধরেছি। তিন পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের করণীয়, আমদানিকারকের করণীয় ও কাস্টমসের করণীয় নিয়ে মতামত দিয়েছি। গ্যাস সিলিন্ডার আমদানির ক্ষেত্রে আমরা নথিপত্র যাচাই করে অনুমোদন দেই। আমদানিকারক আমাদের অবগত করে কোন এক্সপোর্টার থেকে কী ধরনের আমদানি করছে, আমরা সে অনুযায়ী আমাদের অনুমোদনপত্রে লিখে দেই।

তিনি আরো বলেন, ‘এখন আমাদের অনুমোদন নেয়া পণ্যই আনা হয়েছে কিনা সেটা যাচাইয়ের দায়িত্ব কাস্টমস কর্তৃপক্ষের। এটার গুণগত মান ঠিক আছে কিনা কিংবা ব্যবহারের ঝুঁকি হবে কি হবে না এ বিষয়গুলো কাস্টমস নিজেদের ল্যাবে কিংবা অন্য কোনো স্বীকৃত ল্যাবে পরীক্ষা করে পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেছি। তবে আমদানিকারকের পক্ষ থেকে অনিয়ম হলে সেটা আইন অনুযায়ী কাস্টমস ব্যবস্থা নেবে, এক্ষেত্রে আমাদের কিছু নেই।’

চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে, রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস আমদানিতে বেশ কয়েক ধরনের অনিয়মের সত্যতা মিলেছে। বিস্ফোরক পরিদপ্তরের পরামর্শ অনুযায়ী এরই মধ্যে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট চালান পরীক্ষা করেছে। এতে রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস শনাক্ত করে টেস্ট রিপোর্ট পাঠানো হয়েছে। তবে এ আমদানি প্রক্রিয়ায় কয়েক ধরনের অনিয়মের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। দেখা গেছে গ্যাস আনতে যে রফতানিকারকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তার সঙ্গে ফ্রান্সের বিশ্ববিখ্যাত গ্যাস উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ফরেনের নামের মিল রয়েছে। মূল ফরাসি প্রতিষ্ঠানের নামের বানান হবে এফওআরএএনই। কিন্তু আমদানিকারক যে রফতানিকারকের নাম উল্লেখ করেছে সেটির নামের বানান এফওআরএএন। দুই কোম্পানির গ্যাসের মান ও মূল্য সম্পূর্ণ ভিন্ন।

এর আগে বিস্ফোরক পরিদপ্তরের ২৩ জুন দেয়া চিঠিতে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ উল্লেখ করেছে, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ব্র্যান্ডের পণ্য নকল মোড়কজাত করে রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস আমদানি করছেন। বিষয়টি জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে ঝুঁকিপূর্ণ বিধায় এসব পণ্য চালান চট্টগ্রাম কাস্টমস কর্তৃক অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড সিস্টেমে বিল অব এন্ট্রি লক করা হয়েছে। 

চট্টগ্রাম কাস্টমসের কমিশনার ফাইজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জনস্বাস্থ্য ও জননিরাপত্তার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হওয়ায় কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস আনা যাবে সেটিও আগে থেকে জানাতে হয়। এক্ষেত্রে অনিয়ম চিহ্নিত করে বেশকিছু চালান আটক করেছি আমরা। আমদানি হওয়া রেফ্রিজারেন্ট গ্যাসের বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় এর ছাড়করণ প্রক্রিয়ায় শুরু থেকেই সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। এছাড়া আমদানি প্রক্রিয়ায় যেসব সংস্থার সংশ্লিষ্টতা আছে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করাসহ তাদের মতামত নেয়া হচ্ছে।’

ফায়ার সার্ভিস ও সিভিলি ডিফেন্সের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালে শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্রে আগুন বা বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে ৩২টি। ২০২১ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৯টিতে। ২০২২ সালে এমন ঘটনা ঘটে ৪৮টি। আর গত বছর ২০২৩ সালে এটা প্রায় দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে ৮৬টি।

চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের যন্ত্রকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. জামাল উদ্দীন আহাম্মদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘রেফ্রিজারেটরের কম্প্রেসরের মধ্যে রেফ্রিজারেন্ট গ্যাস থাকে। কম্প্রেসর মাঝে মাঝে বন্ধ থাকতে হয়। এটা অফ হবে তখনই যখন রেফ্রিজারেন্টের কোয়ালিটি ভালো হবে।’

তিনি আরো জানান, রেফ্রিজারেন্টের কোয়ালিটি খারাপ বা নিম্নমানের হলে কম্প্রেসর বন্ধ হওয়ার সুযোগ থাকে না। এটা ঝুঁকি তৈরি হওয়ার একটি কারণ। তাই কোন মানের রেফ্রিজারেন্ট আমদানি বা ব্যবহার হচ্ছে সে ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। 

আরও