তাৎক্ষণিক লেনদেন নিষ্পত্তি ব্যবস্থা বা রিয়েল টাইম গ্রস সেটলমেন্ট প্লাটফর্মে (আরটিজিএস) যুক্ত হচ্ছে চীনা মুদ্রা ইউয়ান। ফলে ইউয়ানকে ব্যবহার করে চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বাণিজ্য আরো সহজ হবে। বিশেষ করে দেশটিতে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকসহ অন্যান্য পণ্য রফতানি আরো বাড়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
তারা বলছেন, আরটিজিএসে ইউয়ান যুক্ত হলে ডলারের ওপর চাপ কমবে। চীনের সঙ্গে আমদানি-রফতানি বাণিজ্য আরো জোরদার হবে। রফতানি বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতিও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুসারে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে চীনে রফতানি হয় ৬০ কোটি ডলারের পণ্য। ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে যার পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৬৮ কোটি ৬ লাখ এবং ৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ডলার। সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে রফতানি কিছুটা কমে যায়। গত অর্থবছরে রফতানি হয়েছে ৬৭ কোটি ডলারের পণ্য। ইউয়ানে লেনদেনের ফলে রফতানি ক্রমেই বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন বাংলাদেশ-চীন বাণিজ্যসংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) সেক্রেটারি জেনারেল আল মামুন মৃধা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এর প্রভাব নিয়ে এখনই কিছু বলা যাচ্ছে না। কিছু দিন অপেক্ষা করতে হবে। তবে উদ্দেশ্যটা তো অবশ্যই ভালো। ইউয়ানে একটা চাহিদা থাকে এবং পেমেন্ট সেটলমেন্ট করা কঠিন হয়ে যায়। এটা যদি আন্তঃব্যাংকের মাধ্যমে করা যায়, তাহলে পেমেন্ট সেটলমেন্টের ক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখবে। আমরা যখন এলসি করতে যাই তখন, ব্যাংকগুলো একটি কথা বলে যে আমাদের কাছে ইউয়ান নেই। এটার কারণে এখন চাইনিজরা আমাদের সঙ্গে ব্যবসা করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে। এটা একটা মাইলফলক আমি বলব। ইউয়ান চালুর ফলে চীনে আমাদের রফতানি বাড়বে।’
ইপিবির তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, প্রায় দেড় দশকে বাংলাদেশ থেকে চীনে তৈরি পোশাক রফতানি বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ২০০৯ সালে ১ কোটি ৩৬ লাখ ডলারের পোশাক রফতানি করা হয়েছিল। ২০২৩ সালে সেটি বেড়ে ৩৪ কোটি ৬৩ লাখ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০১৯ সালে রফতানি পৌঁছেছিল প্রায় ৪৪ কোটি ৩৪ লাখ ডলারে। আরটিজিএসে ইউয়ান যুক্ত হলে রফতানির এ আকার আরো বড় হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বলে প্রত্যাশা করছেন পোশাক খাতসংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এর ফলে ডলারের ওপর চাপ কমবে। প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলারের আমদানি হয় চায়না থেকে, সেখানেও ইউয়ান কাজে লাগবে এবং বাণিজ্য আরো সহজ ও সম্প্রসারিত হবে। এছাড়া ইউয়ান যুক্ত হওয়ার ফলে পোশাক খাতেও আস্তে আস্তে উপকার আসবে। এ রকম যত উইন্ডো খুলবে তত উপকার হবে। এর ফলে ধীরে ধীরে আরো সুযোগ তৈরি হবে।’
বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে সংগঠনটির সদস্যদের আরটিজিএসে ইউয়ান যুক্ত হওয়ার বিষয়টি জানানো হয়েছে। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে এ মুদ্রায় লেনদেন করার বিষয়টিও অবহিত করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি এক প্রজ্ঞাপনে জানায়, আমদানি ও রফতানি দায় তাৎক্ষণিকভাবে নিষ্পত্তি করতে আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে মার্কিন ডলার, পাউন্ড, ইউরো, কানাডিয়ান ডলার ও জাপানের ইয়েনের পাশাপাশি আরটিজিএসে ব্যবহার করা যাবে চীনের মুদ্রা ইউয়ানও।
ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রায় ক্লিয়ারিং কার্যক্রম আধুনিক, যুগোপযোগী ও তাৎক্ষণিকভাবে নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ২০২২ সালের ৪ সেপ্টেম্বর থেকে এফডিডির পরিবর্তে আরটিজিএস ব্যবস্থা চালু হয়। এর মাধ্যমে পাঁচটি বৈদেশিক মুদ্রায় (মার্কিন ডলার, পাউন্ড স্টার্লিং, ইউরো, জাপানিজ ইয়েন ও কানাডিয়ান ডলার) অটোমেটেড ক্লিয়ারিং কার্যক্রম শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় আরটিজিএস ব্যবস্থায় এখন চাইনিজ ইউয়ানও (সিএনওয়াই) অন্তর্ভুক্ত করা হলো। আগামী ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে আরটিজিএস ব্যবস্থায় চীনা ইউয়ানে লেনদেন চালুর জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। এ বিষয়ে ‘গাইডলাইনস অব এফসি ক্লিয়ারিং থ্রু বিডি-আরটিজিএস সিস্টেম’ অনুসরণ করতে বলা হয়েছে।
দেশের অভ্যন্তরে দেশীয় মুদ্রায় বড় অংকের লেনদেন (১ লাখ বা তার বেশি) তাৎক্ষণিক নিষ্পত্তি করতে ২০১৫ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক আরটিজিএস ব্যবস্থা চালু করে। পরবর্তী সময়ে বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের মতো পেমেন্ট সিস্টেমে বৈদেশিক মুদ্রায় লেনদেন ব্যবস্থা চালুর পদক্ষেপ নেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই ধারাবাহিকতায় ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে পাঁচটি বৈদেশিক মুদ্রায় আরটিজিএস ব্যবস্থার মাধ্যমে আন্তঃব্যাংক লেনদেন শুরু হয়।
২০২৩ সালের আগস্টে চীনের এক্সপোর্ট-ইমপোর্ট (এক্সিম) ব্যাংক প্রেফারেন্সিয়াল বায়ার্সের ক্রেডিটে (পিবিসি) অর্থায়ন করা প্রকল্পগুলোয় নিজস্ব মুদ্রায় ঋণ প্রদানের প্রস্তাব দেয়। বিশ্ববাজারে ডলারের দুষ্প্রাপ্যতা এবং এর সঙ্গে উচ্চ মূল্যস্ফীতির বিষয়টি জড়িত থাকায় বাংলাদেশকে পিবিসি ঋণ ইউয়ানে নেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করে দেখার আবেদন করে চীনের ব্যাংকটি।
প্রচলিত মার্কিন ডলারভিত্তিক ঋণের বিপরীতে চীনের ইউয়ানভিত্তিক ঋণের সুবিধা-অসুবিধা পর্যালোচনা করতে বাংলাদেশ ব্যাংককে অনুরোধ জানায় অর্থ মন্ত্রণালয়। পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ইউয়ানে ঋণ নিলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে তার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। কারণ এ ধরনের ঋণ সাধারণত চীন থেকে পণ্য কিনতে ব্যবহার করা হয়। চীনের ঋণদাতা ব্যাংক বাংলাদেশে পণ্য সরবরাহকারী যে ব্যাংকের গ্রাহক, তাদের সরাসরি আমদানি মূল্য পরিশোধ করবে। ডলারের পরিবর্তে ইউয়ানে মূল্য পরিশোধ করার ফলে রিজার্ভ বাড়তে পারে, যা এ সিদ্ধান্তের আরো আর্থিক সুফল দেবে বাংলাদেশকে।