খাদ্য প্রকৌশল ও পুষ্টিবিজ্ঞান

ক্যারিয়ার হতে পারে খাদ্য প্রকৌশল ও পুষ্টিবিজ্ঞানে

আপনি যে বিষয় নির্বাচন করতে চাচ্ছেন পড়াশোনা শেষে সেই বিষয়ের চাহিদা ও প্রতিযোগীর সংখ্যা কেমন হতে পারে তা আগে থেকেই ভাবা উচিত।

আপনি যে বিষয় নির্বাচন করতে চাচ্ছেন পড়াশোনা শেষে সেই বিষয়ের চাহিদা ও প্রতিযোগীর সংখ্যা কেমন হতে পারে তা আগে থেকেই ভাবা উচিত। কারণ আপনি যখন ভর্তি হচ্ছেন তখনকার চাহিদার চেয়ে আপনি যখন পড়াশোনা শেষ করে বের হবেন ওই বিষয়ের তখনকার চাহিদা ও প্রতিযোগিতা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় দেখা যায় আমি এটা হব ওটা হব স্বপ্ন নিয়ে জোয়ারের স্রোতের মতোই লাখ লাখ ছাত্রছাত্রী জেনে না জেনে একই বিষয় নির্বাচন করে। পড়াশোনা শেষে দেখা যায়, পদবিহীন সার্টিফিকেটধারী পদবি নিয়ে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। কারণ লাখ লাখ প্রতিযোগীর মধ্যে নিজেকে কাঙ্ক্ষিত অবস্থানে আর খুঁজে পাওয়া যায় না। সম্প্রতি একটি গবেষণায় দেখা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৬ ভাগ ছাত্রছাত্রী বেকার থেকে যাচ্ছে।

যা-ই হোক, বিভাগ নির্বাচনের ক্ষেত্রে যে বিষয়গুলো সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত বলে আমি মনে করি তা হলো—

১. বিষয়ভিত্তিক চাকরির বাজার এবং ওই বিভাগে পড়াশোনা সম্পন্ন করা ছাত্রছাত্রীদের বর্তমান অবস্থা।

২. চাকরি না পেলেও বিদেশে বৃত্তি ও পড়াশোনার জ্ঞান কাজে লাগিয়ে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ আছে কিনা।

৩. ওই বিভাগের শিক্ষকমণ্ডলীর শিক্ষাগত যোগ্যতা (কতজন ডক্টরেট ডিগ্রি), গবেষণাপত্র, ও বাস্তব অভিজ্ঞতা।

৪. ওই বিভাগের সুযোগ-সুবিধা। বিশেষ করে গবেষণা সুবিধা ও একাডেমিক কাজকর্মের নিয়মিততা।

৫. সর্বোপরি বিভাগের শিক্ষকমণ্ডলী ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্তরিকতা ইত্যাদি।

বর্তমান ও আগামীর চাহিদাসম্পন্ন এ রকম একটি বিভাগ হতে পারে খাদ্য প্রকৌশল ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগ। যার রয়েছে খাদ্য প্রকৌশলী বা পুষ্টিবিদ হিসেবে দ্বিমুখী ক্যারিয়ারের সুযোগ। এটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন অনুযায়ী আধুনিকায়ন হয়ে উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা একটি বিভাগ।

অনেকের ধারণা খাদ্যবিজ্ঞান/প্রকৌশল/পুষ্টি বিষয় মানেই রান্নাবান্না, যা পুরোটাই তাদের অনভিজ্ঞতার পরিচয়। খাদ্যশিল্প সারা বিশ্বে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি শিল্প, যার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত বিভিন্ন ধরনের পানীয় যেমন কোকা-কোলা, সেভেনআপ, স্প্রাইট, চা, কফি, বোতলজাত পানি, পাস্তুরিত তরল ও গুঁড়া দুধ, তেল, চকোলেট, বিস্কুট, বেকারি শিল্প, বিভিন্ন বায়োবর্জ্য কাজে লাগানো ও পরিশোধন বাবস্থাপনা ইত্যাদি।

একটি খাদ্য শিল্পের শুরু থেকে সঠিক জায়গা নির্ধারণ, কারখানা লে-আউট ও ডিজাইন, মেশিন নির্ধারণ ও স্থাপন, অপারেশন, পণ্য প্রণয়ন ও উৎপাদন, সময়ের চাহিদা অনুযায়ী নতুন পণ্যের উদ্ভাবন, দীর্ঘদিন নিরাপদ ও গুণগত মান বজায় রাখা, মোড়কীকরণ, বিভিন্ন সম্মতি/আদর্শমান যেমন বিএসটিআই, হেসাপ, কডেক্স, হালাল, জিএমপি ইত্যাদিসহ সব কারিগরি দক্ষতা খাদ্যবিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ থেকে শেখানো হয়। এছাড়া একটি খাদ্যদ্রব্যের সব জৈবরাসায়নিক উপাদান ও তাদের বৈশিষ্ট্য, গঠন, কাজ, মানব দেহের জন্য স্বাস্থ্যকর কিংবা ক্ষতিকর কিনা ইত্যাদি সব বিষয় নিয়েই গবেষণা করা হয়। অন্যদিকে পুষ্টিবিদ হিসেবে হাসপাতাল, নিজস্ব চেম্বারসহ গবেষণা প্রতিষ্ঠানে চাকরির সুযোগ। গবেষণায় ব্যবহৃত উল্লেখযোগ্য বিশ্লেষণাত্মক যন্ত্রপাতিগুলোর মধ্যে ক্রোমাটোগ্রাফি বিশেষ করে HPLC, GC-MS, ও UPLC-Q-TOF-MS, এছাড়া UV-spectrophotometer, calorimeter, Atomic absorption, FT-IR, Raman Spectroscopy, SEM, CLSM, DSC, Particle Size Analyzer, Texture Analyzer, Microplate Reader, Electronic Tongue ইত্যাদি।

প্রক্রিয়াকরণ মেশিনগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো বিভিন্ন ধরনের ড্রায়ার, কুলার, চিলার, মিক্সার, ফিল্টার, পাস্তুরাইজার, হোমোজেনিজার, এইচপিপি, এক্সট্র্যাক্টর, প্যাকেজিং মেশিন, মোল্ডার, ওভেন, কাটার, ফিলার, বয়লার ইত্যাদি।

চাকরির বাজারের ক্ষেত্রে দেশে-বিদেশে হাজার হাজার খাদ্যশিল্প ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, এফএও, এফডিএ, ডব্লিেউএইচও, ইউএনডিপি, ইউনিসেফ ও অন্যান্য দেশীয়-আন্তর্জাতিক সংস্থায় উচ্চ বেতনে চাকরির সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতি মহামারীর সময় থেকে আগের তুলনায় খাদ্যের সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়গুলোর (খাদ্যবিজ্ঞান/প্রযুক্তি/প্রকৌশল/পুষ্টি) চাহিদা বেড়েছে বহু গুণ। সে সময় প্রায় সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও অসংখ্য মানুষ চাকরি হারালেও চালু ছিল দেশে-বিদেশের সব খাদ্যশিল্প প্রতিষ্ঠান এবং একজন খাদ্য প্রযুক্তিবিদ-প্রকৌশলীও চাকরিচ্যুত হননি। মানুষ বুঝতে পেরেছে সুস্থ ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য পুষ্টিবিদ ও পুষ্টিকর খ্যদ্যের গুরুত্ব। সাধারণ বিসিএসসহ অন্যান্য সরকারি চাকরি যেমন নিরাপদ খাদ্য অফিসার, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে সায়েন্স ল্যাব, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন, বারি, বিরি, বারটান, ভিএলআরআই এবং বিএসটিআইতে মাননিয়ন্ত্রণ কর্মকর্তাসহ অন্যান্য পদে সুযোগ রয়েছে।

এরই মধ্যে জেলা নিরাপদ খাদ্য অফিসার পদটি চালু হয়েছে এবং থানা পর্যায়ে চালু করার জন্য প্রক্রিয়াধীন। এছাড়া সরকারি-বেসরকারি পলিটেকনিক কলেজসহ বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার সুযোগ রয়েছে। গত ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রতিটি ৫০ বা তার অধিক হাসপাতাল ও ক্লিনিকে একজন করে পুষ্টিবিদ নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। আছে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য অসংখ্য বৃত্তি। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বই নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য প্রতিনিয়ত আন্দোলন করে যাচ্ছে এবং কোটি কোটি টাকার প্রকল্প বরাদ্দ দিচ্ছে। এ বিষয়ের বিশেষ সুবিধা হচ্ছে সনদধারী কিছু গ্র্যাজুয়েট থাকলেও চাকরির বাজারে চাহিদার তুলনায় দক্ষ জনশক্তির অনেক অভাব। তাই জোয়ারের স্রোতের মতো যেকোনো বিষয়ে সনদধারী শিক্ষিত বেকার না হয়ে বহুমুখী কর্মক্ষেত্র এবং ভবিষ্যতের অপার সম্ভাবনা সমৃদ্ধ আপনার বিষয় হতে পারে খাদ্য প্রকৌশল ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগ।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, খাদ্য প্রকৌশল ও পুষ্টিবিজ্ঞান বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ।

সাবেক সিনিয়র গবেষক, জিএনইউ, দক্ষিণ কোরিয়া

আরও