ঈদের আমেজটাই নেই, পরদিনই প্রেজেন্টেশন অ্যাসাইনমেন্ট ক্লাস
মো. ওবায়দুল্লাহ
শিক্ষার্থী, সাউদার্ন মিসিসিপি বিশ্ববিদ্যালয়, যুক্তরাষ্ট্র
প্রবাস জীবনে প্রথম ঈদ মানেই এক অন্যরকম অনুভূতি, যেন আনন্দের মাঝে লুকিয়ে থাকে এক শূন্যতা। পরিবার, আত্মীয়, বন্ধু-বান্ধব—সবাইকে ছেড়ে দূরে থাকার এ অনুভূতিটা বড়ই বেদনাদায়ক। আর যদি সেটা হয় এমন দেশে যেখানে ঈদের আমেজটাই নেই, তখন এ অনুভূতিটা যেন আরো গভীর হয়। রোববার আমেরিকায় ছুটির দিন হওয়ায় ক্লাসের ঝামেলা পোহাতে হয়নি, কিন্তু তবুও সকালবেলা গোসল করেই সেমাই, নুডলস না খেয়ে বাসা থেকে বের হওয়াটাই মনে করিয়ে দেয়, ‘এটা আমার দেশ না।’ দেশের মতো এখানে খোলা আকাশের নিচে ঈদগাহে জামাত হয়নি। ইউনিভার্সিটির বড় একটা হলরুম ভাড়া করে সেখানে নামাজ পড়তে হলো।
আমরা সবাই এখানে একে অন্যের পরিবার হয়ে উঠেছি, কিন্তু মনের গহিনে দেশের সেই আপন মানুষের জন্য হাহাকারটা থেকেই যায়। মায়ের স্নেহময় কোলে মাথা রাখা, সহধর্মিণীর হাতের তৈরি খাবার, ভাই-বোনের ঝগড়া, ভাতিজা-ভাতিজির হাসি, ভাগ্নে-ভাগ্নির দুষ্টুমি—সবকিছুই যেন মনে পড়ে যায় বারবার। আরো বেশি কষ্টের বিষয় হলো, ঈদের আনন্দের সেই রেশ ঠিকমতো শেষ হওয়ার আগেই বাস্তবতার ধাক্কা এসে লাগে। ঈদের পরদিনই প্রেজেন্টেশন, অ্যাসাইনমেন্ট, ক্লাস। মন যেন মেনে নিতে চায় না। সারা রাতের ক্লান্তি আর বিষণ্নতার মাঝেও নিজেকে প্রস্তুত করতে হয়। চোখের নিচে কালি পড়ে যায়, কিন্তু পড়াশোনার দায়িত্ব পালনের জন্য তা উপেক্ষা করে যেতে হয়।
জানি না আবার কবে দেশে গিয়ে সেই চিরচেনা ঈদের আমেজটা উপভোগ করতে পারব। তবুও প্রবাসের এ ঈদ আমায় মনে করিয়ে দেয় যে দূরে থাকলেও ভালোবাসার বন্ধনগুলো কখনো দূরে সরে যায় না। বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আরো গভীর হয়।
মনে হলো যেন মিনি ঢাকায় চলে এসেছি
রেজা উর রহমান রাজু
শিক্ষার্থী, বিপিপি ইউনিভার্সিটি, লন্ডন
এবারের ঈদ আমার জন্য একটু ভিন্ন ছিল, কারণ প্রথমবারের মতো দেশের বাইরে ঈদ উদযাপন করেছি। এবারই প্রথম ঈদের সকালে মায়ের ডাক শুনিনি ঈদের নামাজের জন্য। ঈদের শপিং, বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি, বাসের টিকিট কাটা কিংবা আনুষঙ্গিক কোনো আয়োজন ছিল না। ঈদের চাঁদরাতে বন্ধুদের নিয়ে হৈ-হুল্লোড়, নদীর ধারে আড্ডা, খালি গলায় গান গাওয়া—কোনোটাই হয়নি। লন্ডনের এ ব্যস্ত নগরীতে ঈদের দিনেও অনেকে ছুটি পায় না, এমনকি অনেকেই কাজের চাপে নামাজও পড়তে পারে না। সেই হিসেবে আমি ভাগ্যবান। আল্লাহর অশেষ রহমতে, লন্ডনের রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে বৃহত্তর এক ঈদ জামাতে অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছি। সেখানে বাংলাদেশী কমিউনিটির অনেকের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছি। নামাজ শেষে ফোনে দেশে পরিবারের সদস্য ও বন্ধুদের সঙ্গে কথা বলেছি। এরপর এক বড় ভাইয়ের আমন্ত্রণে তার বাসায় যাই। সেখানে গিয়ে দেখি এক বিশাল আয়োজন! অনেক পরিচিত ও নতুন মানুষের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় হয়। ঈদের আনন্দে কোনো কিছুই কমতি ছিল না—আমরা সবাই মিলে আড্ডা দিয়েছি, গান গেয়েছি এবং দেশীয় খাবার উপভোগ করেছি। গরুর মাংস, ভেড়ার মাংস, রোস্ট, ডিম, পোলাও, ফিরনি, পায়েসসহ নানা লোভনীয় আইটেম ছিল খাবারের তালিকায়। তাদের আন্তরিকতা ও আতিথেয়তা আমাকে যেন দেশের মাটিতেই ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। বিকালে বাঙালি অধ্যুষিত এলাকা আপটন পার্কে গিয়ে পরিচিত লোকদের সঙ্গে হারিয়ে যাই। সেখানে গেলে মনে হয় যেন মিনি ঢাকায় চলে এসেছি। চারদিকে নিজ ভাষাভাষী মানুষের পদচারণা, পরিচিত পরিবেশ—সবকিছুই বিশেষ আনন্দ এনে দেয়। এ এলাকায় বাংলাদেশী অধিকাংশ জিনিসপত্র, বিশেষ করে খাবারের সহজলভ্যতা মন ছুঁয়ে যায়। এরপর শুরু হয় আড্ডার নতুন পর্ব—পরিচিত ভাই, বন্ধু ও বড় ভাইদের সঙ্গে গল্পে মেতে উঠি। এ এলাকার একটি বিশেষ সুবিধা হলো, এখানে এলেই হঠাৎ পরিচিত মানুষের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়।
ঈদের দিন সকালে মন খারাপ নিয়ে ঘুম থেকে ওঠা
অধরা ইয়াসমিন
শিক্ষার্থী, সাংকংহে ইউনিভার্সিটি, দক্ষিণ কোরিয়া
প্রবাসে ঈদ মানেই এক ভিন্ন অনুভূতি। বিশেষ করে যারা দেশ থেকে অনেক দূরে। দক্ষিণ কোরিয়ায় পড়াশোনা করা শিক্ষার্থীদের জন্য ঈদের দিনটি আনন্দের সঙ্গে ছিল একরাশ না-পাওয়ার অনুভূতিও। বিদেশে এটা আমার প্রথম ঈদ উদযাপন। মাতৃভূমি থেকে হাজার হাজার মাইল দূরে, দেশের ঈদ উদযাপন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ঈদ কাটানো একটি অন্তর্দ্বন্দ্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা। দেশে ঈদ মানে পুরো পরিবার একসঙ্গে, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করা। সে সময় যেন ঈদের স্নিগ্ধতা, পবিত্রতা এবং আনন্দের সঙ্গে পুরো পরিবেশ একাকার হয়ে ওঠে। কিন্তু প্রবাসে এসব কিছুই হাতের নাগালে থাকে না। আর তাই দক্ষিণ কোরিয়ায় প্রবাসী বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা সেই প্রিয় অনুভূতিগুলো অনুভব করতে পারেনি। বাংলাদেশী শিক্ষার্থীদের অনেকেই এবার ঈদের দিন সকালে মন খারাপ নিয়ে ঘুম থেকে উঠেছেন। প্রিয়জনদের পাশে না পাওয়ার কষ্টটা সত্যিই বড়। তবে মন খারাপ নিয়ে ঈদ তো আর কাটানো যায় না—তাই সবাই মিলে চেষ্টা করেছেন একে অন্যের সঙ্গে আনন্দ ভাগ করে নিতে। আমিও তাদের ব্যতিক্রম নই। এবারের ঈদেও অনেক শিক্ষার্থী তাদের প্রিয় দেশ থেকে দূরে থাকার কারণে মন খারাপ করেছিল। তাদের মনে ছিল পরিবারের সান্নিধ্যের অভাব, দেশের ঐতিহ্য এবং একে অন্যের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময়ের সেসব মধুর মুহূর্তের অভাব। তবুও তারা একে অপরকে পাশে পেয়েছে এবং স্থানীয় মুসলিম কমিউনিটির আয়োজনগুলোয় অংশগ্রহণ করে ঈদের আনন্দ উদযাপন করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ার মুসলিম কমিউনিটি শিক্ষার্থীদের জন্য এক পরিবারের মতো হয়ে উঠেছে, যেখানে একে অন্যের সঙ্গে ঈদের নামাজ, খাওয়া-দাওয়া, শুভেচ্ছা বিনিময় করার জন্য তারা একত্রিত হয়েছিল। প্রবাসে ঈদ পালন করা শুধু ধর্মীয় রীতি পালনের বিষয় নয়, এটি এক আবেগময় অভিজ্ঞতা।