পরিচ্ছন্ন বেলাভূমিতে, অনিন্দ্য সুন্দর সমুদ্র সৈকত, দিগন্তজোড়া সুনীল আকাশ, নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সাগরকন্যা খ্যাত কুয়াকাটা। দেশের দক্ষিণাঞ্চলে পটুয়াখালী জেলায় অবস্থিত, বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা ১৮ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সমুদ্রসৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্ত দু’টোই দেখা যায়, যা বিশ্বের খুব কম সমুদ্রসৈকতেই সম্ভব। সকালের সূর্যের লাল আভা এবং বিকালের রঙিন সূর্যাস্ত কুয়াকাটাকে দেয় এক মোহনীয় রূপ। এখানে কেবল সমুদ্র নয়, রয়েছে অতুলনীয় প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক সৌন্দর্যের বিভিন্ন নিদর্শন। পর্যটকদের জন্য কুয়াকাটা শুধু বিশ্রাম কিংবা অবকাশ কাটানোর জায়গা নয়। এটি একটি ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্যের মেলবন্ধনও বটে।
কুয়াকাটার নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে খুব সকালে উঠতে হবে। হোটেলের সামনে বা রাস্তায় বের হলেই পাওয়া যাবে অটো, অটোভ্যান বা মোটরসাইকেল। ওঠার আগে অবশ্যই দরদাম করে নিতে হবে। সাধারণত অটো, অটোভ্যানগুলো জনপ্রতি ১০০ টাকা করে পর্যটকদের ঘুরিয়ে আনবে সৈকতের পূর্বপ্রান্তের দর্শনীয় স্থানগুলোতে। সিঙ্গেল বা ডাবল থাকলে মোটরসাইকেল নিয়ে যাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে খরচ পরবে ৪০০-৫০০ টাকার মধ্যে। তারা পর্যটকদের সবগুলো দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে আনবে। তাদের অমায়িক ব্যবহার মুগ্ধ করার মতো। এছাড়া ভালো ভ্রমণ গাইড হিসেবে পর্যটকদের সঙ্গও দেয়। পূর্বপ্রান্তের দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে গঙ্গামতির চড়, মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধ মন্দির, রাখাইন পল্লি, কুয়াকাটার কুয়া ও সীমা বৌদ্ধ মন্দির। কাক ভেজা ভোরে আধাপাকা মেঠো পথ বেয়ে সৈকতের তীর ঘেষে চলতে দারুণ এক অভিজ্ঞতা পাওয়া যাবে। ভাগ্য ভালো থাকলে রাস্তার দুই ধারে থাকা খেজুর গাছের টাটকা রসে গলাটাও একটু ভিজিয়ে নেয়া যাবে। গ্লাস প্রতি ২০ টাকা।
একটু আলো উঠতে উঠতেই চলে আসতে হবে প্রথম গন্তব্য গঙ্গা মতির চরে। কুয়াকাটার পূর্বপ্রান্তে অবস্থিত গঙ্গা মতির চর একটি শান্ত ও নির্জন এলাকা। এখানে কাদামাটির প্রাকৃতিক ল্যান্ডস্কেপ আর পাখিদের কলকাকলিতে মন ছুঁয়ে যায়। শীতকালে পরিযায়ী পাখিদের অবাধ বিচরণ এই এলাকাকে আরো আকর্ষণীয় করে তোলে। সূর্যোদয়ের সময় গঙ্গা মতির চড়ে দাঁড়িয়ে প্রকৃতির মুগ্ধতা উপভোগ করা যেন এক অনন্য অভিজ্ঞতা।
সূর্যোদয় দেখার পর মেঠোপথ ধরে চলে আসতে হবে মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধ মন্দিরে। রাখাইন সম্প্রদায়ের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ মিশ্রি পাড়া বৌদ্ধ মন্দির। এ মন্দিরে অবস্থিত বিশালাকার বুদ্ধমূর্তি শুধু ধর্মীয় দিক থেকেই নয়, স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। এখানে রাখাইন সংস্কৃতির ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক উজ্জ্বল প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। মিশ্রিপাড়া বৌদ্ধ মন্দির থেকে একটু সামনে গেলেই চোখে পড়বে রাখাইন পল্লী। এই পল্লীতে গেলে রাখাইন সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক এবং কারুশিল্পের সঙ্গে পরিচিত হওয়া যায়। বিশেষ করে তাদের হাতে তৈরি তাঁতের চাদর ও বিভিন্ন গৃহস্থালী সামগ্রী পর্যটকদের জন্য বেশ আকর্ষণীয়।
এরপর ফেরার পথে জিরো পয়েন্ট এর কাছেই পাবেন কুয়াকাটার বিখ্যাত সেই কুয়া। যে কুয়া থেকেই কুয়াকাটার নামকরণ। এই কুয়াটি এক সময় স্থানীয় রাখাইনদের মিষ্টি পানির অন্যতম উৎস ছিল। এটি এখন কুয়াকাটার ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের স্মারক। কুয়ার পরেই রয়েছে সীমা বৌদ্ধ মন্দির। রাখাইন স্থাপত্যশৈলীতে নির্মিত এই মন্দিরে রয়েছে একটি স্বর্ণবর্ণের বুদ্ধমূর্তি। এটি ধর্মীয় বিশ্বাসের পাশাপাশি পর্যটকদেরও আকর্ষণ করে। বলা হয় থাকে এই মন্দিরটি ৩৭ মণ ওজনের অষ্টধাতু দিয়ে নির্মিত।৷
সকালের পর্বশেষ করে হোটেলে একটু রেস্ট নিয়ে দুপুরে সৈকতে অবকাশ যাপন করতে পারেন। দুপুরের রোদে সৈকত ঝলমল করে। সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে স্নান আপনার মনে মানসিক প্রশান্তি এনে দিবে। বালির ওপর পা ডুবিয়ে হেঁটে যাওয়া কিংবা সমুদ্রের স্বচ্ছ জলে ডুব দিয়ে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যাওয়ার মুহূর্তগুলো স্মৃতি বন্দী করতে স্থানীয় ফটোগ্রাফাদের সাহায্য নেবারও সুযোগ আছে। দুপুরের গোসল শেষে জিরো পয়েন্ট এর আশে পাশে অসংখ্য খাবার হোটেল আছে। সেখানে খাবারের ব্যবস্থা আছে। মাছ, মাংস, চিংড়ি, শুটকি ভর্তাসহ বিভিন্ন প্রকার সামুদ্রিক মাছ রুচি ও চাহিদা অনুসারে নিজে পছন্দ করে খাওয়া যায়। ২০০-৫০০ টাকার মাঝেই এসব মাছের ফ্রাই খাওয়া যায়।
সোহেল রানা: শিক্ষার্থী, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়