বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বছর

প্রথম বর্ষের যত বাধা

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুর দিনগুলো হয় রোমাঞ্চে ভরপুর, যেন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয় জীবনের।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুর দিনগুলো হয় রোমাঞ্চে ভরপুর, যেন এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয় জীবনের। একদিকে আসে স্বাধীনতার এক নতুন স্বাদ—নিজের ইচ্ছেমতো চলার, নিজের মতো সিদ্ধান্ত নেয়ার। অন্যদিকে থাকে নিজেকে প্রস্তুত করার একটি বড় চ্যালেঞ্জ। নতুন একটি প্রতিষ্ঠান, নতুন নতুন সব বন্ধু, অজানা পাঠ্যক্রম, নতুন শিক্ষকদের সঙ্গে পরিচয়—সব মিলিয়ে এক নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেয়ার আকাঙ্ক্ষা ও উত্তেজনা কাজ করে।

তবে এ যাত্রা সবার জন্য এক রকম হয় না। কারো জন্য এটি আনন্দময় ও উদ্দীপনায় ভরা, আবার কারো জন্য এটি জটিল ও চিন্তার হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুতে অনেকেই মুক্ত পরিবেশ এবং স্বাধীনতা উপভোগ করতে গিয়ে পড়াশোনায় মনোযোগ হারায়, আবার কেউ কেউ এ নতুন সুযোগগুলো কাজে লাগিয়ে নিজেদের লক্ষ্য অর্জনের পথে এগিয়ে যেতে শুরু করে।

প্রথম দিনগুলোয় নতুন বন্ধু তৈরি করা, ক্লাসে শিক্ষকদের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি করা এবং বিভিন্ন ক্লাব বা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়া অনেকের জন্য রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা। তবে এটি সহজ নয় সবার জন্য। যারা স্বভাবগতভাবে সহজে মিশতে পারে না বা নতুন পরিবেশে নিজেকে মানিয়ে নিতে সময় নেয়, তাদের জন্য এ যাত্রা একটু কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

এছাড়া নতুন পাঠ্যক্রমের সঙ্গে মানিয়ে নেয়াও প্রথম দিকে বেশ কঠিন হতে পারে। স্কুল-কলেজের সুনির্দিষ্ট সিলেবাস এবং পরীক্ষাভিত্তিক পড়াশোনার বাইরে এসে হঠাৎ করেই প্রেজেন্টেশন, গ্রুপ ওয়ার্ক এবং নানা ধরনের রেফারেন্স ব্যবহার করে লেখালেখির মতো বিষয়গুলো অনেকের জন্য বিভ্রান্তিকর হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে যোগ হয় সময় ব্যবস্থাপনার চ্যালেঞ্জ।

তবু এ শুরুর দিনগুলো এক বিশেষ অধ্যায়, যা একদিকে প্রস্তুতি নেয় জীবনের বড় পরীক্ষার জন্য, আর অন্যদিকে শেখায় নতুন কিছু গ্রহণ করার মানসিকতা। এটি এক ধরনের ভ্রমণ, যেখানে বাধা-বিপত্তি থাকলেও প্রতিটি মুহূর্ত একটি মূল্যবান অভিজ্ঞতা এনে দেয়। প্রথম দিনগুলোয় কিছুটা শঙ্কা আর সংশয় থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই যাত্রা হয়ে ওঠে জীবনের অন্যতম স্মরণীয় অধ্যায়।

এছাড়া যদি মোটা দাগে বোঝার চেষ্টা করি যে প্রথম বর্ষের একজন শিক্ষার্থী সাধারণত কোন কোন বিষয়ে সমস্যার সম্মুখীন হয় তাহলে যা পাই—

  • নতুন পরিবেশে মানিয়ে চলতে না পারা।
  • বন্ধু বানাতে না পারা এবং একাকিত্বে ভোগা।
  • বন্ধুত্বে মনোমালিন্য এবং বিচ্ছেদ।
  • র‍্যাগিং, হ্যারাজমেন্ট এবং বুলিংয়ের শিকার।
  • পছন্দের বিশ্ববিদ্যালয় বা বিষয়ে ভর্তি হতে না পারার কষ্ট কাটিয়ে উঠতে না পারা।
  • পরিবারের প্রত্যাশা পূরণে হিমশিম খাওয়া।
  • যারা নিজ বাড়ি ছেড়ে বিভিন্ন জেলা শহরে স্থানান্তরিত হয়ে বিভিন্ন মেসে উঠেছে সেখানে একা গুছিয়ে উঠতে না পারা।
  • ব্যক্তিগত ট্রমা, বয়ঃসন্ধি থেকে যৌবনে পদার্পণের শারীরিক ও আবেগীয় পরিবর্তন মানিয়ে নিতে না পারা, ভবিষ্যতের ভয়, আর্থিক সংকট, পারিবারিক দায়িত্ববোধ এবং নিজস্বতা বজায় রাখতে সমন্বয়হীনতা ইত্যাদি কারণে নিজের সম্ভাবনাকে মেলে ধরতে না পারা।
  • পারিবারিক অশান্তি এবং শারীরিক ও মানসিক রোগের প্রভাব।

তরুণ শিক্ষার্থীদের আত্মপ্রেরণা, আত্মবিশ্বাস, দৃঢ়তা এবং শিক্ষক, অভিভাবক ও সিনিয়রদের সহায়তা তাদের পথ দেখায়। এসব সহায়তা তাদের জীবনের বাধা পেরিয়ে নিজের লক্ষ্যে পৌঁছতে এবং পৃথিবীতে নিজস্ব পরিচয় তুলে ধরতে অনুপ্রাণিত করে। তবে বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা একজন শিক্ষার্থীর সম্ভাবনা বা যোগ্যতাকে কমিয়ে দিতে পারে, যা তার একাডেমিক ও ব্যক্তিগত জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন পেরিয়ে ছয় বছর ধরে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কাজ করছি। সেই অভিজ্ঞতা থেকে আমি এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা শেয়ার করছি, যা নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য সহায়ক হতে পারে।

  • যে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে সেটি সম্পর্কে প্রথমেই জেনে নেয়া উচিত। এখানে পড়ালেখার ধরন কেমন, পরিবেশ কেমন, কোনো বিশেষ নিয়ম-কানুন আছে কিনা, বৃত্তি সুবিধা বা আবাসিক সুবিধা কেমন—এসব বিষয়ে আগে থেকেই ধারণা নেয়া প্রয়োজন। এর জন্য নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট একটি কার্যকর উৎস হতে পারে।
  • নিজের অবস্থান সম্পর্কে সচেতন হওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। তা হতে পারে আপনার কোনো দুর্বলতা কিংবা সক্ষমতা। যদি নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে জানা না থাকে, তবে তা কাটিয়ে ওঠা এবং যোগ্যতা অর্জন সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে নিজের পর্যবেক্ষণ এবং চারপাশের মানুষের ফিডব্যাক আপনাকে সহায়তা করতে পারে। তবে এর জন্য আপনার মধ্যে জানতে চাওয়ার আগ্রহ এবং নিজের প্রতি সৎ ও অকপট হওয়া অত্যাবশ্যক।
  • বন্ধু তৈরি করা। এক্ষেত্রে নিজের সহপাঠীদের সঙ্গে পরিচিত হওয়া দিয়ে শুরু করা যেতে পারে। বন্ধু তৈরি হয় কমন ইন্টারেস্ট দিয়ে। নিজের পছন্দের কাজ সেটা যেকোনো শখ বা দক্ষতা হতে পারে, সেটা নিয়মিত চর্চা করা এবং এই শখের ব্যাপারে সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলা।
  • কোনো বিষয়ে যদি আপনার পর্যাপ্ত জ্ঞান না থাকে, তাহলে প্রশ্ন করার এবং জানার আগ্রহ প্রকাশ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এভাবে আপনি সহজেই কোনো দলে যুক্ত হতে পারেন এবং অন্যদের সঙ্গে মিলে শিখতে ও কাজ করতে পারবেন। এতে একাকিত্ব দূর হবে এবং দলগত কাজে অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ তৈরি হবে।
  • বিপদে পড়লে দ্রুত সহযোগিতা পেতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমার্জেন্সি হেল্পলাইন (যেমন: প্রক্টর, বিভাগীয় চেয়ারম্যান, কাউন্সেলর) সংরক্ষণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। এতে প্রয়োজনের মুহূর্তে সাহায্য চাওয়া সহজ হবে।
  • একাডেমিক উৎকর্ষ অর্জনের জন্য শিক্ষক এবং সিনিয়রদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রাখা এবং পরামর্শ চাওয়ার অভ্যাস গড়ে তোলা দরকার।
  • নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ক্লাব বা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত থাকা, যা আপনাকে দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা করবে।
  • সবশেষে নিজের সীমাবদ্ধতার সঙ্গে মানিয়ে নেয়ার চেষ্টা করা এবং তা নিয়ে কথা বলার আগ্রহ তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ। এতে সমস্যা সমাধান সহজ হবে এবং আত্মবিশ্বাস বাড়বে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবন হলো নিজেকে নতুন করে গড়ে তোলার একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়। এ সময়টি অনেক সময় সহজ হয় না, কারণ প্রতিটি অভিজ্ঞতা আমাদের শেখার সুযোগ নিয়ে আসে। তাই ভুল বা শুদ্ধ নিয়ে বেশি চিন্তা না করে নিজের মনকে সবসময় শেখার জন্য প্রস্তুত রাখা প্রয়োজন। যদি এ মানসিকতা ধরে রাখা যায়, তবে যেকোনো বাধা অতিক্রম করা এবং সেটিকে নিজের দক্ষতায় পরিণত করা সম্ভব হবে।

জায়েদ বিন ফরিদ: কাউন্সেলর, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি

আরও