বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে আয়তনে সর্ববৃহৎ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। এখান থেকে হাজার হাজার শিক্ষার্থীর উচ্চ শিক্ষার যাত্রাটা শুরু হয় আনন্দের মধ্য দিয়ে আর শেষ হয় ক্যাম্পাসে কাটানো অনার্স, মাস্টার্সের আবেগময় স্মৃতিমাখা দিনগুলো স্মরণে। পুরনো বছর শেষ হতে না হতেই অনেকের শিক্ষাজীবনও শেষ হতে চলেছে। নতুন বছরের শুরুর দিকে কিংবা শেষ দিকে, নতুন নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হবে শিক্ষার্থীরা। অনেকের মাস্টার্স শেষ, তারা বাড়ি যাবে। কেউ চাকরির উদ্দেশ্যে পাড়ি জমাবে শহরে। কত শত স্মৃতি নিয়ে তাদের ফিরে যেতে হচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে অচেনা সৌন্দর্যের লীলাভূমিতে পড়তে এসেছিলেন অসংখ্য শিক্ষার্থী। এই তো সেদিন এসেছিলেন এ প্রাণের ক্যাম্পাসে, বন্ধুদের সঙ্গে খুনসুটি আর চায়ের আড্ডায় পার করেছেন অসংখ্য রাত্রি। সেগুলো এখন কেবলই স্মৃতি। বিদায় তিন অক্ষরের হলেও এর ব্যাপকতা বিস্তৃত, আদতে বিদায় শব্দটির কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। শাটল ট্রেন হয়ে আছে শিক্ষার্থীদের নিত্যদিনের সঙ্গী। এ ট্রেনে রয়েছে বন্ধুত্ব গড়ে তোলার, ধারণা বিনিময় করা ও বৈচিত্র্য উদযাপন করার স্বতন্ত্র স্মৃতি।
শাটল ট্রেনে কত আড্ডা হয়েছে। কত শত বেদনার গল্প বুকে চাপা দিয়ে হাসিমুখে বন্ধুদের সঙ্গে কাটিয়েছে সময়, আজ চলে যেতে হবে তাদের— ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে। তাদের চলার পথে অনেকে সাথি হয়েছে, চলে যাওয়ার মুহূর্তে তাদের চেহারা ভেসে উঠছে চোখের আঙিনায়। বিদায় এত বিষাদের হয় কেন, আজ বুঝতে পারছি। শাটলের পাটাতনের শব্দে মুখর হতো প্রতিটা বগি। সুরে-সুরে সুরভিত প্রতিটা শিক্ষার্থী। বাইশ কিলোমিটারের দূরত্ব মনে হতো মাত্র বাইশ মিনিটের। সময় খুব দ্রুত চলে যেত তাদের এ শাটল ট্রেনে বসলেই। সন্ধ্যার শাটল যাত্রায় দু-একজন বন্ধু এক বগিতে উঠলেই জমে যেত আড্ডা, জীবন, রাষ্ট্র, মহাবিশ্ব, কী ছিল না শাটল যাত্রার আড্ডাখানায়। আনন্দ ভ্রমণের এ যেন এক মিলনমেলা। কারণে-অকারণে হেসে উঠতে পারার স্মৃতি, হাসি-গান-আড্ডায় মাতোয়ারা সারা ক্ষণ। এ অসাধারণ প্রাণবান তারুণ্যের বাহন বলেই হয়তো চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটলও হয়ে উঠেছিল স্মৃতি জমানোর পুরনো অ্যালবাম। উদরভর্তি একঝাঁক উচ্ছল যাত্রী নিয়ে শাটল ট্রেন রাজকীয় চালে হেলেদুলে ভেঁপু বাজিয়ে চলার অনুভূতি আর কোথায় পাবে তারা।
সদ্য মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ করে চলে যাওয়া এক শিক্ষার্থীকে যাওয়ার মুহূর্তে জিজ্ঞেস করলাম, কেমন কেটেছে আপনার সময়? তিনি স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে হারিয়ে গেলেন স্মৃতির ভুবনে। বললেন, এই তো সেদিন স্টেশনতলায় শামীমকে কতবার হাসতে দেখলাম আমার লুঙ্গি পরার জন্য, কেন আমি হল থেকে লুঙ্গি পরে চলে এলাম। আমি কাউসারকে বুঝাতে পারিনি সেদিন। নিজ বাড়িতে থাকলে কী মানুষ সবসময় সেজেগুজে থাকে। এ ক্যাম্পাস তো আমার বাড়ি হয়ে গিয়েছিল।
কাঁটা পাহাড় রোডে হাঁটার সময় নিজেকে হারিয়ে ফেলতাম। মনে হতো, আমি যেন হাজার মানুষের স্মৃতিকে নিজের কাঁধে বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। দুই পাহাড়ের ওপর যখনই চোখ যেত, আমি ভুলে যেতাম আমার শিক্ষাজীবন একদিন শেষ হবে! চলে যেতে হবে এ কাঁটা পাহাড় রাস্তা ছেড়ে। আর কোনোদিন এ রাস্তায় হাঁটা হবে না। আর কোনোদিন শামীমকে পাব না, কাউসার থাকবে না। আমাদের আড্ডা দেয়ার ছলে এ রাস্তায় আর হাঁটা হবে না। ছাত্রজীবনের সবক’টি ধাপ পেরিয়ে আজ আমি শেষ ট্রেনের অপেক্ষায় স্মৃতি জড়িয়ে আছি। চোখে শুধু এখন ঝাপসা দেখি, স্মৃতির আয়নায় বিদায় শব্দের আঘাতে।
এই শেষ ট্রেনের অপেক্ষা কতটা বিষাদময়। আমরা হয়তো এর মর্মার্থ বুঝতে পারব না। কারণ আমরা এখনো এ প্রতিষ্ঠানে অধ্যায়নরত। তীরের দ্বারপ্রান্তে না এলে যেমন তীরে পৌঁছার আনন্দ বোঝা যায় না, তেমনি বিদায় দ্বারপ্রান্তে উপনীত না হলেও বিদায়ের দুঃখ, কষ্ট কিংবা বেদনা উপলব্ধি করা যায় না।
ছাত্রজীবনে আমাদের কত শত স্মৃতি থাকে, সবচেয়ে বেশি স্মৃতি আছে বিদায়কে কেন্দ্র করে। আমি স্টেজে উঠেছি বিদায়ী কবিতা আবৃত্তি করার জন্য। কিন্তু সেদিন আমি কবিতা আবৃত্তি করতে পারিনি কান্নার কারণে। সত্যিকার অর্থে বিদায় শব্দটির গভীরতা ব্যাপক। এর কোনো সীমা-পরিসীমা নেই। যদি তা হয় ট্রেনকেন্দ্রিক শিক্ষাজীবন, তাহলে এর স্মৃতি হাজার গুণ ভারী। পল্লী কবি জসীমউদ্দীনের কবিতার মতোই আপন করে নেবেন আমাদের। আমাদের প্রার্থনায় রাখবেন এ প্রত্যাশা।
ইতাঙ্গীর খন্দকার: শিক্ষার্থী, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়