কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলায় শরণার্থী হিসেবে গত ৮ বছর ধরে বসবাস করছে এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা। মিয়ানমারের জান্তা বাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে আসা এসব রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে অন্যন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করলেও আট বছর পরও প্রত্যাবাসনের কোনো উদ্যোগ নিতে পারেনি বাংলাদেশ সরকার। এমনকি যে ধরণের উদ্যোগ প্রয়োজন সেটিও করতে পারেনি সরকার। এছাড়া ভৌগোলিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণে মিয়ানমারকে কূটনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য এগিয়ে আসছে এ অঞ্চলের পরাশক্তি ভারত, চীনের মতো রাষ্ট্রগুলো। গত মার্চে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস রোহিঙ্গা সংকট সমাধানের আশ্বাসের পর এক লাখ ৮ হাজার রোহিঙ্গাকে ফেরত করার কথা জানায় মিয়ানমার সরকার। তবে সেটিও আলোর মুখ দেখেনি। এদিকে গতকাল কাতার সফরে আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক ও ভূ-কৌশলগত বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ওআইসির দেশগুলোকে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে কাতারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তবে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ও সংকট নিরসনে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টির পাশাপাশি ‘শরণার্থী নীতি’ প্রণয়নের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
বুধবার (২৩ এপ্রিল) বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে ‘রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ: বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন কূটনৈতিক কৌশলের সন্ধান’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠকে তারা এ কথা বলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক আসিফ এম শাহানের সভাপতিত্বে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালিটিকসের গবেষক আফসানা রহমান অন্তরা।
তিনি বলেন, ‘ঐতিহাসিকভাবে বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে রোহিঙ্গারা। এক মিলিয়নের ওপরের একটি জনগোষ্ঠী দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছে দেশের অর্থনৈতিক ও পরিবেশগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ কক্সবাজারে। তাদের বসবাসের ফলে প্রভাবটা পড়ছে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপর। এ জনগোষ্ঠীকে নিজ দেশে ফেরত পাঠাতে সে ধরনের কোনো উদ্যোগই দেখা যায়নি বিগত সময়ে। গত মার্চে জাতিসংঘের মহাসচিবের আশ্বাসে কিছুটা প্রত্যাশা মেলে বাংলাদেশ সরকারের। এ প্রত্যাবাসনে শুধু বাংলাদেশ বা মিয়ানমার নয় ভৌগলিক ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি, বাণিজ্যিক স্বার্থ রয়েছে। বিগত সময়ে চীন, ভারত, আমেরিকা, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ আলোচনার চেষ্টা করেও সুফল পায়নি। তার মধ্যে চীন ও ভারত বারবার বিষয়টিকে এড়িয়ে চলেছে। কারণ তাদের স্বার্থ অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক, ভারত নিজেও এ সমস্যার সম্মুখীন তবে বাণিজ্যিক প্রভাব ধরে রাখতে তারাও কার্যকরী ভূমিকা রাখছে না। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া-ইউক্রেন সংকটকে যেভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে সেটি রোহিঙ্গা শরণার্থী নিয়ে দিচ্ছে না। তবে সে তুলনায় কিছুটা কার্যকরী ভূমিকা রেখেছে আফ্রিকার রাষ্ট্র গাম্বিয়া। রোহিঙ্গা গণহত্যার অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) মামলা করেছে গাম্বিয়া। সেটি এখন বিচারাধীন রয়েছে। বাংলাদেশের বন্ধু রাষ্ট্রের মতোই ভূমিকা রাখতে পারেনি জাতিসংঘ। সম্প্রতি বিশ্বসংস্থাটির মহাসচিবের আশ্বাস কিছুটা স্বপ্ন দেখালেও সেটি কতটা কার্যকর হবে সে প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে। এছাড়া ইউরোপীয় ইউনিয়ন, আসিয়ান, বিমসটেক, ওআইসি কার্যকরী কোনো ভূমিকা পালন করতে পারে নাই।’
এ গবেষক আরো বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পরিবেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থানে বসবাস করছে রোহিঙ্গারা। কিন্তু সেখানে যে প্রভাব পড়ছে সেটি এখনই সমাধান করা না গেলে দীর্ঘমেয়াদি সংকটে পড়বে অঞ্চলটি। বাংলাদেশ মিয়ানমারের সঙ্গে বিভিন্ন সময়ে সমঝোতার চেষ্টা করেও সম্ভব হয়নি। মিয়ানমার আর্মি এটিকে ডাম্পিং গ্রাউন্ড হিসেবে গ্রহণ করে গেছে। কখনো সেভাবে গুরুত্ব দেয়নি। এখন ১ লাখ ৮ হাজার রোহিঙ্গা ফেরত নেয়া কি আদৌ আলোর মুখ দেখবে কিনা সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদেরকে বাংলাদেশের আদি নাগরিক বলে মনে করে মিয়ানমার সরকার। যেহেতু মিয়ানমার সরকারের রাখাইন রাজ্যের নিয়ন্ত্রণ নেই তাই আরাকান আর্মির অনুমতি ছাড়া রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন সম্ভব নয়। তাই সরকারকে দ্বৈত ট্র্যাক নীতি গ্রহণ করে এ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে।’
ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশের অধ্যাপক বখতিয়ার আহমেদ বলেন, ‘এ সংকটকে জাতিগত ও ধর্মীয় ইস্যু হিসেবে না দেখে একটি আঞ্চলিক সমস্যা হিসেবে দেখা উচিত। যাতে রোহিঙ্গারা তাদের ভূমিতে ফিরতে পারে। আমাদেরকে তাদের পারসেপশনটা বুঝতে হবে। এছাড়া সে দেশে তাদের নিরাপত্তা, তাদের আইডেন্টিটিকে শক্তিশালী করতে হবে।’
রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট সমাধান ও প্রত্যাবাসনকে টেকসই করতে ‘শরণার্থী নীতি’ প্রণয়ন করার কথা বলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইশরাত জাকিয়া সুলতানা। তিনি বলেন, ‘১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষর না করেও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের জন্য যা করেছে, মানবতার ইতিহাসে এমন উদারতার দৃষ্টান্ত আর কোনো দেশ স্থাপন করতে পারেনি। অথচ দেশে এক মিলিয়নের একটি জনগাষ্ঠী বসবাস করছে। এ সংকট মোকাবেলা করতে হবে দীর্ঘসময়। এখন প্রয়োজন রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন। এখন জাতিসংজ্ঞ যে আশ্বাস দিয়েছে তাতে বিশেষ আশাবাদী হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এখানে ভূরাজনীতির পাশাপাশি আন্তর্জাতিক রাজনীতি জড়িয়ে আছে। কেউ কারো স্বার্থ ছাড়া কথা বলবে না। তাই কেউ আমাদের সহযোগিতা করবে সেটা না ভেবে আমাদেরকে নিজেদের ভূমিকা পালন করতে হবে। সেজন্য সরকারকে একটি নীতি করতে হবে। যেটি হতে পারে ‘শরণার্থী নীতি’।’
বৈঠকে আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এবং কনফুসিয়াস ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. বুলবুল সিদ্দিকী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক ড. সায়মা আহমেদ, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ল এর শিক্ষক মো, মোস্তফা হোসেন, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের শান্তি, সংঘর্ষ ও মানবাধিকার বিভাগের শিক্ষক মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন, দ্য ডেইলি স্টারের সাংবাদিক এবিএম শামসুদ্দোজা সাজিন প্রমুখ।