বোরো উৎপাদন

তাপপ্রবাহ-অনাবৃষ্টিতে বাড়ছে ব্লাস্টের ঝুঁকি, ফলনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শঙ্কা

কয়েক মাস ধরেই দেশে বৃষ্টিপাত নেই। ঈদের পরদিন থেকে তাপমাত্রাও বাড়ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, গত ২ এপ্রিল থেকে আজ পর্যন্ত দেশের অধিকাংশ এলাকায় মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বিরাজ করার কথা বলা হয়েছে।

কয়েক মাস ধরেই দেশে বৃষ্টিপাত নেই। ঈদের পরদিন থেকে তাপমাত্রাও বাড়ছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাস অনুযায়ী, গত ২ এপ্রিল থেকে আজ পর্যন্ত দেশের অধিকাংশ এলাকায় মাঝারি থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বিরাজ করার কথা বলা হয়েছে। গতকাল আবহাওয়ার পূর্বাভাসেও বলা হয়েছে রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা বিভাগসহ দিনাজপুর, সৈয়দপুর, ফেনী, মৌলভীবাজার, বরিশাল ও পটুয়াখালী জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে এবং তা অব্যাহত থাকতে পারে। গ্রীষ্মের শুরুতেই এমন তাপপ্রবাহ বোরো ধানে ব্লাস্ট রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি তৈরি করেছে। এতে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী ধানের ফলন নিয়ে দেখা দিয়েছে শঙ্কা।

দেশের ধান উৎপাদনের সবচেয়ে বড় জোগান আসে বোরো মৌসুম থেকে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) তথ্যমতে, এ বছর বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ২ কোটি ২৬ লাখ টন। আর এবার বোরো আবাদ করা হবে ৫০ লাখ হেক্টর জমিতে। ফলনের লক্ষ্যমাত্রা হেক্টরপ্রতি ৪ দশমিক ৪৬ টন। আবাদকৃত জমিতে ধানের শীষ ধরতে শুরু করেছে।

এরই মধ্যে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) পক্ষ থেকে তাপপ্রবাহ থেকে ধান রক্ষায় আগাম সতর্কতা দিয়ে বিশেষ বুলেটিন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে তাপপ্রবাহের কারণে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ জেলার একটি তালিকা দেয়া হয়েছে। জেলাগুলো হলো টাঙ্গাইল, রাজবাড়ী, মানিকগঞ্জ, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, জয়পুরহাট, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, নাটোর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, ঝিনাইদহ ও যশোর।

বুলেটিনে তাপপ্রবাহের কারণে ধানের ক্ষতি রোধে জমিতে সর্বদা ৫-৭ সেন্টিমিটার পানি ধরে রাখার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। জমিতে যেন কোনোভাবেই পানির ঘাটতি না পড়ে সে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। চলমান তাপপ্রবাহে ধানের শীষ ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হওয়ায় আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। আর আক্রান্ত হলে রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার আগেই বিকালে ৫ শতাংশ জমির জন্য ১০ লিটার পানিতে ৮ গ্রাম ট্রুপার বা ৬ গ্রাম নেটিভো মিশিয়ে স্প্রে হিসেবে পাঁচদিনের ব্যবধানে দুবার ব্যবহার করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনাবৃষ্টি ও তাপমাত্রা বাড়ায় ব্লাস্টের ঝুঁকি বাড়ছে। ব্লাস্ট হয়ে গেলে বৃষ্টির পরও তা ছড়িয়ে পড়তে পারে। তখন ধানের চিটা বাড়বে। তাই আগাম ব্যবস্থা হিসেবে ওষুধ ছিটাতে হবে। আবার এখন কালবৈশাখী ঝড় হলেও ধানগাছ হেলে পড়তে পারে। এতে গাছের পাতা ঝরা রোগ দেখা দিতে পারে। তাই কৃষকদের এখন সচেতন হতে হবে।

দেশের কৃষি অনেকটাই প্রকৃতিনির্ভর। তাই আবহাওয়ার প্রতি সচেতন হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। এ বিষয়ে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের চেয়ারম্যান প্রফেসর আবু নোমান ফারুক আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তাপমাত্রা আরো বাড়লে ধান চিটা হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে, যা সার্বিক উৎপাদনের জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে। আর ব্লাস্ট হয়ে গেলে বৃষ্টি হলেও তা ছড়িয়ে পড়বে। তাই আগাম ব্যবস্থা হিসেবে ট্রুপার বা নেটিভো স্প্রে করতে হবে। এটাই কৃষকদের জন্য কমন সাজেশন। তবে এখন বৈশাখী ঝড়-বৃষ্টি হতে পারে। তখন ধান গাছ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। গাছ হেলে পড়তে পারে। তখন পাতা ঝরে পড়তে পারে। তবে ভালো বৃষ্টির পর তাপমাত্রা কমে এলে ঝুঁকিও কমে আসবে।’

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, ব্লাস্ট রোগের ছত্রাক জীবাণু ধান গাছের যেকোনো অবস্থায় আক্রমণ করতে পারে। এ রোগে প্রথমে পত্রফলকে অতি ছোট ডিম্বাকৃতি দাগ পড়ে। এ দাগের মাঝামাঝি অংশ প্রশস্ত হয়। বড় দাগগুলোর কেন্দ্রভাগ ধূসর বর্ণের হয়। এতে পাতা মরে যেতে পারে। ব্লাস্ট রোগ ধান গাছের কাণ্ডের গিঁটেও আক্রমণ করতে পারে। গিঁট পচে গিয়ে কালচে হয় এবং সহজেই ভেঙে যায়। ছড়া বা শীষের গোড়া আক্রান্ত হয়। আক্রান্ত অংশ কালচে হয়ে ভেঙে যেতে পারে, যাকে শীষ ব্লাস্ট বলে। অধিক মাত্রায় নাইট্রোজেন সার এবং বাতাসের আর্দ্রতা এ রোগের প্রকোপ বাড়ায়। এছাড়া রাতে ঠাণ্ডা, দিনে গরম ও সকালে শিশির পড়া এ রোগের প্রকোপ বাড়ায়। মাঠে এ রোগের আক্রমণ ব্যাপক হলে ধান গাছ পুড়ে বসে যাওয়ার মতো হয়। এ রোগ প্রতিরোধে জমিতে সবসময় পানি রাখার পরামর্শ দিয়েছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।

গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে বোরোর উৎপাদন ছিল ২ কোটি ১০ লাখ টন। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে ২ কোটি ৭ লাখ টন, ২০২১-২২ অর্থবছরে ২ কোটি ১ লাখ টন ও ২০২০-২১ অর্থবছর ১ কোটি ৯৮ লাখ টন ধান উৎপাদন হয়।

কৃষির বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, দীর্ঘ খরায় এবার ঠিকভাবে সেচও দেয়া যাচ্ছে না। কারণ একদিকে বিদ্যুৎ বিভ্রাট, অন্যদিকে জ্বালানি তেলের দাম বেশি। বালাইনাশকের দামও কয়েক গুণ বেশি। তাই তা খুব বেশি ব্যবহার করা যায়নি। সারের দাম বেশি থাকায় বেশি ব্যবহার হয়নি। তাই ব্লাস্ট হলে উৎপাদন ব্যাহত হতে পারে।

এ বিষয়ে কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তাপপ্রবাহে ব্লাস্ট হওয়ার আশঙ্কা আছে। আবার এটার ওষুধও আছে। তবে এটা হলে উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। এখনো তেমনভাবে ব্লাস্ট দেখা যায়নি। এখন ধান বের হচ্ছে। কিন্তু কোনো বৃষ্টি নেই। এটা একটা বড় সমস্যা। গ্রামে বৃষ্টির জন্য দোয়া করা হচ্ছে। বৃষ্টি হলে ফলন ভালো হতো।’

ব্লাস্ট বোরোর পাশাপাশি আমনেও হয়ে থাকে। এটা গমেও দেখা যায়। তবে সময়মতো ওষুধ দিতে পারলে ফলনের তেমন ক্ষতি হয় না বলে জানিয়েছেন কৃষি কর্মকর্তারা।

সার্বিক বিষয়ে এ রোগ প্রতিরোধে সরকারের প্রস্তুতি নিয়ে জানতে চাইলে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সরেজমিন উইংয়ের পরিচালক মো ওবায়দুর রহমান মণ্ডল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা এটা নিয়ে সতর্ক আছি। কৃষকদের সচেতন করা হচ্ছে। গ্রামের প্রতিটি ব্লকে কাজ করা হচ্ছে। এখনো ব্যাপকভাবে ব্লাস্টে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য পাওয়া যায়নি। তেমন কোনো পরিস্থিতি হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’

আরও