চট্টগ্রামের সমুদ্র উপকূল রক্ষায় স্থায়ী-অস্থায়ী মিলিয়ে বাঁধ আছে ৫০০ কিলোমিটারের মতো। এবার বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই অধিকাংশ বাঁধে শুরু হয়েছে ভাঙন। নিম্নমানের কাজ ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এমন ভাঙন দেখা দিয়েছে বলে অভিযোগ উপকূলবাসীর। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে কয়েক বছর আগে নির্মিত ৬৯ কিলোমিটার স্থায়ী ও পাঁচ উপজেলার ৪৯ কিলোমিটার অস্থায়ী বাঁধ। দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে আসন্ন বর্ষায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
চট্টগ্রামের উপকূলীয় এলাকাগুলো প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় নির্মিত বেড়িবাঁধ ও প্রতিরক্ষা অবকাঠামো অনেক জায়গায় ভেঙে পড়ছে। বিশেষ করে প্রকল্পের অধীনে নির্মিত ৬৯ কিলোমিটার বাঁধে ভাঙনের ফলে অরক্ষিত হয়ে পড়েছে পড়েছে সন্দ্বীপ, মিরসরাই, বাঁশখালী, সীতাকুণ্ড ও আনোয়ারা উপজেলার সমুদ্রতীরবর্তী এলাকা। বাঁধগুলোয় ব্লক সরে গিয়ে ভাঙনের সৃষ্টি হয়েছে। অর্থছাড় ও সংস্কার না হওয়ায় ও নতুন বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের ধীরগতিতে সংকট আরো তীব্র হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, উপকূলীয় এলাকার মানুষের জীবনযাত্রা এমনিতেই অনিরাপদ। সাইক্লোনের মতো দুর্যোগ ছাড়াও অমাবস্যা ও পূর্ণিমার জোয়ারে তারা ক্ষতির শিকার হন। নিয়মিত প্রাণহানি ও সম্পদ বিনষ্ট হলেও উপেক্ষিত রয়েছে নতুন বাঁধ নির্মাণ ও পুরনো বাঁধের সংস্কারকাজ। অধিকাংশ সময় নিম্নমানের কাজের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নের পর দ্রুত নষ্ট হয়ে নতুন করে সংকট তৈরি হয়। এতে প্রশাসনের নজরদারি নেই। বিগত কয়েক বছর চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় বাঁধের প্রকল্পগুলো নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের দীর্ঘসূত্রতা উপকূলবাসীর জানমালের নিরাপত্তা নাজুক অবস্থায় ফেলেছে বলে অভিযোগ তাদের।
সীতাকুণ্ড উপজেলার ছোট কুমিরা এলাকার পর্যটন কেন্দ্র আকিলপুর সৈকত। সরজমিনে দেখা যায়, উপকূলে জাহাজ ভাঙা ইয়ার্ডঘেঁষে গড়ে উঠেছে এ পর্যটন কেন্দ্র। এর পাশেই সিমেন্টের ব্লক বসিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে উপকূল রক্ষা বাঁধ। দেড়-দুই কিলোমিটারজুড়ে নির্মিত বাঁধের অন্তত ২০-২৫ জায়গায় ব্লক সরে গিয়ে বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ব্লকের নিচের মাটি সরে ডেবে গেছে। এমনকি বাঁধের পাশের মাটির সড়কটিও ভেঙে সরু হয়ে চলাচলের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। বাঁধের কাজে নিম্নমানের ও প্রয়োজনের তুলনায় কম নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করায় এর বিভিন্ন অংশ দেবে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুম শুরুর আগেই এভাবে বাঁধগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় যেকোনো সময় প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে সমুদ্রের পানি লোকালয়ে চলে আসবে বলে শঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।
সীতাকুণ্ড উপজেলার বাঁশবাড়িয়া উপকূলের বাসিন্দা মো. ইকবাল হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘এ এলাকায় স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হলেও সমুদ্রের পানির তোড়ে তা ভেঙে পড়ছে। যে ব্লকগুলো ধসে গেছে, সেগুলোর মানও ভালো নয়। ইট, পাথর ও সিমেন্টের তৈরি এসব ব্লকের নিচে মাটি সরে বড় গর্ত তৈরি হয়েছে। বাঁধের পাশের মাটির সড়কগুলোও বেশির ভাগ স্থানে ভেঙে গেছে।’ এতে বর্ষাকালে বা ঘূর্ণিঝড় হলে জোয়ারের পানি লোকালয়ে ঢুকে ব্যাপক ক্ষতি হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) তথ্যমতে, চট্টগ্রাম জেলার উপকূলীয় এলাকায় প্রায় ৫০০ কিলোমিটার স্থায়ী ও অস্থায়ী বাঁধ আছে। যার মধ্যে সন্দ্বীপে ১২ কিলোমিটার, মিরসরাইয়ে ২২, বাঁশখালীতে ২৫, সীতাকুণ্ডে দুই ও আনোয়ারা উপজেলায় আট কিলোমিটারসহ মোট ৬৯ কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। সন্দ্বীপে সাড়ে ১২ কিলোমিটার, বাঁশখালীতে ১০, আনোয়ারা, পটিয়া ও বোয়ালখালীতে আরো ১২-১৫ কিলোমিটার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে কাজ শুরুর কথা রয়েছে। তবে ৫ আগস্ট-পরবর্তী সময়ে নতুন প্রকল্পগুলোয় অর্থছাড়ে বিলম্ব হওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধ নির্মাণকাজ শুরু করতে পারেনি বলে জানিয়েছে পাউবো।
বাঁশখালী পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী অনুপম পাল বণিক বার্তাকে, ‘আনোয়ার ও বাঁশখালীতে ১২ কিলোমিটার নতুন বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের জন্য অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে এখনো কোনো অর্থছাড় হয়নি। প্রকল্পটির জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হলেও বর্ষা প্রায় চলে আসায় চলতি মৌসুমে এ প্রকল্পের কাজ আর শুরু করা সম্ভব হবে না।’
উপকূলের বিভিন্ন এলাকায় নির্মিত বাঁধে ভাঙন প্রসঙ্গে অনুপম পাল বলেন, ‘বাঁধ নির্মাণ হয় সমুদ্রের ঢেউ কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য। প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। নিম্নমানের কাজের কারণেই যে সব সময় বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয় তা নয়, নির্মাণের পর নিয়মিত মেরামত চালু রাখা গেলে দীর্ঘ সময় পর্যন্ত সুরক্ষা দেয়া সম্ভব।’
উপকূলীলের বাসিন্দারা জানান, সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরা থেকে বাঁশবাড়িয়া সৈকত ও তার সামনের অংশে যে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে সেখানে বেশির ভাগ অংশই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সমুদ্রের পানির চাপে এই বাঁধগুলো টিকতে পারছে না। প্রতি বছর কিছু সংস্কারকাজ করা হয়। কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান করতে পারছে না পানি উন্নয়ন বোর্ড।
বাঁশবাড়িয়া এলাকায় অবস্থিত ফেরিঘাটের পাশের বেড়িবাঁধ সড়কটি গত বর্ষায় সমুদ্রের ঢেউয়ের তোড়ে ভেঙে গেছে। পরে বড় বড় জিও ব্যাগ দিয়ে সড়কটি অস্থায়ীভাবে চলাচলের উপযোগী করা হয়। চলতি বর্ষায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলে সমুদ্রের পানির স্রোতে এ সড়কের অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাওয়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
সীতাকুণ্ড পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তারা জানান, মীরসরাই-সীতাকুণ্ড এলাকায় সমুদ্রতীরে জাহাজ ভাঙা শিল্পের আধিক্য রয়েছে। ইয়ার্ডের বাইরের জায়গায় সমুদ্র উপকূল রক্ষায় ব্লক বসিয়ে বাঁধ দেয়া হয়েছে। গত বর্ষা মৌসুমে ক্ষতিগ্রস্ত অংশে সংস্কার করা হয়েছে। কোনো প্রকল্প হাতে নেয়া না হলেও ক্ষতিগ্রস্ত অংশগুলো মেরামত করে উপকূল রক্ষায় সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে।
পাউবোর দেয়া তথ্যে জানা গেছে, গত সরকারের শেষ সময়ে ‘টেকসই পানি ব্যবস্থাপনা প্রকল্প-১ম পর্যায়’-এর আওতায় আনোয়ারা উপজেলায় ৫ দশমিক ১৯ ও বাঁশখালী উপজেলায় ৭ দশমিক ৫১ কিলোমিটার স্থায়ী তীর রক্ষা কাজের জন্য প্রকল্প পাশ হয়। প্রকল্পটিতে মোট ১১ দশমিক ৫৯ কিলোমিটার বাঁধ পুনরাকৃতিকরণ ও ঢাল সংরক্ষণ এবং ১ দশমিক ১০ কিলোমিটার তীর সংরক্ষণ করা হবে। এ নতুন প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৮৭৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। প্রায় তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পটির কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলে এখনো অর্থছাড় না হওয়ায় তা হয়নি। এতে প্রকল্প এলাকার বর্ষা মৌসুমে ঝুঁকি বেড়েছে। তাছাড়া সময়মতো প্রকল্পটির বাস্তবায়ন নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।
জানা গেছে, বাঁশখালী উপজেলার প্রেমাশিয়া থেকে গণ্ডামারা পর্যন্ত অস্থায়ী বাঁধ দেয়া হয়েছে ১১ বছর আগে। প্রতি বছর বাঁধ ভেঙে লোনাপানি প্রবেশ করে কৃষিজমি ও বসতবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাছাড়া বাঁশখালী উপকূলজুড়ে বেশ কয়েক জায়গায় সিমেন্টের ব্লক বসিয়ে উঁচু করে বাঁধ দেয়া হয়েছিল। অনেক জায়গায় তা দেবে গেছে। বেশকিছু স্থানে সংস্কার হলেও প্রতিবছর সমুদ্রের পানির চাপে এসব বাঁধ ধারাবাহিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। চলতি বর্ষায় বড় কোনো দুর্যোগ হলে এ এলাকায় প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
স্থানীয়রা জানান, প্রতি বছর বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় বাঁশখালী ও আনোয়ারা উপজেলার উপকূলীয় এলাকা। নতুন প্রকল্পটি ছাড়া এই এলাকায় সমুদ্র তীরবর্তী ৩৬ কিলোমিটার এবং অভ্যন্তরীণ ১০২ কিলোমিটার বাঁধসহ মোট ১৩৮ কিলোমিটার বাঁধ রয়েছে। এর মধ্যে স্থায়ী বাঁধ আছে মাত্র ২৪ কিলোমিটার। আনোয়ারা উপজেলার ১৩ কিলোমিটার উপকূলীয় ও অস্থায়ীসহ মোট বাঁধ আছে দেড়শ কিলোমিটার। কিন্তু এসব বাঁধ নিয়মিত সংস্কার কাজে ও স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতা দেখা যায়। পুরনো বাঁধগুলোর ভাঙনে তারা বর্ষা মৌসুমে জলোচ্ছ্বাসের আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন।
চট্টগ্রামের উপকূলীয় বাঁধ সংস্কার ও নির্মাণ প্রসঙ্গে কথা বলার জন্য চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী ড. তানজির সাইফ আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।