দেশে শিল্প অধ্যুষিত আট এলাকা আশুলিয়া, গাজীপুর, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, ময়মনসিংহ, খুলনা, কুমিল্লা ও সিলেটে মোট কারখানার সংখ্যা ৯ হাজার ৬৯৫। এর মধ্যে ৭৪ দশমিক ৪৫ শতাংশ বা ৭ হাজার ২১৮টি কারখানায় ফেব্রুয়ারির বেতন পরিশোধ করা হয়েছে বলে শিল্প পুলিশ সূত্রে জানা গেছে।
পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএর তথ্য অনুযায়ী, ঢাকা, চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন শিল্প এলাকায় এ খাতের মোট সচল কারখানার সংখ্যা ২ হাজার ১০৭। এর মধ্যে গতকাল দুপুর পর্যন্ত ফেব্রুয়ারির বেতন পরিশোধ করা হয়েছে ২ হাজার ৪৩টি কারখানায়। আর ঈদ বোনাস দেয়া হয়েছে ৫২৫টিতে।
ঈদের আগে প্রতি বছরই শিল্প অধ্যুষিত এলাকাগুলোয় শ্রম অসন্তোষ দেখা দেয়। গত ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী শিল্প এলাকাগুলোয় অসন্তোষ অন্যান্যবারের তুলনায় কিছুটা ভিন্ন। কেননা অভ্যুত্থানের আগে থেকেই নিয়মিত বিরতিতে নানা ইস্যুতে আন্দোলনে নামতে দেখা যায় শ্রমিকদের, যা এখনো চলমান। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অসন্তোষ হচ্ছে পোশাক শিল্পে। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে এ খাতসহ শিল্প এলাকার সব খাতের কারখানাগুলোকে নিবিড় পর্যালোচনায় রেখেছে সংশ্লিষ্ট আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, শিল্প পুলিশ ও খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠন।
বিজিএমইএ সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা ও চট্টগ্রামের সচল কারখানার মধ্যে ১৩-এর ১ ধারায় বন্ধ রয়েছে একটি কারখানা। খোলার পর কাজ বন্ধ, সবেতনে ছুটি বা শ্রমিকরা কারখানা থেকে চলে গেছেন এমন কারখানার সংখ্যা ১০। এছাড়া ৯৬ দশমিক ৯৬ শতাংশ কারখানা ফেব্রুয়ারির বেতন পরিশোধ করলেও গতকাল পর্যন্ত ঈদ বোনাস দিয়েছে কেবল ২৪ দশমিক ৯২ শতাংশ কারখানা। বাকি ৭৫ শতাংশ বা ১ হাজার ৫৮২টি কারখানার কর্মীরা এখনো ঈদ বোনাস পাননি। অবশ্য ঈদকে আনন্দময় করতে ১৫টি কারখানা তাদের কর্মীদের অর্ধেক বা পুরো মাসের বেতন দিয়ে দিয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে ঈদের পূর্বপ্রস্তুতিস্বরূপ শিল্প-কারখানায় শ্রম পরিস্থিতি নিয়ে একাধিক সভা হয়। এর মধ্যে ৬ মার্চ হয় সরকার-শ্রমিক-মালিকের ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ সভা। সেখানে সিদ্ধান্ত হয়েছিল ২০ রমজানের মধ্যে ফেব্রুয়ারির বেতন, ঈদ বোনাস ও চলতি মাসের অন্তত ১৫ দিনের বেতনসহ শ্রমিকের সব ন্যায্য প্রাপ্য পরিশোধ করা হবে। এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আজ ২০ রমজানের মধ্যে শ্রমিকের প্রাপ্য পরিশোধ হওয়ার কথা। অথচ বাস্তবতা হলো, মাসের ২০ দিন পেরিয়ে গেলেও শিল্প এলাকায়গুলোর ২ হাজার ৪৭৭টি বা ২৫ দশমিক ৫৫ শতাংশ কারখানায় এখনো শ্রমিকদের ফেব্রুয়ারির বেতন পরিশোধ করা হয়নি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সংশ্লিষ্ট এক সূত্র জানিয়েছে, মার্চের বেতন ও ঈদ বোনাস নিয়ে গড়িমসি করছেন অনেক কারখানার উদ্যোক্তারা। পাশাপাশি শ্রমিকের প্রত্যাশা অনুযায়ী ছুটি দেয়ার ক্ষেত্রেও অনীহা রয়েছে মালিকদের। শ্রম আইন অনুযায়ী, মাসের প্রথম সাত কর্মদিবসের মধ্যে শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের নিয়ম। এ সময়ের মধ্যে বড় বা ভালো কারখানাগুলোই মূলত শ্রমিকের প্রাপ্য পরিশোধ করে। বাকি কারখানাগুলো বিশেষ করে ঈদের সময়ে প্রাপ্য পরিশোধে দেরি করে।
সূত্রটি আরো জানিয়েছে, বেশির ভাগ কারখানা মালিক হয়তো দু-একদিনের মধ্যে ঈদ বোনাস পরিশোধ করবেন। কিন্তু বেতন দিতে দিতে শেষ কর্মদিবস পর্যন্ত চলে যেতে পারে। কেননা বেতন আগে পরিশোধ করলে শ্রমিকরা চলে যান। বিগত দিনগুলোয় দেখা গেছে, শিল্প এলাকার শ্রমিকরা যারা ছুটিতে যান তাদের ৫-১০ শতাংশ আর কাজে ফেরেন না।
বিজিএমইএ জানিয়েছে, নির্ধারিত সময়ে বেতন-বোনাস পরিশোধ ও ছুটি দিতে সংগঠনের পক্ষ থেকে তাগাদা অব্যাহত রয়েছে। চলতি মাসের মজুরি ও ছুটির বিষয়ে সংগঠনের সদস্যদের দিকনির্দেশনা দিয়ে গত মঙ্গলবার এক নোটিসও দিয়েছে বিজিএমইএ। প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা অনুযায়ী ঈদুল ফিতরের আগে শ্রমিক-কর্মচারীদের কমপক্ষে চলতি মাসের ১৫ দিনের মজুরি দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়। সেই সঙ্গে নিজ নিজ কারখানা, নিজস্ব শিপমেন্ট, কার্যাদেশ, প্রডাকশনের সঙ্গে সমন্বয় করে যদি সুযোগ থাকে ঈদের দুই-তিনদিন আগে শ্রমিকদের ছুটি দেয়ার কথা বলা হয়েছে নোটিসে। ঈদের ছুটিতে সড়ক, রেল ও লঞ্চযাত্রায় যেন অতিরিক্ত চাপ না হয়, সেজন্য ধাপে ধাপে শ্রমিকদের ছুটি দেয়ার জন্য বিজিএমইএকে সরকারের বিভিন্ন দপ্তর থেকে অনুরোধ করা হয়েছে বলে জানানো হয়।
সদস্য কারখানাগুলোকে দেয়া বিজিএমইএর নোটিসে শ্রম অসন্তোষের বিষয়টিও উঠে এসেছে। এ বিষয়ে সতর্ক করে বলা হয়েছে, গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী তৃতীয় কোনো পক্ষ শ্রম অসন্তোষের মতো ঘটনা ঘটানোর চেষ্টা করতে পারে। তাই প্রয়োজনে এ-সংক্রান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে স্থানীয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, কলকারখানা অধিদপ্তর অথবা বিজিএমইএর সঙ্গে আলোচনার অনুরোধ জানানো হয়েছে সদস্য কারখানাগুলোকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএর প্রশাসক মো. আনোয়ার হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের কাছে থাকা বৃহস্পতিবারের তথ্য অনুযায়ী ২৫ শতাংশের বেশি কারখানায় বোনাস হয়ে গেছে। ৯৯ শতাংশের বেশি কারখানায় পরিশোধ হয়ে গেছে ফেব্রুয়ারির বেতন। আর মার্চের অগ্রিম বেতন যেটা ন্যূনতম ১৫ দিনের দেয়ার কথা, সেটা মূলত শ্রমিকরা যেদিন ছুটিতে যাবেন সেদিন বা তার আগের দিন দেয়া হয়।’
শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিএমইএর প্রশাসক বলেন, ‘ভালনারেবল কারখানা আমরা নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছি। বড় ধরনের কোনো বিরূপ পরিস্থিতির শঙ্কা দেখছি না। ১৯ রমজান তো পার হয়ে গেল, এখন পর্যন্ত শান্তই আছে সবকিছু। ব্যাংকগুলো লিকুইডিটি সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছে।’
পোশাক কারখানাগুলোয় কিছু অদ্ভুত সমস্যাও সামনে আসছে বলে জানান আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, ‘বেতন-ভাতা যতটা না সমস্যা, তার থেকেও অদ্ভুত অদ্ভুত সমস্যা দেখা দিচ্ছে। আমাদের পর্যবেক্ষণে থাকা একটি বেল্টে ভূতের ভয় দেখা দিয়েছে। আরেকটি ক্ষেত্রে দেখলাম বেতন-বোনাস অগ্রিম দিয়ে ফেলেছে, এখন শ্রমিকরা বলছেন তাদের টানা ১২ দিন ছুটি লাগবে। কারখানা মালিক ১০ দিন দিতে সম্মত হয়েছেন। কিন্তু তা না মেনে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে গেছেন। এগুলো উটকো ঝামেলা, কোনো যুক্তিতেও পড়ে না। এভাবে কারা ডিস্ট্যাবিলাইজের চেষ্টা করছে, আশা করি তাদের ধরার চেষ্টা করবেন সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা কার্যক্রমে নিয়োজিতরা।’
শিল্প পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, আশুলিয়া এলাকার মোট ১ হাজার ৮৬৩ কারখানার মধ্যে ফেব্রুয়ারির বেতন পরিশোধ করেছে ১ হাজার ১৭১টি। গাজীপুর এলাকার ২ হাজার ১৭৬টির মধ্যে বেতন পরিশোধ করেছে ১ হাজার ৩২৮টি কারখানা। চট্টগ্রামে মোট শিল্প-কারখানার সংখ্যা ১ হাজার ৭৩৫। ফেব্রুয়ারির বেতন পরিশোধ হয়েছে ১ হাজার ৫২৪টিতে। নারায়ণগঞ্জে মোট ১ হাজার ৮০৬টির মধ্যে বেতন দিয়েছে ১ হাজার ১১৭টি কারখানা। ময়মনসিংহে ২৮৪টি কারখানার মধ্যে ২৫৮টি তাদের কর্মীদের বেতন পরিশোধ করেছে। খুলনায় মোট ৭৬৭টির মধ্যে ফেব্রুয়ারির বেতন দিয়ে দিয়েছে ৭৫৯টি কারখানা। এছাড়া কুমিল্লার ৩১৬টির মধ্যে ৩১৪টি ও সিলেট এলাকার ৭৪৮টি কারখানার মধ্যে ৭৪৭টিই বেতন পরিশোধ করেছে।
অন্যান্যবারের তুলনায় এবারের শিল্প পরিস্থিতি অনেকটা ভিন্ন বিবেচনায় নিয়ে সংশ্লিষ্ট সব অংশীজন অতিরিক্ত সতর্কতায় রয়েছে বলে জানিয়েছে শিল্প পুলিশ। এর ধারাবাহিকতায় বাহিনীটির পক্ষ থেকে ২০৩টি কারখানা চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএসহ সব খাতের কারখানা রয়েছে। গত তিন বছরের তথ্য ও পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণের মাধ্যমে চিহ্নিত কারখানাগুলোর প্রতি মাসে বেতন পরিশোধযোগ্যতাসহ বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করেছে শিল্প পুলিশ। সেগুলোর তথ্যসংশ্লিষ্ট সব অংশীজনকে জানানোও হয়েছে।
শিল্প পুলিশের অ্যাডিশনাল ইন্সপেক্টর জেনারেল মো. ছিবগাত উল্লাহ ১১ মার্চ এ বিষয়ে বণিক বার্তাকে বলেছিলেন, ‘আমরা সব ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছি। মালিকদের সহানুভূতিশীল হতে হবে। তাদের বলে দেয়া হয়েছে ২০ রমজানের মধ্যে বেতন-বোনাস পরিশোধের। এটা যেন সময়মতো পরিশোধ হয় সেই চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। সব অংশীজনকে তাগাদা দিয়ে সক্রিয় রাখার চেষ্টা করছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘এবার পরিশোধ করতে হবে ফেব্রুয়ারির বেতন, ঈদ বোনাস ও চলতি মাসের অন্তত ১৫ দিনের বেতন; যা মালিকদের জন্যও চাপের। সব মিলিয়ে আমরা মনে করছি এবার বিশেষ সতর্কতা প্রয়োজন। আমাদের প্রত্যাশা, নির্ধারিত সময়ে বেতন-বোনাস পরিশোধের পাশাপাশি ছুটিও দেয়া হোক।’