দেশের ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ মানুষের মৌলিক আটটি পরিষেবার সবক’টির অভিগম্যতা নেই। ২০৩০ সালের মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষার হার ৯৫ শতাংশে উন্নীত করার কথা থাকলেও এ হার এখনো ৭৭ শতাংশে আটকে আছে। প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ এখনো নিরাপদ পানি পায় না। পূর্ণাঙ্গ স্যানিটেশন ব্যবস্থা থেকে বঞ্চিত ৫৫ শতাংশ মানুষ। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন চ্যালেঞ্জসহ এসডিজির প্রায় সবক’টি অভীষ্ট অর্জনেই এখনো ঢের পিছিয়ে বাংলাদেশ। ২০৩০ সালের মধ্যে এসব লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে গুণগত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক জনসেবা জোরদার করার পাশাপাশি ভোটারদের কণ্ঠস্বর জোরালো করতে হবে।
গতকাল রাজধানীর বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ কনফারেন্স সেন্টারে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নের অগ্রগতি নিয়ে আয়োজিত সংলাপে এসব তথ্য জানানো হয়। ‘জাতীয় এসডিজি রিপোর্ট (ভিএনআর) ২০২৫: পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশার অন্তর্ভুক্তি’ শিরোনামে এ অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়। নাগরিক প্লাটফর্ম, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়কের দপ্তর ও জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশ যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্ম, বাংলাদেশের আহ্বায়ক ও শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সরকার বদল হওয়া আর শাসনপদ্ধতি বদল হওয়া এক জিনিস নয়। শাসন আর সরকার একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত, কিন্তু একটা থেকে আরেকটা স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয় না। এ সরকার যে কথা বলে, আর বাস্তবতা চারপাশে যেটা আছে, তা এখনো পার্থক্য রয়ে গেছে। এ পার্থক্যের ক্ষেত্রে আমরা লক্ষ করলাম, যে মানুষগুলো গণতন্ত্রের অভাবের সময়েও বিভিন্ন কারণে বিপন্ন ছিল, সে বিপন্নতা এখনো সেভাবে দূর হলো না। এটা নারী, শিশু, প্রবীণ ও দুর্গম অঞ্চলে নদীভাঙন কিংবা মরুকরণ প্রক্রিয়ায় থাকা সবার জন্য সত্য। অর্থাৎ সরকার বদল হলেও কাঠামোগত বৈষম্যের ভেতর যারা আছে, তারা একদিনে এ কাঠামোগত বৈষম্য থেকে মুক্তি পায় না। এ মুক্তির জন্য অনবরত প্রাতিষ্ঠানিক প্রচেষ্টা ও কণ্ঠস্বর (ভুক্তভোগীর) দরকার।’
মোট তিনটি অধিবেশনে অনুষ্ঠিত এ সংলাপের প্রথম অধিবেশনে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খান। তিনি বলেন, ‘আমরা হয়তো এমডিজি (সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে পারিনি, কিন্তু ২০৩০ সালের পর এসডিজির বিষয়গুলো মিথ্যা হয়ে যাচ্ছে, তা কিন্তু নয়। সেদিক থেকে সামনে যে জাতীয় নির্বাচন আসবে, আমি চাইব বাংলাদেশে যতগুলো রাজনৈতিক দল আছে, বর্তমানে যে সংস্কার প্রক্রিয়া আছে তাতে এসডিজি ও বিশেষ করে অন্তর্ভুক্তিমূলক এসডিজি বাস্তবায়ন আমরা যেন সবার ওপরে রাখি।’
অনুষ্ঠানে নাগরিক প্লাটফর্মের কোর গ্রুপ সদস্য ও সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘এসডিজিতে বলা হলো কাউকে পিছিয়ে রাখা যাবে না। এর তাৎপর্য হলো এসডিজি বাস্তবায়নের প্রক্রিয়ায় গড়ে কী উন্নতি হলো সেটা দেখলে হবে না। সমাজে যারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী আছে তাদের কী উন্নতি, অগ্রগতি হলো সেটা দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে গড় ট্রিটমেন্ট দিয়ে কখনই সমান করা যাবে না। তাদের অসম ট্রিটমেন্ট দিতে হবে। পজিটিভ ডিসক্রিমিনেশন দিয়ে কেবল তাদের সামনে আনতে পারেন। এসডিজি বাস্তবায়নে ৬০ ভাগ সময় চলে গেছে। ১৫ বছরের মধ্যে আর মাত্র পাঁচ-ছয় বছর আছে।’
ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীর কার্যালয়ের জ্যেষ্ঠ মানবাধিকারবিষয়ক উপদেষ্টা হুমা খান বলেন, ‘বাংলাদেশে প্রয়োজনভিত্তিক উন্নয়ন থেকে অধিকারভিত্তিক উন্নয়নের ওপর জোর দিতে হবে।’
অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টার এসডিজি বিষয়ক মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোর্শেদ বলেন, ‘আগে যে দুটি ভিএনআর করা হয়েছিল, সেগুলো জাতীয় পর্যালোচনার চেয়ে সরকারের প্রতি ফোকাসড ছিল। সেগুলো ঢাকার বাইরে যায়নি। জুলাই-আগস্টে তরুণদের নেতৃত্বাধীন গণ-অভ্যুত্থান আমাদের ঐতিহাসিক সুযোগ করে দিয়েছে সব নাগরিকের কণ্ঠস্বর জোরালো করার। এ সুযোগ হারানো যাবে না। আজকের (গতকাল) আলোচনা থেকে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে যেসব চ্যালেঞ্জ ও ঘাটতির কথা উঠে এসেছে, সেগুলো বিবেচনায় নিয়ে সরকার পরিকল্পনা সাজাবে।’
অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন ঢাকায় নিযুক্ত সুইজারল্যান্ডের রাষ্ট্রদূত রেটো রেঙলি, ইউএনডিপির বাংলাদেশ কার্যালয়ের আবাসিক প্রতিনিধি স্টিফেন লিলার প্রমুখ।