প্রতিশ্রুতি নেমে এসেছিল শূন্যে

জুলাই আন্দোলনে উন্নয়ন সহযোগীরাও ছিল দ্বিধান্বিত

কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন জুলাইয়ে দ্রুত এগোতে থাকে গণ-অভ্যুত্থানের দিকে। এক পর্যায়ে ১৬ বছর ধরে রাখা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় আওয়ামী লীগ সরকার। এ আন্দোলন চলাকালে শুরু থেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাপে পড়ে গিয়েছিল শেখ হাসিনা সরকার। দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল দেশের প্রধান উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বিবেচিত দেশ ও সংস্থাগুলোর মধ্যেও। এরই প্রভাব

কোটা সংস্কারের দাবিতে শুরু হওয়া ছাত্র আন্দোলন জুলাইয়ে দ্রুত এগোতে থাকে গণ-অভ্যুত্থানের দিকে। এক পর্যায়ে ১৬ বছর ধরে রাখা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হয় আওয়ামী লীগ সরকার। এ আন্দোলন চলাকালে শুরু থেকেই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চাপে পড়ে গিয়েছিল শেখ হাসিনা সরকার। দ্বিধাদ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছিল দেশের প্রধান উন্নয়ন সহযোগী হিসেবে বিবেচিত দেশ ও সংস্থাগুলোর মধ্যেও। এরই প্রভাব পড়েছে জুলাইয়ে বাংলাদেশে আসা বৈদেশিক অর্থায়নের প্রতিশ্রুতিতেও। ওই মাসে বিদেশী সহযোগীদের কাছ থেকে নতুন কোনো অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি পায়নি বাংলাদেশ।

বিশ্লেষকরা বলছেন, গন্তব্য দেশে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল বা অনিশ্চিত হলে বিদেশীরা বিনিয়োগ করে না। জুলাইয়ে আন্দোলন ঘিরে দেশে একধরনের অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছিল। সরকার তা সামাল দিতে পারবে কিনা সে বিষয়ে মনোযোগ নিবদ্ধ রেখেছিল উন্নয়ন সহযোগীরা। আবার দেশের নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক কাঠামো নাজুক হয়ে পড়ায় জুলাইয়ে আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার মতো পরিবেশও ছিল না। আর আওয়ামী লীগ সরকারও সে সময় আলাপ-আলোচনা বাদ দিয়ে আন্দোলন দমনেই ব্যস্ত ছিল বেশি। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এখন সে পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে এসেছে। তাই নতুন করে ভাবার সুযোগ তৈরি হয়েছে। 

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশের বৃহত্তম বহুজাতিক উন্নয়ন সহযোগী হয়ে উঠেছিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। সংস্থাটি থেকে জুলাইয়ে কোনো বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি আসেনি। নতুন কোনো প্রতিশ্রুতি দেয়নি বিশ্বব্যাংকও। আবার অবকাঠামো খাতে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় অর্থায়নের নতুন এক বড় উৎস হয়ে উঠছিল বেইজিংভিত্তিক এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)। সেখান থেকেও জুলাইয়ে নতুন কোনো বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। 

একই পরিস্থিতি দেখা গেছে দ্বিপক্ষীয় উন্নয়ন সহযোগীদের ক্ষেত্রেও। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী দেশ জাপান। স্বাধীনতার পর থেকেই ধারাবাহিকভাবে উন্নয়ন সহায়তা দিয়ে এসেছে দেশটি। কিন্তু জুলাইয়ে সেখান থেকেও কোনো অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। দেশে বিদ্যুৎ খাতের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় অবকাঠামো প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে রাশিয়ার অর্থায়ন ও কারিগরি সহযোগিতায়। বৈশ্বিক ভূরাজনীতির নানা মেরুকরণের মধ্যেও দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক জোরালো করে তুলেছিল শেখ হাসিনা সরকার। জুলাইয়ে মস্কোর পক্ষ থেকেও অর্থায়নের নতুন কোনো প্রতিশ্রুতি পাওয়া যায়নি। 

বড় ধরনের আন্দোলন চলমান থাকায় সে সময় বিদেশী উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে অর্থায়ন নিয়ে আলোচনা করা যায়নি বলে মনে করছেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক ড. মোস্তাফিজুর রহমান। এ প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দেশ একধরনের অনিশ্চিত অবস্থায় ছিল। তাই উন্নয়ন সহযোগীরা নতুনভাবে প্রতিশ্রুতি দেয়নি। এখন নতুন করে অগ্রাধিকার নির্ধারিত হচ্ছে। উন্নয়ন সহযোগীরাও আগ্রহ দেখাচ্ছে। নতুন করে আলাপ-আলোচনার একটি সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।’

নিকটতম প্রতিবেশী ভারত ও চীন থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর থেকেই নতুন করে আর কোনো অর্থায়ন প্রতিশ্রুতি পায়নি বাংলাদেশ। বিগত সরকার তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতা গ্রহণের পর শেখ হাসিনা একাধিকবার ভারত সফর করলেও সংকটকালে পাশে পাওয়া যায়নি দেশটিকে। যদিও দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন অধ্যায়ের কথা বরাবরই জোরেশোরে বলা হতো। আবার বহু প্রত্যাশা নিয়ে চীন সফরে গেলেও সেখান থেকে প্রায় শূন্য হাতেই ফিরতে হয়েছিল শেখ হাসিনাকে। মূলত তিস্তা প্রকল্পের অর্থায়ন নিয়ে চীন-ভারতের আগ্রহের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষায় ব্যর্থ হওয়ার কারণেই এমনটি হয়েছিল বলে সে সময় মন্তব্য করেছিলেন বিশ্লেষকরা। 

বর্তমান পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন সরকারের সঙ্গে কাজ করার ঘোষণা দিচ্ছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ও দ্বিপক্ষীয় দেশগুলো। চীন-ভারতের রাষ্ট্রদূতরা রয়েছেন তৎপর। কথা বলছেন এডিবি-বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিরাও। তবে তিস্তার মতো সংবেদনশীল প্রকল্প নিয়ে সরকার এখনই সিদ্ধান্ত নেবে না বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এ বিষয়ে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অনেকে অনেক ধরনের আলোচনা করতে আসবে। তবে সরকার এখনই তিস্তার মতো সংবেদনশীল প্রকল্পে এগোবে বলে মনে হয় না। অনেক ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সরকার এখন বিশ্বব্যাংক ও এডিবি থেকে কয়েক বিলিয়ন ডলারের অর্থায়ন সহায়তা চেয়েছে। এগুলো পেলে সেটা দেশের জন্য ইতিবাচক হবে।’ 

অর্থায়নের নতুন উৎস তৈরি বা নতুন কোনো সম্পর্ক দেখা যাবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের এ অধ্যাপক বলেন, ‘ব্রিকস কিংবা এআইআইবি থেকে কম সুদে বেশি করে অর্থায়ন খোঁজা উচিত। তাহলে দেশের ঋণ পোর্টফোলিওতে বৈচিত্র্য আসবে।’

চীন ও ভারতের পক্ষ থেকে অতীতে করা ঋণ সহায়তার সব প্রতিশ্রুতির সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন এখনো হয়নি। দেশ দুটির সঙ্গে বেশকিছু চুক্তি সই ও প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেও সেগুলো বাস্তবায়ন ও অর্থছাড়ে ধীরগতির অভিযোগ রয়েছে ঢাকার। 

চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৬ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সে সময় ‘স্ট্রেনদেনিং অ্যান্ড প্রডাকশন ক্যাপাসিটি কো-অপারেশন’ শীর্ষক এক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়। ওই চুক্তির আওতাভুক্তসহ নানা খাতে সব মিলিয়ে প্রায় ২৫ বিলিয়ন ডলারের আর্থিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছিলেন শি জিনপিং। ওই এমওইউর আওতায় বাংলাদেশে চীনা ঋণে মোট ২৭টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা ছিল। যদিও পরে ১০টি প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও অধিকাংশই আলোর মুখ দেখেনি।

ভারত তিনটি লাইন অব ক্রেডিটের (এলওসি) অধীনে বাংলাদেশকে ৭ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ২০১০ সালে দুই দেশের মধ্যে প্রথম এলওসি চুক্তি হয়। পরে ২০১৬ ও ২০১৭ সালে আরো দুটি এলওসি চুক্তি হয়। ইআরডি সূত্রে জানা গেছে, এখন পর্যন্ত এসব চুক্তির বিপরীতে অর্থায়ন মিলেছে দেড় বিলিয়ন ডলারের কম। আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় চুক্তির বিপরীতে অর্থছাড় ধীরে হচ্ছে। চুক্তির শর্ত নিয়েও রয়েছে জটিলতা। এসব চুক্তির শর্ত নিয়ে বেশ কয়েকবার দরকষাকষিও করতে হয়েছে ঢাকাকে। শেখ হাসিনার শেষ সফরেও চুক্তির শর্ত শিথিল করা নিয়ে আলোচনা হলেও চূড়ান্ত কোনো পরিবর্তনের ঘোষণা সামনে আসেনি। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. আমেনা মহসিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বিদেশীরা তখন অবস্থা পর্যবেক্ষণ করছিল। অনিশ্চয়তার মধ্যে তারা তাদের নাগরিকদের করের টাকা বিনিয়োগ করেনি। এখন পর্যটনসহ বিভিন্ন খাতে বিদেশী অর্থায়ন বাড়ানোর প্রয়াস নেয়া যেতে পারে। তবে বিদেশী বিনিয়োগ বা অর্থায়ন বাড়াতে হলে দেশে দুর্নীতিকে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে। সাংস্কৃতিক সফট পাওয়ারের দিকে নজর দিতে হবে আমাদের।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে ইআরডির শীর্ষস্থানীয় এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা বাজেট সহায়তার জন্য এরই মধ্যে এডিবি, বিশ্বব্যাংক ও কোরিয়ার সঙ্গে আলোচনা করেছি। আশা করছি তাদের থেকে দেড় বিলিয়ন ডলার শুধু বাজেট সহায়তা বাবদ পাওয়া যাবে। তাছাড়া চলমান ও নতুন প্রকল্পের অর্থসহায়তা তো রয়েছেই। এগুলো অব্যাহত থাকবে।’ 

আরও