ডেঙ্গু পরিস্থিতি

দুই সিটির মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রমে ‌গুরুত্ব পায়নি সমন্বিত ব্যবস্থাপনা

দেশে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা। জুলাইয়ের প্রথম সাত দিনেই ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। নগরীর মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে ‘‌সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা’ পদ্ধতি অনুসরণ না করে অবৈজ্ঞানিক পথে হাঁটছে দুই সিটির মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম। এতেই ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি।

দেশে প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত রোগী ও মৃতের সংখ্যা। জুলাইয়ের প্রথম সাত দিনেই ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। নগরীর মশা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মশা নিয়ন্ত্রণে ‘‌সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা’ পদ্ধতি অনুসরণ না করে অবৈজ্ঞানিক পথে হাঁটছে দুই সিটির মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম। এতেই ভয়ংকর হয়ে উঠেছে ডেঙ্গু পরিস্থিতি।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য মতে, জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ৩২০ এবং মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনের, যা আগের বছরের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। ২০২২ সালের জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ২৫৮ জন, ছিল না কোনো মৃত্যু। জানুয়ারি থেকে জুনের হিসাবে দেখা গেছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। গত বছরের ১ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৮৯ এবং একজনের মৃত্যু হয়। চলতি বছরের একই সময়ে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭ হাজার ৯৭৮ এবং ৪৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।

চলতি বছরের জুলাইয়ের প্রথম দিনেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ২৭০, মৃত্যু হয় তিনজনের। ২ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি হন ৫০৯, মারা যান দুজন। ৩ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি হন ৪৩৬, মারা যান চারজন। ৪ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি হন ৬৭৮, মারা যান পাঁচজন। ৫ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি হন ৫৮৪, মারা যান একজন। ৬ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি হন ৬৬১, মারা যান দুজন এবং ৭ জুলাই হাসপাতালে ভর্তি হন ১৮২, মারা যান একজন। অর্থাৎ জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে মোট ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৩ হাজার ৩২০ এবং মৃত্যু হয়েছে ১৮ জনের। 

কীট গবেষকরা বলছেন, সিটি করপোরেশনের মশা নিয়ন্ত্রণের পদ্ধতিতেই ভুল রয়েছে। মশা নিয়ন্ত্রণের উপযুক্ত সময় হলো যখন মশা কম থাকে। কিন্তু যখন মশা বেড়ে যায় বা মশার যন্ত্রণায় নগরবাসী অতিষ্ঠ, তখন দুই সিটি করপোরেশন মশা নিয়ন্ত্রণে মোবাইল কোর্ট, বিশেষ অভিযানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি হাতে নেয়। ভুল সময়ে গৃহীত এসব কর্মসূচিতে লাভ হয় সামান্যই। তবে গবেষকদের যুক্তি মানতে নারাজ সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা। তাদের দাবি, সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা মেনেই মশক নিধন কার্যক্রম পরিচালনা করে সিটি করপোরেশন।

প্রতি বছর জানুয়ারিতে মশার উপদ্রব বৃদ্ধি পেলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নভেম্বর থেকেই মশা বাড়তে দেখা যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জানুয়ারির আগে থেকেই যদি মশা নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তাহলে বর্ষায় ভরা মৌসুমে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না। 

এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা। বিষয়টি ব্যাখ্যা করে কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মশা নিয়ন্ত্রণে প্রথমত চারপাশের পরিবেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। অপরিচ্ছন্ন নোংরা পরিবেশে মশা বেশি জন্মে। এটি হচ্ছে ১ নম্বর এবং প্রধান কাজ। দ্বিতীয়ত, জৈবিক পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে কোথায় কোথায় মশা বেশি, কোন ধরনের মশার উপদ্রব বেশি এবং এ মশার জন্য কোন ওষুধ কতটুকু ছিটাতে হবে, তা নির্ণয় করে ওই জায়গায় ওষুধ প্রয়োগ করতে হবে। যেন এসব জায়গায় নতুন করে মশা জন্মাতে না পারে। এছাড়া মশার অতিরিক্ত প্রজনন বন্ধ করার জন্য জলাশয়ে মাছ, হাঁস ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। তৃতীয়ত, রাসায়নিক ওষুধ ছিটিয়ে মশা নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। সবশেষ সাধারণ জনগণের মাঝে সচেতনতা বাড়াতে হবে। এ চারটিকে একত্রে আমরা “‍সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা” বলি।’  

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনার বিকল্প নেই। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র আতিকুল ইসলাম চলতি বছরের জানুয়ারিতে মশা নিয়ন্ত্রণে যুক্তরাষ্ট্রের অভিজ্ঞতা জানার পর স্পষ্টই বলেছিলেন, ‘‌মশা নিধনে আমরা এতদিন ভুল পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। তাতে মশা ধ্বংস হয়নি বরং অর্থের অপচয় হয়েছে।’ এ ঘোষণার পরও ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন সঠিকভাবে সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করছে না বলে অভিযোগ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পরিচ্ছন্ন পরিবেশ এবং জৈবিক পদ্ধতিতে মশা নিয়ন্ত্রণ বাদ রেখে সিটি করপোরেশনকে দেখেছি কীটনাশকের প্রতিই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে আসছে। দুই সিটি করপোরেশনের মশক নিয়ন্ত্রণে বাজেট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, স্প্রে বা ফগার মেশিন বাদে শুধু কীটনাশক ক্রয়ে ৯০ শতাংশ বরাদ্দ দেয়া হয়, যা পুরোপুরি ভুল পদ্ধতি ও অর্থের অপচয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে গেলে মশা নিধনে তোড়জোড় করে ওষুধ ছিটানো কিংবা মোবাইল কোর্টে জোর দেয়ার পদ্ধতি সঠিক নয় বলে মনে করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হাসান সিদ্দিকী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অনবরত কীটনাশক প্রয়োগের ফলে মশার দেহে কীটনাশক সহন ক্ষমতা বেড়ে যায়। প্রতিটি প্রাণীদেহেই প্রকৃতিগতভাবে এ সহন ক্ষমতা তৈরি হয়। ফলে উচ্চমাত্রার কীটনাশক ছিটানোর পরও সহন ক্ষমতা বৃদ্ধির কারণে এখন আর আগের মতো মশা মরছে না। তাছাড়া একেক স্থানের মশার জন্য একেক ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ করতে হয়। কিন্তু সিটি করপোরেশন সব জায়গায় একই ধরনের কীটনাশক প্রয়োগ করে থাকে। ডেঙ্গু বাড়ার এটিও একটি কারণ।’

তবে সিটি করপোরেশেন সমন্বিত মশক ব্যবস্থাপনা মেনেই কাজ করছে বলে দাবি করেছেন ডিএনসিসির মেয়র আতিকুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘‌আমরা শুধু ওষুধই ছিটাই না, জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্যও ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছি। সাধারণ নাগরিক নিয়ে মিটিং করছি, মসজিদের ইমামদের নিয়ে বসেছি, লিফলেট বিতরণ করছি। আমি বারবার বলেছি, জনসচেতনতা বৃদ্ধি ছাড়া ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নয়।’ 

আরও