একসময় সুন্দরবনসহ দেশের উপকূলীয় নদীতীরের কাদায় দেখা যেত প্রচুরসংখ্যক মাডস্কিপার। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সুন্দরবনের নদীগুলোয় ‘উভচর মাছটির’ সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমতে দেখা যাচ্ছে। পরিবেশবিজ্ঞানীরা বলছেন, অনিয়ন্ত্রিত পর্যটন, প্লাস্টিকসহ নানাবিধ দূষণ ও বাছবিচারহীন অবকাঠামো নির্মাণের কারণে বাস্তুতান্ত্রিক ভারসাম্য হারাতে বসেছে সুন্দরবন। বিচরণ কমছে মাডস্কিপারের মতো প্রতিবেশসংবেদনশীল প্রজাতিগুলোর।
সুন্দরবনের মৎস্য প্রজাতিগুলোর মধ্যে এটিকেই দেখা হয় সবচেয়ে ব্যতিক্রমী হিসেবে। প্রজাতিতে মাছ হলেও এর জীবনের বেশির ভাগ সময় কাটে ডাঙায়। জলের বাইরে অবস্থানকালে বায়ুমণ্ডলের থেকে চামড়ার মাধ্যমে অক্সিজেন গ্রহণ করে টিকে থাকতে পারে মাডস্কিপার। ব্যতিক্রমী এ বৈশিষ্ট্যই মাডস্কিপারকে দূষণসহ প্রতিবেশগত পরিবর্তন সংবেদনশীল করে তুলেছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অভিঘাতে সুন্দরবনের প্রতিবেশে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে। বিশেষ করে গত দুই দশকে বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চলটিকে সিডর, আইলা, আম্পানের মতো ভয়াবহ অনেকগুলো ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের মোকাবেলা করতে হয়েছে। লবণাক্ততা বেড়েছে এখানকার নদ-নদীগুলোর। এর সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে পর্যটক ও পণ্যবাহী জলযানগুলো থেকে নিঃসৃত জ্বালানি তেলের দূষণও। বড় ধরনের হুমকির কারণ হয়ে উঠেছে আশপাশের এলাকাগুলোয় অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা কলকারখানার দূষণও। এ দূষণের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে তুলছে পর্যটকদের ফেলে যাওয়া প্লাস্টিকসহ নানা অন্যান্য বর্জ্যের। আবার বিষপ্রয়োগে মাছ শিকারের চর্চাও এখানকার জলজ প্রাণীগুলোর অস্তিত্বের জন্য হুমকি তৈরি করছে। মোটা দাগে এগুলোকেই এখন সুন্দরবনে মাডস্কিপারের মতো প্রতিবেশ সংবেদনশীল প্রজাতিগুলোর সংখ্যা কমে আসার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করছেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা।
দীর্ঘদিন ধরেই সুন্দরবনের পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে গবেষণা করেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিনের প্রধান অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী। সুন্দরবন থেকে দ্রুত মাডস্কিপার কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এর বড় একটি কারণ হলো সুন্দরবনের আশপাশের বড় অবকাঠামো। এছাড়া খুলনা ও আশপাশের জেলায় যেসব শিল্প-কারখানা আছে, সেগুলো থেকে নির্গত তরল বর্জ্য এসে সুন্দরবনের নদীগুলোয় মিশছে। নদীতে চলাচলকারী জাহাজ থেকে নিঃসৃত তেলে দূষণ বাড়ছে। ভাটার সময় এসব তরল বর্জ্য ও তেল মাটিতে মিশে যাচ্ছে। বিষয়গুলো মাডস্কিপারসহ ছোট ছোট মাছগুলোর জন্য ক্ষতির কারণ হয়ে উঠেছে। মাডস্কিপারসহ সুন্দরবনের প্রাণ-প্রতিবেশ রক্ষায় সরকারকে এখনই শক্ত ভূমিকা নিতে হবে।’
মাডস্কিপারের হ্রাস পাওয়ার বিষয়টিকে আশঙ্কাজনক হিসেবে দেখছেন নীতিনির্ধারকরাও। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির এক সাম্প্রতিক বৈঠকে সুন্দরবনে মাডস্কিপারের মতো প্রজাতিগুলোর সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে কমে আসার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠকে গবেষক সিরাজুল হোসেনের এক পাওয়ার পয়েন্ট উপস্থাপনায় দেখানো হয়, আগে সুন্দরবনে প্রচুরসংখ্যক মাডস্কিপার দেখা যেত। এক সময় প্রতি বর্গমিটারে ১০০টি মাডস্কিপার দেখা গেলেও গত তিন বছরে গড়ে প্রতি ১০ বর্গমিটারেও এ মাছ দেখা যাচ্ছে না। এটি এক ধরনের প্রজাতি বিলুপ্তি। সুন্দরবনের প্রতিবেশে পরিবর্তন আসছে। অন্য এলাকার প্রাণীর উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে আর সুন্দরবনের বাস্তুতন্ত্রের সদস্য প্রজাতি কমে যাচ্ছে। পাখি ও অন্যান্য প্রাণীর বিচরণও কম। মাছ-মধুসহ বনজ সম্পদ আহরণকারীরাও জানিয়েছেন, বনে এসব সম্পদের প্রাপ্যতা কমে যাচ্ছে। সর্বনিম্ন পর্যায়ের ব্যাকটেরিয়া প্ল্যাংকটন থেকে শুরু করে সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রাণী পর্যন্ত বনের খাদ্য শৃঙ্খলের যেকোনো পরিবর্তন মারাত্মক বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। এজন্য বনের সুরক্ষাসংক্রান্ত পদক্ষেপগুলো নেয়ার সময় খাদ্য শৃঙ্খলের ভারসাম্য রক্ষার বিষয়টিতেও মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য তানভীর শাকিল জয় বলেন, ‘মাডস্কিপার মূলত জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের মাছ। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানেই মাছটির বিভিন্ন প্রজাতির উপস্থিতি দেখা যায়। বাংলাদেশে সুন্দরবনের বাইরে এটিকে নাফ নদী ও মহেষখালী বাঁকে দেখতে পাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে এটি ডাহুক মাছ, ডাকার, ডাকুর বা চিড়িং মাছ নামেও পরিচিত।’ গবেষকরা জানিয়েছেন, মাডস্কিপার বুকের নিচে থাকা পাখার সাহায্যে মাটিতে চলাচল করতে সক্ষম। জোয়ারের সময় মাছটি পানির নিচে ও ভাটার সময় কাদামাটিতে চলাচল করতে পছন্দ করে। বাংলাদেশে কয়েক প্রজাতির মাডস্কিপার দেখা যায়। এর মধ্যে একটি হলো সাদা ফোঁটা ডাহুক। এর মাথা ও দেহের রঙ নীল এবং উজ্জ্বল বর্ণের ডোরাকাটা। চোখ থেকে বুক ও পাখার গোড়া পর্যন্ত বাদামি ডোরাকাটা। পৃষ্ঠপাখনা শুরু হয়েছে লাল বর্ণ দিয়ে। বাংলাদেশ ছাড়াও ক্রান্তীয় ও মেরু অঞ্চলের মধ্যবর্তী এলাকা, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল এবং আটলান্টিকের তীর, ভারত এবং ফিলিপাইনে এদের দেখা যায়। মাডস্কিপারের প্রধান খাবার পানি এবং কাদায় থাকা ছোট কীটপতঙ্গ। বিপদ এলে শক্ত কাদার গর্তে দ্রুত লুকিয়ে পড়ে মাডস্কিপার।
গত এক দশকে সুন্দরবনে মাডস্কিপারের সংখ্যা ব্যাপকমাত্রায় হ্রাস পেয়েছে বলে জানালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. নিয়ামুল নাসের। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘বেশকিছু মেগা প্রকল্প নির্মাণের পর থেকে মাছটিকে উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসতে দেখা যাচ্ছে। মৎস্য শিকারের বিষ প্রয়োগের কারণেও এদের মৃত্যু হচ্ছে। সুন্দরবনের মতো জায়গাও এখন মাডস্কিপারদের জন্য দ্রুত অনিরাপদ হয়ে পড়ছে।’
বিষ প্রয়োগে মৎস্য শিকারকে সুন্দরবনে মাডস্কিপারের বিচরণ কমে যাওয়ার বড় কারণ হিসেবে দেখছেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘জেলেরা মাছ ধরার জন্য নদীতে বিষ প্রয়োগ করে। অনেক সময় মাছের প্রজনন স্পটেও বিষ প্রয়োগ করা হয়। এতে করে মাছের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীও মারা যায়। অতি দ্রুত এ বিষয়ে আইনি পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। বন ও মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে জোরালো ভূমিকা না নিলে অবস্থা আরো খারাপ হবে। অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে পারলে এ ধরনের অপরাধ কমে আসবে।’
সুন্দরবনের অনিয়ন্ত্রিত পর্যটনকেও মাডস্কিপারের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, একদিকে পর্যটন নৌযানের তেল নদীতে মিশে বনে দূষণ ঘটাচ্ছে। অন্যদিকে পর্যটকদের ফেলে দেয়া প্লাস্টিক বর্জ্য গোটা সুন্দরবেনর প্রাণবৈচিত্র্যকেই হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।
এছাড়া পর্যটকদের বনের ভেতর নিয়ম না মেনে চলাচলও মাডস্কিপারদের বিচরণে ব্যাঘাত ঘটাচ্ছে বলে মনে করেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘পর্যটকরা কোনোভাবেই যাতে সুন্দরবনে সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক না নিয়ে যায়; সে বিষয়ে কঠোর আইন করতে হবে। জাহাজগুলো ঠিকমতো চলছে কিনা, সঠিক রুট ফলো করছে কিনা এগুলোও দেখভাল করতে হবে। পর্যটকরা যদি নিয়ম মেনে ভ্রমণ করত তাহলে সুন্দরবনের প্রতিবেশ অনেক ভালো থাকত। এ বিষয়ে সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে।’
মাডস্কিপার মাছটিকে এখনো বাংলাদেশে বিপন্নের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করেনি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অব নেচার (আইইউসিএন)। পরিবেশ গবেষকদের আশঙ্কা, বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে বিচরণ ও প্রজনন ব্যাহত হয়ে দ্রুতই বিপন্নের তালিকায় নাম উঠবে মাডস্কিপারের।