বৈশ্বিক
উষ্ণায়ন ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। বিশেষ করে
সারা বছরই প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে। তীব্র গরম, তীব্র শীত, হঠাৎ বন্যা ও ঘুর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের
মতো দুযোর্গের পরিমাণ গত কয়েক বছরে আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। এমন পরিস্থিতি মোকাবেলায়
বিশেষজ্ঞরা বারবার দেশে বৃক্ষের আচ্ছাদন বাড়ানোর কথা বলছেন। কিন্তু বাস্তব দৃশ্য পুরোপুরি
ভিন্ন। গবেষণার তথ্য বলছে, বিগত এক বছরে সরকারি উদ্যোগে দেশে ১১ লাখ পঞ্চাশ হাজার বৃক্ষ
নিধন করা হয়েছে। একদিকে দেশে গরমের তীব্রতা বাড়ছে, অন্যদিকে ব্যাপক হারে বৃক্ষ উজাড়
হওয়ার ঘটনা পরিবেশবিদদের ভাবিয়ে তুলছে।
গত
এক বছরে দেশে কী পরিমাণ বৃক্ষ উজাড় হয়েছে এ নিয়ে একটি গবেষণা করেছে রিভার অ্যান্ড ডেল্টা
রিসার্স সেন্টার (আরডিআরসি)। ‘লগিং অব প্লান্টস ইন বাংলাদেশ ২০২৩’ শীর্ষক ওই গবেষণা
প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী গত এক বছরে দেশে ১১ লাখ ৪৬ হাজার ৪৬৫টি বৃক্ষ কাটা হয়েছে।
আর এ পরিমাণ বৃক্ষ কাটা হয়েছে সরকারি উদ্যোগে। ২০২৩ সালের মার্চ থেকে ২০২৪ সালের মার্চ
পর্যন্ত মিডিয়া মনিটরিং করে এমন তথ্য দিয়েছে আরডিআরসি।
সংস্থাটির
তথ্য অনুযায়ী, দেশে সবচেয়ে বেশি গাছ কাটা হয়েছে চট্টগ্রাম বিভাগে। এ বিভাগেই ৫ লাখ
৬ হাজার ২২২টি গাছ কাটা হয়। এরপরই আছে নীলফামারী জেলার নাম। এখানে গাছ কাটা হয়েছে চার
লাখ ১৫২টি। সবচেয়ে কম গাছ কাটা পড়েছে রংপুর জেলায়, একটি। গত বছর সরকারি উদ্যোগে প্রতি
মাসে গড়ে ৮৮ হাজার ১৯০টি গাছ কাটা হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে গাছ কাটা হয়েছে ২ হাজার ৯০২টি।
গত এক বছরে ঢাকায় সরকারি উদ্যোগে এক হাজার ৮১টি গাছ কাটা হয়েছে। এ হিসাবে সরকার ঢাকায়
প্রতি মাসে ৮৩টি এবং প্রতিদিন ৩টি করে গাছ নিধন করেছে।
আরডিআরসির
চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘গাছ কাটার ক্ষেত্রে বড় বড় গাছগুলোই
গোনায় ধরা হয়। মাঝারি বা ছোট গাছ হিসাবে ধরা হয় না বললেই চলে। আমাদের এ গবেষণা করা
হয়েছে গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে। গাছ কাটার অনেক ঘটনাই গণমাধ্যমে
আসে না। সে হিসাবে বৃক্ষ নিধনের সংখ্যা অন্তত তিন গুণ হবে।’
সরকারের
উদ্যোগে বৃক্ষ নিধন প্রক্রিয়া সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘উন্নয়ন প্রকল্পের
নামেই বেশি গাছ কাটা পড়েছে। তিস্তা সেচ প্রকল্প, ইকো-ট্যুরিজম উদ্যোগ এবং নগর অবকাঠামো
ইত্যাদির জন্য অনেক গাছ কাটা পড়েছে। নীলফামারীতে তিস্তা সেচ প্রকল্পের জন্য ৪ লাখের
মতো গাছ কাটা পড়েছে। পাশাপাশি রাজধানীর ধানমন্ডিতে ৫০০’র মতো গাছ কাটা হয়েছে সড়কের
সৌন্দর্য বর্ধনের নামে। একইভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো
বৃদ্ধি করতে গিয়ে ৫০০’র বেশি গাছ কাটা হয়েছে। এসব গাছ কাটার জন্য দায়ী বন বিভাগসহ স্থানীয়
সরকার ইনস্টিটিউটসহ সরকারের অন্যান্য বিভাগ।’
গবেষণার
তথ্য অনুযায়ী সংরক্ষিত বনেও বিপুল পরিমাণ গাছ কেটেছে সরকার। মোট ১১টি সংরক্ষিত বন থেকে
৭ লাখ ৬ হাজার ৩২১টি গাছ কাটা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি গাছ কাটা পড়েছে চট্টগ্রামের লোহাগাড়ায়,
৫ লাখ। এরপর মহেশখালীর প্যারাবনে গাছ কাটা হয়েছে ২ লাখ। কক্সবাজারের সংরক্ষিত বনে গাছ
কাটা হয়েছে কয়েক লাখ।
সরকারি
উদ্যোগে এভাবে বৃক্ষ নিধন পরিবেশের জন্য ক্ষতির পাশাপাশি টেকসই উন্নয়নেও বাধা বলে মন্তব্য
করেছেন বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পত্রিকার হিসাবে এক বছরে সাড়ে ১১ লাখ গাছ কাটা পড়েছে। কিন্তু
বাস্তব সংখ্যা আরো বেশি হবে। সামাজিক বনায়নের নামে গাছ কাটা হয়েছে সেগুলো নিশ্চয় হিসাবে
আসেনি। আমাদের দেশে বৃক্ষ আচ্ছাদনের পরিমাণ একেবারেই কম। এর মধ্যেই যদি এক বছরের ব্যবধানে
লাখ লাখ গাছ সরকার নিজেই কেটে ফেলে তাহলে সামনে আমাদের জন্য ভালো কিছু নেই বলা যায়।
উন্নয়নের নামে গাছ কাটা হলে যে শুধু পরিবেশেরই ক্ষতি হয় তা নয়, বরং টেকসই উন্নয়নের
পথেই গাছ কাটা বড় প্রতিবন্ধক। এই যে এত গাছ কাটা হলো তখন পরিবেশ অধিদপ্তর কোথায় ছিল,
বন অধিদপ্তর কী করেছে? এজন্য তো অবশ্যই এ সংস্থা দুটির কর্মকর্তাদেরও জবাবদিহির আওতায়
আনা জরুরি।’