ত্রুটিপূর্ণ ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় বাড়ছে মৃত্যু

ভাইরাস প্রতিরোধ না করে মশা নিয়ে তৎপরতা

ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মশা নিয়ন্ত্রণে তৎপরতা বাড়লেও ডেঙ্গু ভাইরাস প্রতিরোধে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তাতে আরো বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠেছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। শুরুতেই ভাইরাসের ধরন চিহ্নিত না থাকা কিংবা এ নিয়ে কোনো পূর্বাভাস না দেয়ায় বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। পাশাপাশি জলবায়ুর পরিবর্তন আর ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধি এ সমস্যাকে আরো কঠিন করে তুলছে।

ডেঙ্গু পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে মশা নিয়ন্ত্রণে তৎপরতা বাড়লেও ডেঙ্গু ভাইরাস প্রতিরোধে কোনো ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়নি। তাতে আরো বেশি ভয়ংকর হয়ে উঠেছে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। শুরুতেই ভাইরাসের ধরন চিহ্নিত না থাকা কিংবা এ নিয়ে কোনো পূর্বাভাস না দেয়ায় বাড়ছে মৃতের সংখ্যা। পাশাপাশি জলবায়ুর পরিবর্তন আর ক্রমাগত তাপমাত্রা বৃদ্ধি এ সমস্যাকে আরো কঠিন করে তুলছে।

বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু রোগী শনাক্ত হয় ২০০০ সালে। শুরুর দিক থেকেই বিশেষজ্ঞরা ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি অনুসরণের কথা বলে আসছেন। কিন্তু এতদিনেও রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর), স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারেনি। 

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, ‘ডেঙ্গু একটি ভাইরাল ইনফেকশন। ডেঙ্গু সংক্রমিত মশার কামড়ে ডেঙ্গু ভাইরাস মানবদেহে সংক্রমিত হয়। এর বাহক হিসেবে কাজ করে এডিস মশা।’ তবে কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, এডিস মশা কামড়ালেই যে কারো ডেঙ্গু হবে এমন কোনো কথা নেই। বরং যে এডিস মশার ভেতর ডেঙ্গু ভাইরাস রয়েছে কেবল সেটি কামড়ালেই ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা চলছে ত্রুটিপূর্ণ নিয়মে। এখানে তা শুধু এডিস মশা নিধন, লার্ভা ধ্বংসের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। অথচ সঠিকভাবে ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনার জন্য ডেঙ্গু ভাইরাস নিয়েও কাজ করা প্রয়োজন। তাহলেই সামনের দিনগুলোতে মৃতের সংখ্যা কমে আসবে।

ডেঙ্গু ভাইরাস নিয়ে কাজ করার যৌক্তিকতা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ডেঙ্গুর চারটি ধরন রয়েছে। প্রথমবার ডেঙ্গু আক্রান্ত হলে তেমন আতঙ্কের কিছু নেই। দ্বিতীয়বারও ভাইরাসের একই ধরনে আক্রান্ত হলেও ভয়ের কিছু নেই। তবে কেউ যদি প্রথমবার একটি ধরন এবং দ্বিতীয়বার ভিন্ন ধরনে আক্রান্ত হন তাহলে মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে। এক্ষেত্রে মৃত্যুঝুঁকি কমানোর জন্য প্রয়োজন ভাইরাস প্রতিরোধ।

দুই সিটি করপোরেশনে বর্তমানে যে প্রক্রিয়ায় মশক ব্যবস্থাপনা চলছে, তাতে ডেঙ্গু ভাইরাসের অবস্থানকে সময়মতো আমলে নেয়া হচ্ছে না। ডেঙ্গু মৌসুমের শুরুর দিকে এ সহজ কাজটি করতে পারলে ভাইরাসের ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া প্রতিরোধ করা সহজ হতো। তাই মশা নির্মূলের উদ্যোগগুলোতে মলিকুলার সার্ভিল্যান্স ডাটা-ভিত্তিক উদ্যোগ অনেক বেশি বিজ্ঞানসম্মত এবং কার্যকর হবে বলে মনে করেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হাসান সিদ্দিকী। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পৃথিবীর কোনো দেশ এডিস মশা পুরোপুরি নির্মূল করতে পারেনি। তার ওপর জলবায়ুর পরিবর্তন আর তাপমাত্রার ক্রমাগত বৃদ্ধি এ সমস্যাকে আরো কঠিন করে তুলছে। কিন্তু আমাদের সব মনোযোগ এডিস মশার দিকে। অথচ এর পাশাপাশি ভাইরাসের প্রতিও মনোযোগী হওয়া প্রয়োজন ছিল।’

ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্তদের জটিলতা এবং মৃত্যু কমাতে মশার প্রতি মনোযোগী হওয়ার পাশাপাশি ভাইরাস নিয়ে কাজ করা জরুরি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘অধিকাংশ ক্ষেত্রে ডেঙ্গু একটি মৃদু রোগ। মশা মানুষকে কামড়াবে। জ্বর হবে। আবার ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু জটিলতা সৃষ্টি হয় মূলত সংক্রমণকারী ভাইরাসের ধরনে পার্থক্য হলে। আমাদের এখন মৃতের সংখ্যা বাড়ছে। জলবায়ুজনিত কারণসহ নানা কারণে আগামী দিনগুলোতে ডেঙ্গু আরো বাড়বে। এখন আমাদের মৃত্যুঝুঁকি কমাতে হবে। সেজন্য ভাইরাসকে আমলে নিয়ে ব্যবস্থাপনা সাজানো প্রয়োজন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর মৌসুমের শুরুতে প্রাকবর্ষা সমীক্ষা করে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো সম্পর্কে সচেতন করে দেয়। পাশাপাশি যদি ল্যাবরেটরি টেস্ট করে এ মৌসুমে কোন টাইপ ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা বেশি হবে সে তথ্য বলে দেয়া যায়, তাহলে ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় বর্তমানে যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে সেটা দূর করা যাবে।’

একটা সময় ডেঙ্গু শুধু রাজধানী ঢাকার সমস্যা ছিল। গত কয়েক বছরে ঢাকার বাইরেও ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছে। এ বছর মফস্বল পর্যায়ে ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। এ অবস্থায় ভাইরাস নিয়ে কাজ করা জরুরি উল্লেখ করে অধ্যাপক ড. মাহবুবুল হাসান সিদ্দিকী বলেন, ‘ডেঙ্গুর কোন ধরনটি কোন এলাকায় ছড়াচ্ছে এটা জানা জরুরি। ঢাকার কোনো এলাকায় যদি ডেঙ্গু টাইপ ওয়ান ছড়ায়, আবার অন্য এলাকায় টাইপ টু ছড়ায় এটা জানা থাকলে সামগ্রিকভাবে ডেঙ্গুজনিত মৃত্যু কমানো আরো সহজ হতো। ঢাকায় ডেঙ্গুর যে ধরন পাওয়া যাচ্ছে সিলেটে তো সে ধরন না-ও পাওয়া যেতে পারে। মৃত্যুর ঝুঁকি কমানোর ক্ষেত্রে ভাইরাসের টাইপ জানাটা জরুরি। এখন কিছু জানা যাচ্ছে তবে সেটা একেবারেই হাতেগোনা। এ নিয়ে বড় আকারে কাজ হওয়া প্রয়োজন। মশক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও ভাইরাসের বিষয়টি মাথায় রাখা যেতে পারে। ভাইরাস নিয়ে কাজ না হওয়ায় আমাদের ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা ত্রুটি নিয়েই চলছে।’ 

ডেঙ্গু নিয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মো, আমিনুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু ভাইরাসের প্রকোপ এখন মানব দেহে প্রকট আকার ধারণ করেছে। আমাদের সব মনোযোগ মশা নিয়ে। কিন্তু ভাইরাস ম্যানেজমেন্টে এখনো আমরা অনেক পিছিয়ে। এ নিয়ে গবেষণাও কম। আমরা কাজ করতে গিয়ে অনেক প্রতিকূলতার শিকার হয়ে থাকি। মশক ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ভাইরাস ব্যবস্থাপনারও সময় এসেছে।’ 

এডিস মশার পাশাপাশি ডেঙ্গু ভাইরাস নিয়ে কাজ হলে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেকাংশেই কমে আসবে বলে মনে  করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং হেলথ অ্যান্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের পরিচালক ডা. লেলিন চৌধুরী। এতে চিকিৎসা দেয়া আরো সহজ হবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘ডেঙ্গু ভাইরাসে প্রথমবার আক্রান্ত হলে মৃত্যুঝুঁকি থাকে না। দ্বিতীয়বার যদি আগের চেয়ে ডেঙ্গুর ভিন্ন টাইপে আক্রান্ত হয়ে থাকে তাহলে মৃত্যুর ঝুঁকি থাকে। দ্বিতীয়বার বা তৃতীয়বার আক্রান্ত রোগীদের ক্ষেত্রে উপসর্গও ভিন্ন রকম দেখতে পাই। এবার ডেঙ্গুর সবকটি টাইপের রোগীই পাওয়া যাচ্ছে। আমরা মনে করি, শুধু ডেঙ্গু নয়, যেকোনো ব্যাকটেরিয়া বা ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত মহামারী চলমান থাকলে তাদের স্বভাব-চরিত্র-ধরন নিয়ে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) গবেষণার পাশাপাশি মেডিকেল কলেজগুলোকেও গবেষণায় এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে দেশের সার্বিক চিত্র সঠিকভাবে প্রতিফলিত হবে এবং চিকিৎসা সহজ হতে পারে। কিন্তু ডেঙ্গু ভাইরাস নিয়ে আইইডিসিআর ছাড়া আর কারো কোনো কার্যক্রম আমাদের চোখে পড়েনি।’ 

ডেঙ্গু ভাইরাস ব্যবস্থাপনা নিয়ে জানতে চাইলে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুশতাক হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ডেঙ্গু রোগে আমাদের চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসা গাইডলাইন আপডেট করা হচ্ছে। এটাই ভাইরাস ম্যানেজমেন্ট। এখন সব ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা একসঙ্গে হচ্ছে। সবাই মেডিকেল কলেজে আসছে। এতে আরো জটিলতা বাড়ছে।’

আরও