দেশের রফতানি আয়ের ওপর ১ শতাংশ হারে উৎসে কর কর্তন করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। অনেক দিন থেকেই এ কর কমিয়ে আনার দাবি জানিয়ে আসছে রফতানিকারকদের বিভিন্ন সংগঠন। এনবিআরকে এ দাবি মেনে নেয়ার সুপারিশ করেছে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কার্যালয়। রফতানির উৎসে কর ১ শতাংশ থেকে কমিয়ে শূন্য দশমিক ৫০ শতাংশ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে রফতানি প্রণোদনার ওপর করহার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ নির্ধারণের সুপারিশও করা হয়েছে।
কেবল রফতানিতে উৎসে করে ছাড়ই নয়, দেশে বিদেশী বিনিয়োগ ও রফতানি আয় বাড়াতে এনবিআরকে অন্তত দুই ডজন প্রস্তাব দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এর মধ্যে মূলধনি যন্ত্রপাতির স্পেয়ার পার্টস, ইপিজেডভুক্ত প্রতিষ্ঠানের ইন্ডাস্ট্রিয়াল র্যাকিং সিস্টেম ও সহায়ক যন্ত্রাংশ, মেটাল ডিটেক্টর মেশিন এবং বিকল্প জ্বালানির কাঁচামাল আমদানিকে সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত করার প্রস্তাবও রয়েছে। গত ২৪ এপ্রিল এনবিআরের কাছে এ-সংক্রান্ত প্রস্তাব পাঠানো হয়। প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন হলে বড় ধরনের সুবিধা পাবে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) ও বাংলাদেশ রফতানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ (বেপজা)। প্রস্তাবে বলা হয়, এসব সুবিধা পেলে বিনিয়োগে উৎসাহ, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও রফতানি বাড়বে। পাশাপাশি স্থানীয় মানুষ মানসম্মত পণ্য ভোগের সুযোগ পাবে বলেও যুক্তি তুলে ধরা হয়।
বর্তমানে মূলধনি যন্ত্রপাতির কিছু স্পেয়ার পার্টস আমদানির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হারে শুল্ক ও কর পরিশোধ করতে হয়। কিন্তু প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পাঠানো প্রস্তাবে এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ শুল্কমুক্ত সুবিধা চাওয়া হয়েছে। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, উচ্চ হারে শুল্ক দিয়ে আমদানির কারণে ইপিজেডে বিনিয়োগে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। একই ধরনের সুবিধা ইন্ডাস্ট্রিয়াল র্যাকিং সিস্টেম ও সহায়ক যন্ত্রাংশ আমদানির ক্ষেত্রে চাওয়া হয়েছে। এ সুবিধা দিলে দৈনন্দিন কার্যক্রমের উৎপাদনশীলতা বাড়বে বলে প্রস্তাবে তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, এটি বাস্তবায়িত হলে আমদানি ও রফতানি করা মালাপত্র গুদামজাত সহজ হবে। মেটাল ডিটেক্টর মেশিন আমদানিতেও একই সুবিধা চেয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এনবিআরে পাঠানো প্রস্তাবে ১০ শতাংশের পরিবর্তে ২০ শতাংশ শুল্ককর ধার্য করে ইপিজেডে উৎপাদিত পণ্য স্থানীয় বাজারে বিক্রির সুবিধাও চাওয়া হয়েছে।
বিদ্যমান করনীতি অনুযায়ী, বেপজার আওতায় ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগে স্থাপিত ইপিজেডভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন স্ল্যাবে পাঁচ বছরের জন্য কর অবকাশ সুবিধা পাচ্ছে। আর এ দুই বিভাগ ছাড়া অন্যান্য বিভাগে স্থাপিত ইপিজেডভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো কর অবকাশ সুবিধা পাচ্ছে সাত বছরের জন্য। অন্যদিকে বেজার আওতাধীন ইপিজেডভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বিভিন্ন স্ল্যাবে ১০ বছরের জন্য কর অবকাশ সুবিধা পাচ্ছে। প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় এক্ষেত্রে বেজার মতো বেপজায়ও ১০ বছরের কর অবকাশ সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছে।
বিকল্প জ্বালানি সৌরবিদ্যুৎ ও উইন্ডমিলের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্কমুক্ত সুবিধা দেয়ার জন্যও প্রস্তাব দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এতে বলা হয়েছে, এটি হলে ইপিজেডভুক্ত শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোয় বিদ্যমান জ্বালানির চাহিদা কমবে।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে পাঠানো প্রস্তাবের বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাজেট প্রণয়নের সময় সব অংশীজনের কাছ থেকেই প্রস্তাব চাওয়া হয়। অংশীজনদের কাছ থেকে প্রাপ্ত প্রস্তাবগুলো আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। জনগণের ওপর থেকে করের চাপ কমিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্বের জোগান দেয়া অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। আমাদের চেষ্টা থাকবে বৈষম্য কমিয়ে দুটো কাজের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা।’
অর্থনৈতিক অঞ্চলে স্থাপিত ওয়্যারহাউজের অনুকূলে বন্ড সুবিধা পুনর্বহাল করতে সংশ্লিষ্ট আইন ও বিধিমালা সংশোধনের প্রস্তাবও দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। এতে বলা হয়, বন্ড লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রচ্ছন্ন রফতানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি এলসির বিপরীতে অন্য রফতানিমুখী বন্ড লাইসেন্সপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের কাছে সরবরাহ করার অনুমোদন দিতে বিদ্যমান বিধিবিধান সংশোধন প্রয়োজন। এছাড়া বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়কর আইনের কিছু বিধান স্পষ্টীকরণ ও সংশোধনের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে।
প্রস্তাবে বাংলাদেশে নিবন্ধিত অফিস নেই এমন অনাবাসী করদাতাদের জন্য কর শনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) নিবন্ধন সহজ করার কথা বলা হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে প্রস্তাবে বলা হয়, ফেসবুক ও ইউটিউবের মতো প্রযুক্তি সেবাগুলোর টিআইএন না থাকায় কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে বাংলাদেশ।
অন্যদিকে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (এনএসডিএ) ১০০ কোটি টাকা পর্যন্ত বাজেটের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর তৃতীয় কিস্তির অর্থ ছাড় বিষয়ে অর্থ বিভাগের পরিবর্তে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয় বা বিভাগের ওপর অর্থ ছাড়ের ক্ষমতা অর্পণের প্রস্তাব করেছে। এতে প্রকল্প কাজে গতি আসবে বলে যুক্তি তুলে ধরা হয়।
প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের প্রস্তাবের সঙ্গে দেশের একটি জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার দেয়া প্রস্তাবও সংযুক্ত করা হয়। সংস্থাটির পক্ষ থেকে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে করমুক্ত সীমা ৫০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ১ লাখ টাকা, ব্যক্তির ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে বছরে ১ কোটি টাকার বেশি নগদ লেনদেনের ক্ষেত্রে ২ শতাংশ উৎসে করহারের প্রস্তাব করা হয়েছে। নিত্যপণ্য আমদানির ক্ষেত্রে করহার ৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ ও কৃষিজাত নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্য সামগ্রী থেকে উৎসে কর প্রত্যাহার করার প্রস্তাবও করা হয়।