আনু মুহাম্মদ

জ্বালানি খাতে অন্তর্বর্তী সরকার তিনটি ভুল পদক্ষেপ নিয়েছে

তিনি বলেন, ‘এলএনজি টার্মিনাল আমাদের জন্য বোঝা। নিয়মিত গ্যাস সরবরাহের কথা থাকলেও কয়েকদিন পরপর নষ্ট হচ্ছে টার্মিনালগুলো। তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকায় গ্যাস সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ ও শিল্পকারখানার উৎপাদন।’

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার জ্বালানি খাতে তিনটি ভুল পদক্ষেপ নিয়েছে বলে দাবি করেছেন অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ। তিনি বলেন, দেশের জ্বালানি নীতি ভুল পথে অগ্রসর হচ্ছে। গত সরকার যেসব শোষণ, লুণ্ঠন, পাচার, অনাচার করেছে, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত ছিল এ অপতৎপরতার অন্যতম। অন্তর্বর্তী সরকার তিনটি ভুল পদক্ষেপ নিয়েছে। এসব থেকে যে বার্তা পাচ্ছি, তা সুখকর নয়। বাংলাদেশে পুরনো সময়ে (শেখ হাসিনা সরকারের আমলে) যা যা করা হয়েছে, সেটারই একটা ধারাবাহিকতা দেখতে পাচ্ছি।

বুধবার (৫ ফেব্রুয়ারি) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে তিনি এসব কথা বলেন। ‘কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র: অভিজ্ঞতা কী বলে?’ শিরোনামে এ সেমিনারের আয়োজন করে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)।

সেমিনারে অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘‌অন্তর্বর্তী সরকারের নেয়া তিনটি ভুল পদক্ষেপের প্রথমটি হলো ২০১০ সালের দায়মুক্তি আইন বাতিলের অধ্যাদেশ। সেখানে বলা হয়েছে, দায়মুক্তির আইনে যেসব প্রকল্প এবং চুক্তি করা হয়েছে, সেগুলো এমনভাবে অব্যাহত থাকবে যেন দায়মুক্তি আইন বাতিল হয়নি। তার মানে আগের প্রকল্প ও চুক্তি সবই অব্যাহত থাকবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘২০১০ সালে প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়া কাজ দিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন করেছিল শেখ হাসিনা সরকার। এ আইনের অধীন কোনো সিদ্ধান্তের বৈধতা নিয়ে আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না—এমন বিধান থাকার কারণে এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবে পরিচিত পায়।’

গত বছরের ২৮ নভেম্বর অন্তবর্তী সরকারের জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ‘এ আইনের অধীন সম্পাদিত সব চুক্তি বা চুক্তির অধীন নেয়া কোনো ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছে বলে গণ্য হবে। ওই সব চুক্তির চলমান কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে।’

আনু মুহাম্মদের দাবি অনুযায়ী সরকারের দ্বিতীয় ভুল পদক্ষেপ হলো রামপাল ও রূপপুরের মতো বড় প্রকল্পগুলো বাতিল না করা।

তিনি বলেন, ‘‌তারা (অন্তর্বর্তী সরকার) রামপাল নিয়ে পরিষ্কারভাবে বলছে, এসব প্রকল্প বাতিল করা খুবই কঠিন বিধায় প্রকল্পগুলো বাতিল করার কোনো সিদ্ধান্ত তারা নিচ্ছে না। অন্যান্য প্রকল্প তো বটেই, সুন্দরবন বিনাশী রামপাল প্রকল্প ভয়ংকরভাবে বাংলাদেশকে অস্থির করে দিচ্ছে। জনসম্মতির বিরুদ্ধে গিয়ে, পরিবেশ অধিকার লঙ্ঘন করে ও বিশ্ব ঐতিহ্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে রামপাল প্রকল্প নেয়া হয়েছিল। এটা বাতিল করার যুক্তি, উদ্যোগ নেয়ার অনেকগুলো উপায় আছে। সরকার কোনো চেষ্টা না করে বলে দিচ্ছে যে এটা বাতিল করা যাবে না। এটা খুবই অশনিসংকেত এবং গত সরকারের ধারাবাহিকতা বলেই আমি মনে করছি।’

গত জানুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামে যোগ দেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সফর চলাকালীন ২৪ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান আর্জেন্ট এলএনজির সঙ্গে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি সংক্রান্ত একটি নন-বাইন্ডিং চুক্তি সই করে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)। এ চুক্তিটিকে জ্বালানি খাতে অন্তর্বর্তী সরকারের নেয়া তৃতীয় ভুল পদক্ষেপ বলে অবহিত করেন আনু মুহাম্মদ।

তিনি বলেন, ‘এলএনজি টার্মিনাল আমাদের জন্য বোঝা। নিয়মিত গ্যাস সরবরাহের কথা থাকলেও কয়েকদিন পরপর নষ্ট হচ্ছে টার্মিনালগুলো। তাদের ওপর নির্ভরশীল থাকায় গ্যাস সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে, ব্যাহত হচ্ছে বিদ্যুৎ ও শিল্পকারখানার উৎপাদন।’

বিডার চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীকে ইঙ্গিত করে আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এলএনজি থেকে বের হওয়া। বেরুনোর রাস্তা না খুঁজে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হয়ে না বুঝে তিনি ওখানে গিয়ে মার্কিন সংস্থার সঙ্গে চুক্তি করেছেন। পরে এসে বলছেন সমঝোতা চুক্তি। চুক্তির বিষয়ে পেট্রোবাংলা জানে না। তার মানে কী রকম একটা অস্বচ্ছ প্রচেষ্টা! এ চুক্তির পেছনে কী কোনো টেন্ডার হলো? এ কোম্পানিকে বাছাই করা হলো কীভাবে? পুরো প্রক্রিয়াটাই শেখ হাসিনা আমলের ধরন।’

এ অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ বাংলাদেশের জন্য অভিশাপ। এই পদক্ষেপ বিদ্যুতের সরবরাহ অনিশ্চিত করে তুলেছে। আমাদের গ্যাস অনুসন্ধানের জাতীয় সক্ষমতা বাড়ানো হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে মনোযোগ বাড়ানো হবে। তাহলে জ্বালানি ব্যয় কমিয়ে এনে মানুষের ওপর ক্রমান্বয়ে ঋণের বোঝা কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।’

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্কের (বেন) প্রতিষ্ঠাতা ও বাপার সহ-সভাপতি অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি ২০০৮-এ বলা হয়েছে, দেশের মোট জ্বালানিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ ২০১৫ সালের মধ্যে ৫ শতাংশে এবং ২০২০ সালের মধ্যে ১০ শতাংশে উন্নীত করা হবে। তবে পরিতাপের বিষয়, ২০২০ সনের লক্ষ্য মোটেও অর্জিত হয়নি। নবায়নযোগ্য জ্বালানি সংক্রান্ত সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮ সাল নাগাদ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে মাত্র ৩৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয়েছে, যা কিনা ২০২০ সালের লক্ষ্যমাত্রার মাত্র ১২ শতাংশ। ২০৪১ সাল নাগাদ মোট জ্বালানিতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির অংশ ৪০ শতাংশে বাড়ানো হবে বলে কপ-২৬ সম্মেলনে ঘোষণা দেয় বাংলাদেশ। অতীতের নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতির আলোকে বাংলাদেশ কীভাবে এ লক্ষ্য অর্জন করবে, তা বলা কঠিন।’

সেমিনারে রামপাল ও মাতারবাড়ীর বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে, তা তুলে ধরেন স্থানীয় ভুক্তভোগীরা।

বাপার সাধারণ সম্পাদক মো. আলমগীর কবিরের সঞ্চালনায় সেমিনারে আরো বক্তব্য রাখেন জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. এম এম আকাশ, সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল অ্যান্ড জিওগ্রাফিক ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (সিইজিআইএস) পরিচালক মোহাম্মদ মোক্তারুজ্জামান প্রমুখ।

আরও