কথায় আছে, অর্থ আর সামর্থ্য থাকলে বাজার থেকে কিনে আনা যায় যেকোনো পণ্য। তবে তা যদি হয় দুই কক্ষ এবং এক বারান্দাবিশিষ্ট টিন ও কাঠের ঘর। শুনতে অবাক লাগলেও এমন অন্তত অর্ধশত ঘরের হাট গড়ে উঠেছে মুন্সিগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায়।
পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী, ইছামতী নদীকে ঘিরে গড়ে উঠেছে মুন্সিগঞ্জ। প্রতি বছর বর্ষা মৌসুমে পদ্মা ও মেঘনার ভাঙনে বিলীন হয় বহু মানুষের বসতভিটা। ভাঙন দেখা দিলেই ঘরবাড়ি ভেঙে সরিয়ে নিতে হয় নদীর পাড়ের বাসিন্দাদের। এজন্যই কয়েক বছর ধরে চাহিদা বেড়েছে টিন ও কাঠের তৈরি রেডিমেড ঘরের। চাইলেই একটি ঘর যেমন সহজে কেনা যায়, নামমাত্র টাকা লোকসান দিয়ে সেটি বিক্রিও করা যায়। যেকোনো হাট থেকে ঘর কিনে, একদিনের মধ্যেই বসবাসের উপযোগী করে তোলা যায়।
সদর উপজেলার চুড়াইন, বজ্রযোগিনী, হাতিমারা ও লৌহজং উপজেলার ঘোড়দৌড় কাঠপট্টি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতাদের চাহিদা অনুযায়ী ২ লাখ থেকে শুরু করে ৩৭ লাখ টাকা দামের রেডিমেড ঘর হাটে তুলেছেন ব্যবসায়ীরা। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা জানান, ভালো মানের কাঠ ও টিন দিয়ে তৈরি ঘরে পর্যাপ্ত আলো-বাতাস থাকে। আবহাওয়ার সঙ্গে ঘর দ্রুত ঠাণ্ডা ও গরম হয়। এসব ঘরের বিভিন্ন অংশ খুলে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে নেয়া যায় সহজে। প্রয়োজনে বিক্রিও করা যায়। একসময় বার্মার লোহাকাঠ, শালকাঠ ও টিন দিয়ে এ ঘর তৈরি করা হলেও বর্তমানে নাইজেরিয়ান লোহাকাঠ, সেগুন কাঠ ও টিন দিয়ে অধিকাংশ ঘর তৈরি করা হচ্ছে। লোহাকাঠ দিয়ে নির্মিত ঘরগুলো সাধারণত ৫৫ থেকে ১০০ বছর পর্যন্ত স্থায়ী হয়। একেকটি টিন ও কাঠ দিয়ে তৈরি ঘর এক থেকে তিনতলা পর্যন্ত হয়। হাটে ২ থেকে ৮ লাখ টাকা পর্যন্ত দামের ঘর বিক্রি হয় সবসময়। তবে অনেকেই বাড়িতে মিস্ত্রি এনে ২০-২৫ লাখ টাকা ব্যয়েও দুই-তিনতলা প্রাসাদের মতো ঘর তৈরি করেন। নান্দনিক ডিজাইনের কারণে মুন্সিগঞ্জের সবক’টি উপজেলায় এ ধরনের ঘরের প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে মুন্সিগঞ্জের চরাঞ্চল অথবা প্রত্যন্ত গ্রামের প্রবাসীদের প্রথম পছন্দ রেডিমেড ঘর।
টঙ্গীবাড়ী উপজেলার বালিগাঁও, কুন্ডের বাজার, দিঘিরপাড়, বাড়ৈপাড়া, কালীবাড়ি, কামারখাড়াসহ বিভিন্ন এলাকায়ও রয়েছে ঘর বিক্রির হাট। শ্রীনগর উপজেলার শ্রীনগর-দোহার সড়কের বালাশুর বটতলা ও কামারগাঁও এলাকার রাস্তার পাশে খোলা স্থানে ঘর সাজিয়ে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা। একই উপজেলার ভাগ্যকুল এলাকায়ও রয়েছে ঘর তৈরির কারখানা। সিরাজদিখান উপজেলার বালুচর, ইছাপুরা, লৌহজং উপজেলার নওপাড়া, মালিলংক, হাট বুগদিয়া, বড় নওপাড়া এলাকায়ও রয়েছে ঘর বিক্রির হাট। তবে ঘর তৈরির জন্য প্রসিদ্ধ স্থান হচ্ছে সদর উপজেলার বজ্রযোগিনী ইউনিয়নের চুড়াইন গ্রাম। এ গ্রামের প্রায় সব বাড়ির পাশে দেখা মিলে পরিত্যক্ত ভিটায় বিক্রির জন্য বিভিন্ন ডিজাইনের ঘর সারি সারি সাজিয়ে রাখতে।
বজ্রযোগিনী ইউনিয়নের প্রবীণ ঘর ব্যবসায়ী আওলাদ ট্রেডার্সের মালিক আওলাদ মৃধা বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এ পেশায় আছি। মাসে ১০-১২টি ঘর বিক্রি করতে পারি। টিন ও কাঠের দাম বেড়ে যাওয়ায় ঘরের দামও বেড়েছে। এজন্য ক্রেতারা ঘর কিনতে এসেও দাম শুনে পরে কিনবেন বলে চলে যাচ্ছেন অনেকে। ঘরের হাটে একাধিক ডিজাইনের ঘর থাকে সবসময়। যেমন ২৩ ঘর (দৈর্ঘ্য-প্রস্থ ২৩ ফুট), আই-২৩, টব, নাক-টিন, লালচালা, নীলচালা, সবুজ চালাসহ বিভিন্ন ধরনের ঘর। এসব ঘরে নানা রঙের উন্নতমানের টিন ব্যবহার করা হয়। এছাড়া অর্ডার অনুযায়ী ঘর বানিয়ে দেয়া হয়। অধিকাংশ ঘরে নাইজেরিয়ান লোহাকাঠ ব্যবহার করা হয়।’
জেলা প্রশাসক আবু জাফর রিপন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মুন্সিগঞ্জ জেলাজুড়ে রেডিমেড ঘর বিক্রির একটি ঐতিহ্য রয়েছে। বর্তমানে দেশজুড়ে এর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছে। চাহিদাও বেড়েছে কয়েক গুণ বেশি। যেহেতু দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ এখানে রেডিমেড ঘর কিনতে আসে, তাই তাদের কোনো সহযোগিতার প্রয়োজন হলে জেলা প্রশাসন করবে।’
এছাড়া প্রতিনিয়ত ব্যবসায়ীদের খোঁজখবর রাখা হচ্ছে। এ পেশার সঙ্গে নিয়োজিত শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নে সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের আওতায় আনা হবে। এছাড়া যদি তরুণ উদ্যোক্তা তৈরি হয় তাদের স্বল্প সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা হবে।’