দুর্গম অঞ্চলের কমিউনিটি ক্লিনিক

পরিপূর্ণ প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পাচ্ছে না তৃণমূলের মানুষ

গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি ও প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আড়াই যুগ আগে কমিউনিটি ক্লিনিকের যাত্রা হয়।

গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টি প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আড়াই যুগ আগে কমিউনিটি ক্লিনিকের যাত্রা হয়। এরপর সময়ে সময়ে ক্লিনিকের সংখ্যা বেড়ে প্রায় ১৫ হাজারে দাঁড়িয়েছে। কমিউনিটিভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় মাতৃ শিশু স্বাস্থ্য, টিকাদান কর্মসূচিসহ রোগ প্রতিরোধমূলক কার্যক্রমে আন্তর্জাতিক সুনাম রয়েছে প্রতিষ্ঠানের। তবে কমিউনিটি ক্লিনিকের অবকাঠামো পুরনো হওয়ায় মোট সংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশের বেশি সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশেষ করে দুর্গম অঞ্চলের মানুষ সেবা পাচ্ছে না। স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর অপ্রতুলতা, রোগ সংক্রমণ নিয়ে সঠিক ধারণার অভাব এবং সেবার মান নিশ্চিত করতে না পারায় কমিউনিটি ক্লিনিকের প্রতি গ্রামের মানুষের আগ্রহ হারাচ্ছে।

স্বাস্থ্য পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কমিউনিটি বেইজড হেল্থ কেয়ার (সিবিএইচসি) সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালে গ্রামাঞ্চলের প্রতি ছয় হাজার মানুষের জন্য একটি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের পরিকল্পনা করে সরকার। ১৯৯৮-২০০১ সাল পর্যন্ত সময়ে ১০ হাজার ৭২৩টি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়। তবে সরকার পরিবর্তনের কারণে কার্যক্রমটি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে। পরে স্বাস্থ্য পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের বাস্তবায়নে ২০০৯ সালে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো আবার সেবা দেয়ার উপযোগী করার উদ্যোগ নেয়া হয়। লক্ষ্যে পাঁচ বছর মেয়াদি একটিপতাকাবাহী প্রকল্প দ্বিতীয়বারের মতো হাতে নেয় সরকার। ২০০৯-২০১৫ সাল পর্যন্ত সময়ে হাজার ৬২০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০ হাজার ৬২৪টি ক্লিনিকের সংস্কার হাজার ৭৩৭টি নতুনভাবে নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। ২০২২ সাল পর্যন্ত সারা দেশে কমিউনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ৮৯০টিতে। এসবের মধ্যে সাত-আট হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার।

স্বাস্থ্য পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, ১৯৯৮-২০২১ সাল পর্যন্ত ১৪ হাজার ১৪১টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়েছে। শুরুর দুই বছরে ১০ হাজার ৭২৩টি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয় স্বল্প ব্যয়ে। এসব ক্লিনিকের আয়ুষ্কাল প্রায় শেষ।

সারা দেশের পাঁচ জেলার এক হাজার কমিউনিটি ক্লিনিকের তথ্য বিশ্লেষণ, সরজমিন পরিদর্শন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কোথাও কোথাও কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা ব্যবস্থাপনা ভেঙে পড়েছে। বরিশাল বিভাগের দ্বীপ জেলা ভোলার চরাঞ্চলের কমিউনিটি ক্লিনিকের সেবা ব্যাহত হচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে ক্লিনিকেরই জরাজীর্ণ ভবন, কর্তৃপক্ষের তদারকির অভাব, কর্মীদের অদক্ষতা, অকেজো নলকূপ, অস্বাস্থ্যকর স্যানিটেশন ব্যবস্থা, বিদ্যুতের ব্যবস্থা না থাকা ওষুধের অপ্রতুল সরবরাহ।

ভোলার স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যানুযায়ী, সাত উপজেলায় কমিউনিটি ক্লিনিকের সংখ্যা ২২১টি। এর মধ্যে ১৯৭টি ক্লিনিকেই নেই বৈদ্যুতিক সংযোগ বা সৌর শক্তি। প্রতিটিতে একটি করে গভীর নলকূপ থাকলেও শতাধিক নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ৩৭টি ক্লিনিকের ছাদ চুইয়ে পড়ে বৃষ্টির পানি। কংক্রিটের মেঝে ডেবে গেছে ৬৩টির। দুর্গম চরাঞ্চলের মধ্যে চরফ্যাশন উপজেলার ঢালচর, কুকরিমুকরি, মনপুরা উপজেলার চরনিজাম, তজুমদ্দিন উপজেলার মলংচড়া সোনাপুর, দৌলতখান উপজেলার মদনপুর, ভোলা সদর উপজেলার মাঝের চরে রয়েছে ১৩টি ক্লিনিক। প্রায় ২০ হাজার মানুষের বসবাস সদর উপজেলার বিচ্ছিন্ন মাঝের চরে। ওই অঞ্চলে একটি মাত্র কমিউনিটি ক্লিনিকে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীদের একদিনের বেশি পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ রয়েছে। একই অবস্থা দেখা গেছে রাজাপুরের চর সুলতান আলী কমিউনিটি ক্লিনিকে।

বিষয়ে ভোলার সিভিল সার্জন ডা. কেএম শফিকুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ক্লিনিকগুলোর স্বাস্থ্য সহকারী পদে স্থানীয় এলাকার লোক নিয়োগ করার কথা থাকলেও যোগ্যতা অনুযায়ী জনবল পাওয়া যায় না। ফলে যারা নিয়োগ পান তাদের বিরুদ্ধে কর্মস্থলে সঠিকভাবে উপস্থিত না হওয়ার অভিযোগ পাওয়া যায়।

দেশের উত্তরাঞ্চলের জেলা কুড়িগ্রামেও কমিউনিটি ক্লিনিকে প্রত্যাশিত সেবা না পাওয়ার কথা জানিয়েছেন সেবা প্রত্যাশীরা। সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নের ঝুনকার চরের বাসিন্দা মাইনুদ্দিন জানান, সেখানে অন্তত এক হাজার বাসিন্দা রয়েছে। ভারতের সীমান্তবর্তী হওয়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার জন্য পাড়ি দিতে হয় ব্রহ্মপুত্র নদ। নৌকায় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হয় যাত্রাপুর হাটে। ওই হাট থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরত্বের হাসপাতালে যান তারা। এতে করে তাদের ব্যয় বেড়ে যায়। একই অবস্থা উলিপুর উপজেলার মুসার চরের। সেখানে নেই কমিউনিটি ক্লিনিক।

জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের তথ্যমতে, মূল ভূখণ্ড বাদে জেলায় চার শতাধিক চরে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের বসবাস। নয়টি উপজেলায় ২৯৫টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে চরাঞ্চলে রয়েছে ৫০টি। নদী ভাঙনে বিলীন হয়েছে ছয়টি। প্রায় ৪০০ চরে নেই কোনো কমিউনিটি ক্লিনিক।

হাওর বেষ্টিত সুনামগঞ্জে ২৬৩টি কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। সদর উপজেলাসহ বিভিন্ন উপজেলার ৪০টির বেশি ক্লিনিকের ভবন জরাজীর্ণ হওয়ায় সংস্কার করা হচ্ছে। জেলা সিভিল সার্জন ডা. আহম্মদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মোট ক্লিনিকের মধ্যে প্রায় ১৫টির ভবন পুরনো। সেগুলো নির্মাণ করা হচ্ছে। আরো ৪০টি ক্লিনিক সংস্কার করা হচ্ছে।

নোয়াখালীতে ২৯২টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মধ্যে ৫০টি মেরামত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ জানিয়েছে, যেসব ক্লিনিক জরাজীর্ণ, সেগুলোর তালিকা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে পাঠানো হয়েছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্যসেবা, স্বাস্থ্যশিক্ষা সচেনতার প্রথম স্তর কমিউনিটি ক্লিনিক। গ্রামীণ পর্যায়ে প্রতিরোধমূলক সাধারণ চিকিৎসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান। মহামারি দীর্ঘমেয়াদি রোগ প্রতিরোধ, শিশু স্বাস্থ্য, পুষ্টি, প্রসূতিসেবা পরিবার পরিকল্পনার সেবাসহ সব ধরনের সাধারণ সেবার জন্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নির্ভর করতে হয় কমিউনিটি ক্লিনিকের ওপর।

সার্বিক বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. আবু জামিল ফয়সাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা বাস্তবায়নে কমিউনিটি ক্লিনিক অত্যধিক গুরুত্বপূর্ণ। প্রান্তিক মানুষের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান স্বাস্থ্য সচেতনতা সৃষ্টিতেও অন্যতম। কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমেই সর্বজনীন স্বাস্থ্য কভারেজ (ইউএইচসি) করা সম্ভব।

কমিউনিটি ক্লিনিক স্বাস্থ্য সহায়তা ট্রাস্টের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘অনেক কমিউনিটি ক্লিনিকের আয়ু নেই। সেগুলো চিহ্নিত করা হচ্ছে। মানুষের দোড়গোড়ায় প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে উদ্যোগ।

(প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন ভোলা প্রতিনিধি এইচ এম জাকির, নোয়াখালীর অমৃত লাল ভৌমিক সুমন, কুড়িগ্রামের বাদশা সৈকত সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি আল আমিন)

আরও