পাহাড়ি ঢল আর অতিবৃষ্টিতে সৃষ্ট বন্যায় বিপর্যস্ত দক্ষিণ ও পূর্বাঞ্চলের আট জেলা। এরই মধ্যে বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে ছয়টি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে। এসব এলাকার অনেকগুলো উপকেন্দ্র রয়েছে বন্যার ঝুঁকিতে। এ সংকটের কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে ফেনী ও নোয়াখালী এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে। বিদ্যুৎ সরবরাহ বিঘ্নিত হচ্ছে আরো অন্তত পাঁচটি জেলায়। এ কারণে বন্যাকবলিত জেলার অন্তত আট লাখ গ্রাহক বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছে।
এসব জেলায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ও বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। বিতরণকারী সংস্থা দুটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বন্যার কারণে ফেনী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার, লক্ষ্মীপুরের বেশকিছু অঞ্চলে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। বিদ্যুতের অন্তত দুটি উপকেন্দ্রে পানি প্রবেশের কারণে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাকি কিছু উপকেন্দ্র তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছে। বেশকিছু উপকেন্দ্র উঁচুতে হওয়ায় সেগুলোয় কোনো ঝুঁকি নেই বলে জানান বিতরণকারী প্রতিষ্ঠান দুটির কর্মকর্তারা।
বিপিডিবির সদস্য (বিতরণ) মো. রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্যার কারণে বিপিডিবি কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার একটি উপকেন্দ্রে পানি উঠেছে। সেখানে ট্রান্সমিটার পানি স্পর্শ করেছে। ঝুঁকি এড়াতে ওই উপকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে। এছাড়া বিপিডিবির আওতাধীন এখন পর্যন্ত অন্য উপকেন্দ্রগুলো সুরক্ষিত। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে একটি বন্ধ থাকলেও অন্যটির সঙ্গে ফিডার সংযুক্ত করে দিলে পুনরায় বিদ্যুৎ ফিরিয়ে আনা সম্ভব।’
এদিকে, বন্যার কারণে বিপিডিবির আওতাধীন আঞ্চলিক কার্যালয়গুলোর সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর ছুটি বাতিল করেছে বিপিডিবি। কোথাও কোনো ঝুঁকি দেখা দিলে এবং পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কবলিত এলাকায় বিদ্যুৎ সংযোগ পুনরায় স্থাপন করা যায় সেজন্য সার্বক্ষণিক লোক নিয়োজিত করেছে সংস্থাটি।
বিপিডিবি জানিয়েছে, বন্যার কারণে নোয়াখালীসহ অন্যান্য জেলায় বিপিডিবির যে পরিমাণ গ্রাহক রয়েছে তার মধ্যে ১৬-১৭ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎহীন অবস্থায় রয়েছে। পানি বাড়লে কিংবা খুঁটি উপড়ে পড়লে, গাছের ডাল কিংবা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটলে এ সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি।
বন্যার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফেনীর মানুষ। এ জেলার অন্তত আড়াই থেকে তিন লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জেলার ফুলগাজী, পরশুরাম ও ছাগলনাইয়ার প্রায় ৯৫ শতাংশ এলাকা পানিতে ডুবে গেছে। বন্যাদুর্গতদের উদ্ধারে সেনাবাহিনীর পাশাপাশি কোস্টগার্ড, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), ফায়ার সার্ভিস ও স্বেচ্ছাসেবীরা যোগ দিয়েছেন। তবে দুর্গত এলাকায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ায় ও পানির প্রবল স্রোত থাকায় ব্যাহত হচ্ছে উদ্ধার কার্যক্রম। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি পুরো এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ায় ফেনীর বেশির ভাগ উপজেলার মানুষ এখন আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে।
জানতে চাইলে ফেনী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (ওঅ্যান্ডএম) আকাশ কুসুম বড়ুয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বন্যার পানি ওঠায় আরইবির আওতাধীন বেশ কয়েকটি উপকেন্দ্র বন্ধ রাখা হয়েছে। বাকিগুলো বন্যার পানি ঢুকে পড়ার তীব্র ঝুঁকিতে রয়েছে। আমরা প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি।’ তবে নাম না প্রকাশের শর্তে আরইবির অন্য এক কর্মকর্তা জানান, ফেনীতে পল্লী বিদ্যুতের চারটি উপকেন্দ্রে পানি প্রবেশ করায় বন্ধ রাখা হয়েছে।
আরইবি সূত্রে জানা গেছে, ফেনীতে ৪ লাখ ১৩ হাজার গ্রাহকের মধ্যে ১ লাখ ৮৩ হাজারের বেশি গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হলে বিদ্যুৎহীন গ্রাহকের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে বলে জানা গেছে।
বন্যার কারণে নোয়াখালীর বহু মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব এলাকার রাস্তাঘাট, বিভিন্ন উন্নয়ন অবকাঠামোর পাশাপাশি বিদ্যুতের স্থাপনা বিশেষত বিদ্যুৎ অফিস, উপকেন্দ্র, বিদ্যুতের তার, খুঁটি ও ট্রান্সফরমার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নোয়াখালীতে বিদ্যুতের একটি উপকেন্দ্র পানিতে ডুবে গেছে।
এ বিষয়ে নোয়াখালী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সিনিয়র ম্যানেজার মো. জাকির হোসেন জানান, নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ-১ উপকেন্দ্র বন্যার কারণে ডুবে গেছে। বাকি উপকেন্দ্রগুলো এখনো সুরক্ষিত অবস্থায় রয়েছে। মাটি থেকে অনেক উঁচুতে হওয়ায় সেগুলো ঝুঁকিতে নেই। তবে পানি আরো বাড়লে ঝুঁকি রয়েছে। নোয়াখালীতে আরইবির সাড়ে সাত লাখ গ্রাহকের মধ্যে চার লাখের বিদ্যুৎ সংযোগ নেই।
নোয়াখালীর বন্যাকবলিত এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত ৬০ বছরে এ ধরনের বন্যা কখনো দেখেননি তারা। এবার বন্যার পানি খুব উঁচুতে উঠেছে। বন্যার পানি বাড়ার কারণে সড়কের বড় বড় গাছ বিদ্যুতের তারের ওপরে পড়েছে, পানির স্রোতে খুঁটি উপড়ে পড়েছে। অনেকের বাড়িতে মিটারে পানি স্পর্শ করেছে। আরইবির এ অঞ্চলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা তৈরি হওয়ায় ঝুঁকি এড়াতে বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রাখা হয়েছে।