আসন্ন বাজেটে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ বাড়িয়ে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, দেশে বর্তমানে বড় একটি অংশ তরুণ, যাদের মধ্যে শিক্ষিত-অশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ফলে দারিদ্র্যসীমার নিচে মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। চলতি অর্থবছরে বেকারত্ব প্রায় ১৪ শতাংশ বেড়েছে। এ অবস্থায় দেশে বেকারত্ব কমিয়ে আনতে প্রয়োজন দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ।
গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে ‘এসডিজি বাস্তবায়নে নাগরিক প্লাটফর্ম, বাংলাদেশ’ আয়োজিত ‘বাংলাদেশ অর্থনীতি ২০২৫-২৬: নীতি সংস্কার ও জাতীয় বাজেট’ শীর্ষক ‘বহুপাক্ষিক অংশীজনের বৈঠকে’ এমন পরামর্শ দেন তারা। এতে অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ, গবেষক, বেসরকারি খাত ও ব্যবসায়ী খাতের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, সরকার প্রাইভেট সেক্টরে বিনিয়োগ বাড়িয়ে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে। কীভাবে কর্মসংস্থান বাড়ানো যায় সে বিষয়ে সরকারকে সঠিক পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। পাশাপাশি বেকার জনগোষ্ঠীকে দক্ষ ও যোগ্য করে তুলতে প্রশিক্ষণ খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে। বিগত সময়ে দেখা গেছে, নার্সের সংখ্যা না বাড়িয়ে চিকিৎসকদের সংখ্যা বাড়ানো হতো। কর্মসংস্থান বাড়ানোর নামে কিছু অপরিকল্পিত বরাদ্দও দেয়া হয়েছে। আসন্ন বাজেটে সে ধরনের পরিকল্পনা থেকে সরকারকে বেরিয়ে এসে নতুন চাকরির বাজার তৈরি করতে হবে। এছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে এডিপি বরাদ্দ কমিয়ে এনেছে সরকার। এটি সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। এ দুই খাতে বাজেট বাড়াতে হবে, নয়তো আগের মতোই রাখতে হবে।
বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি চলতি অর্থবছরের অক্টোবর-ডিসেম্বরে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ বেকারত্ব বেড়েছে বলে দাবি করেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, দেশে কর্মসংস্থানের পরিস্থিতি হতাশাজনক। ২০২৫ অর্থবছরে (জুলাই-ডিসেম্বর) কর্মসংস্থান ২০২৪-এর তুলনায় ২১ লাখ কম। এ সময়ে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) বেকারত্ব বেড়েছে ১৩ দশমিক ৮ শতাংশ। একই সময়ে কর্মসংস্থান কমেছে ৩ দশমিক ৭ শতাংশ।
এ বিষয়ে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘দেশে বেকারত্ব বেড়েছে ১৪ শতাংশ। একই সময়ে মূল্যস্ফীতির তুলনায় শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধির হার অনেক নিচে। অর্থাৎ তাদের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টির জন্য বিনিয়োগের যেসব উপাদান থাকে, এ মুহূর্তে সেগুলো আমাদের খুব বেশি উৎসাহিত করতে পারছে না, ফলে কর্মসংস্থান বাড়ছে না। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে সেটা জোর দিয়ে বলতে পারছি না।’
বিনিয়োগ না এলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে না। বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আনতে পারলে নতুন নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে বলে মনে করেন বিজনেস ইনিশিয়েটিভ লিডিং ডেভেলপমেন্টের (বিল্ড) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফেরদৌস আরা বেগম। তিনি বলেন, ‘বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আমাদের আকৃষ্ট করতেই হবে। কারণ কর্মসংস্থানের জন্য এটি খুবই প্রয়োজন। বাজেটে মূল্যস্ফীতির ৬ দশমিক ৫ শতাংশ বাজেট আছে। কিন্তু কর্মসংস্থান বা এ-সংশ্লিষ্ট কোনো খাতে বাজেট দেখিনি। এখানে আমরা একটি সুশৃঙ্খল অবস্থা দেখতে চাই, যেন বিদেশী বিনিয়োগকারী আকৃষ্ট হয়। একই সঙ্গে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করতে নীতিগত অসংগতি ও জটিল কর কাঠামো দূর করতে হবে।’
২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে সরকার স্বাস্থ্য, শিক্ষার পাশাপাশি কর্মসংস্থানে গুরুত্ব দেবে বলে প্রত্যাশা গবেষণা ও নীতি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (র্যাপিড) নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আবু ইউসুফের। তিনি বলেন, ‘সরকারকে আগামী বাজেটে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান খাতে গুরুত্ব দিতে হবে। এবারের বাজেটে অর্থনৈতিক সংস্কারের একটা প্রতিচ্ছবি থাকবে বলে আশা করি। বিদেশী ঋণনির্ভরতা থেকে শুরু করে বাজেট ঘাটতি কমাতে রাজস্ব বাড়ানোর বিকল্প নেই। এছাড়া দরিদ্রতার হার কমিয়ে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে কাজ করতে হবে।’
দেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বিদেশ গমন সহজ করার পরামর্শ দিয়েছেন রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী। তিনি বলেন, ‘আমাদের বড় একটি বাজার হতে পারে বিদেশ গমন। অভিবাসনে প্রায় ১০-১২ লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। যেখান থেকে গত বছর ২৭ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। অথচ ২০১২-১৩ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট পর্যন্ত অভিবাসনে সুশাসনে খরচ করা হয়েছে মাত্র দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ, যা খুবই কম। আমাদের এখন আরেকটি সমস্যা হচ্ছে বিদেশ গমনে নারীদের সংখ্যা কমছে। আবার চাহিদা অনুযায়ী লোক পাঠাতে পারছি না। আমাদের যে বেকার জনগোষ্ঠী আছে তাদের যদি প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তুলতে পারি, তাহলে বিশ্বজুড়ে আমাদের একটি শ্রমবাজার তৈরি করা যাবে।’
আসন্ন বাজেটে অর্থনৈতিক সংস্কার, বেসরকারি খাত ও দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে গুরুত্ব দিয়ে একটি জন-আকাঙ্ক্ষার বাজেট প্রণয়ন করার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, আসন্ন বাজেট নিয়ে এ সরকারের কাছে জনগণের একটি আকাঙ্ক্ষা আছে। সরকারকে সেটি পূরণ করতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে অর্থনৈতিক সংস্কারকে সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে না। এছাড়া বাজেট প্রণয়নে সংস্কার প্রস্তাবকে অগ্রাধিকার না দেয়ার অভিযোগ রয়েছে তাদের। বাজেটে টাস্কফোর্স, সংস্কার কমিটি যেসব সুপারিশ বা পরামর্শ দিয়েছে সেগুলোর প্রতিফলন এখনো দেখা যাচ্ছে না।
পুরনো বাজেটের মতোই এবারের বাজেট হচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির স্থানীয় কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘সরকারে যারা আছে তারা জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে সরকারে বসে নাই। তারা পাবলিক, ব্যবসায়ী ও এনজিওর নার্ভ বুঝতে পারছে না। যার কারণে অপ্রয়োজনীয় নানা কিছুতে হাত দিচ্ছে, যেখানে সফলতা আসছে না। দেশের অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে না পারলে বিনিয়োগ আসবে না।’
আসন্ন বাজেট নিয়ে আশাবাদী নন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হানও। তিনি বলেন, ‘আগামী বাজেটে বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে তেমন কোনো আশা দেখছি না। অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে যে অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল তা হচ্ছে না, কোনো রোডম্যাপ নেই, ব্যাংক খাতের স্বচ্ছতা নিয়েও প্রশ্ন উঠছে, কোনো তথ্য দেয়া হচ্ছে না। সে অবস্থায় বাজেট নিয়ে আশাবাদী হতে পারছি না।’
তবে পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে একটি প্রভাব পড়ত বলে মনে করেন সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘পাচার হওয়া ১৫ বিলিয়ন মধ্যে যদি ৫ বিলিয়নও আমরা ফেরত আনতে পারতাম তাহলে সেটা রাজস্ব খাতে যুক্ত করতে পারতাম। এখানে একটি দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হতে দেখছি।’
তবে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনতে গঠিত টাস্কফোর্স কাজ করছে বলে জানান বিশ্বব্যাংকের সাবেক অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘নয় মাস ধরে ব্যাংক খাতে রেগুলেশন, দুর্দশাগ্রস্ত ব্যাংক ও পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে সংস্কার চলছে। এ সরকার তাদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই পাচারকৃত অর্থের নিষ্পত্তি করবে। পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনতে কাজ করছে টাস্কফোর্স। এর মাধ্যমে ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণ থেকে ব্যাংক খাত বেরিয়ে আসতে পারবে।’
বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অনিসুজ্জামান চৌধুরী, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের উপাচার্য অধ্যাপক ম. তামিম, ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইমরান মতিন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক এ কে এনামুল হক, গবেষণা পরিচালক ড. কাজী ইকবাল, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শারমিন্দ নীলর্মী, এনবিআরের সাবেক সদস্য ফরিদ উদ্দিন, সিপিডির সিনিয়র গবেষণা ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খানসহ ব্র্যাক, অ্যাকশনএইড, ধ্রুবতারাসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি।