কভিডের অভিঘাত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাতে বিশ্বব্যাপী দেখা দেয় জ্বালানি সংকট ও দামের অস্থিরতা। এতে গত অর্থবছরে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে দেশের অর্থনীতি। এ পণ্যের দাম কয়েক দফা বাড়িয়ে পরিস্থিতি সামাল দিতে গিয়ে ডলার সংকটসহ প্রকট হয়ে ওঠে নানামুখী শঙ্কা। জ্বালানির মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ার পাশাপাশি এর প্রভাব পড়ে সবকিছুতে। ফলে দেশের জ্বালানি খাতে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও সরকারের অর্থনৈতিক পরিকাঠামো বড় করার যে লক্ষ্য সেটিই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। আর এটি মোকাবেলায় যত দ্রুত সম্ভব আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে—বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্থিতিশীল অর্থনীতি ও প্রবৃদ্ধির ধারাবাহিকতা অর্জনে জ্বালানি নিরাপত্তাই আগামী দিনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এ সমস্যা সমাধানের উপায় থাকলেও সে পথে না হেঁটে বরং অনিশ্চিত ও অপরীক্ষিত জ্বালানি ব্যবহারের পথে হাঁটছে দেশের জ্বালানি খাত। যদিও সরকার জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে স্থানীয় গ্যাস অনুসন্ধান কিছুটা জোরদার করেছে। পাশাপাশি আমদানীকৃত এলএনজি নিয়েও তৎপরতা বাড়িয়েছে। তবে এ সংকট কাটিয়ে উঠতে খাতটিতে যে পরিমাণ বিনিয়োগ ও অর্থ প্রয়োজন, তার জোগান কীভাবে হবে সে উপায় দেখছেন না বিশেষজ্ঞরা।
জ্বালানি খাতের সমস্যা নিরসনে দাম বাড়িয়ে সরকার সমাধানের পথ খুঁজলেও তাতে সুফল মেলেনি। গত অর্থবছরে গ্যাস ও বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ফলে শিল্পোৎপাদন যেমন ব্যাহত হয় তেমনি বাড়ে পণ্যের উৎপাদন খরচ। গ্যাস সরবরাহ বৃদ্ধির দাবিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন শিল্প মালিকরা। যদিও এ সমস্যার সমাধান হয়নি এখনো।
২০২২-২৩ অর্থবছরের মাঝামাঝিতে দেশের সব শ্রেণীর গ্রাহকের গ্যাসের দাম বাড়ায় সরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে বিশেষত স্পট মার্কেটে এলএনজির মূল্যবৃদ্ধি, স্থানীয় জ্বালানি খাতে কোম্পানিগুলোর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সে সময় গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়। সরকারি ও বেসরকারি ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে সরবরাহকৃত গ্যাসের দাম সর্বনিম্ন ৮৭ থেকে সর্বোচ্চ ৪৯৭ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় এবং বিইআরসির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত অর্থবছরের মাঝামাঝিতে সরকারি ও বেসরকারি ক্যাপটিভ বিদ্যুতের দাম ঘনমিটারপ্রতি ৫ টাকা ২ পয়সা থেকে বেড়ে বর্তমানে ৩০ টাকা হয়। মূল্যবৃদ্ধির হার ৪৯৭ শতাংশ। শিল্প খাতে ব্যবহৃত বিদ্যুতের (ক্যাপটিভ) দাম বেড়ে ১৬ থেকে ৩০ টাকা হয়। প্রতি ঘনমিটারে বাড়ে ৮৭ দশমিক ৫ শতাংশ। বৃহৎ ও মাঝারি শিল্পে গ্যাসের দাম ১১ টাকা ৯৮ পয়সা থেকে বেড়ে ৩০ টাকা হয়। এ দুই শ্রেণীর গ্যাসের দাম ঘনমিটারপ্রতি বাড়ে ১৫০ দশমিক ৪১ শতাংশ। এছাড়া ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পে ১০ টাকা ৭৮ পয়সা থেকে বেড়ে হয় ৩০ টাকা। ঘনমিটারপ্রতি মূল্যবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় ১৭৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।
এদিকে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে গত অর্থবছরে তিন দফা বাড়ানো হয় বিদ্যুতের দাম। বিতরণ কোম্পানিগুলোর মূল্যবৃদ্ধির প্রস্তাবে তিন দফা খুচরা পর্যায়ে মোট ১৫ শতাংশ এবং এক দফা পাইকারিতে ২২ শতাংশ বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়।
গ্যাসের দাম বাড়িয়ে গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাস স্পট মার্কেট থেকে এলএনজি আমদানি করতে পারেনি জ্বালানি বিভাগ। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক বাজারে গত বছরের আগস্টে এলএনজির দাম প্রতি এমএমবিটিইউ ৭০ ডলার উঠে গেলে চলতি বছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি পর্যন্ত এলএনজি আমদানি করা যায়নি। গ্যাস সংকটে সিএনজি ও শিল্পে রেশনিং করে কয়েক মাস ধরে গ্যাস সরবরাহ করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতে আমরা বিভিন্ন সময় দীর্ঘ ও মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছি। কিন্তু সেগুলো ঠিকঠাকমতো কাজ করেছে কিনা তা পরীক্ষা করা হয়নি। জ্বালানি খাতে বিভিন্ন সময়ে উচ্চাভিলাষী ও অবাস্তব প্রক্ষেপণ করা হয়েছে। এসব প্রক্ষেপণ ও পরিকল্পনার বড় অংশজুড়েই ছিল আমদানিনির্ভর জ্বালানি। অনেক ক্ষেত্রে অপরীক্ষিত জ্বালানি নিয়েও আমরা কথা বলছি। প্রাইমারি এনার্জি বিষয়টি নিয়ে একটা পরিপূর্ণ সমাধানে আসা যায়নি। অথচ সমাধান আমাদের হাতেই রয়েছে। কিন্তু গোষ্ঠী স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো প্রাধান্য দিতে গিয়ে জ্বালানি খাতের সমস্যা সমাধানের পথগুলো বাস্তবায়ন করা যায়নি, যার খেসারত আমরা এখন দিচ্ছি।’
অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, গত অর্থবছরে জ্বালানির দাম সবকিছুকে প্রভাবিত করেছে। ব্যক্তি, হাউজহোল্ড, ব্যবসা, কৃষি সব খাতেই জ্বালানির দামের প্রভাব পড়ে। জ্বালানির মূল্যই মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়িয়েছে। প্রথমত, আমদানি করা, তারপর এখানে আসার পর দাম বাড়ানো হচ্ছে দফায় দফায়। বহিঃস্থ কারণে শুরু, কিন্তু অভ্যন্তরীণ পর্যায়ে বারবার বাড়ানোর ফলে এটা মূল্যস্ফীতির চাপকে আরো বাড়িয়েছে। প্রাপ্যতা সংকট সবসময়ই সমস্যা ছিল, এখন তা আরো বেড়েছে। এটা নীতিনির্ধারণী ব্যর্থতা।
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের যদি জ্বালানি কেনার ওপর নির্ভরশীলতা না থাকত তাহলে সংকট এত ভোগাতে পারত না। অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে উত্তোলন, উদ্ভাবনের দিকে আমরা নজর দিইনি। পাশাপাশি যেটা উৎপাদন হয়েছে কিন্তু গ্রিডে যাচ্ছে না অর্থাৎ বণ্টন ব্যবস্থা ঠিক করার দিকেও মনোযোগ ছিল না। আমরা যে কিনব সেখানেও বৈদেশিক মুদ্রার সংকট। জ্বালানিভিত্তিক কার্যক্রমগুলো বন্ধ হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার চাপের কারণে। জ্বালানির পুরো সরবরাহ চেইনে একক কোম্পানি হিসেবে বিপিসির একচেটিয়া কার্যক্রমটাও একটা সমস্যা।’
দেশের জ্বালানি নিরাপত্তায় আমদানিনির্ভরতাকে পণ্যের উৎপাদন খরচ ও প্রবৃদ্ধি কমার মূল কারণ হিসেবে মনে করেন শিল্পোদ্যোক্তারা। তারা মনে করেন, যত দ্রুত সম্ভব আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনতে হবে।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘যতদিন পর্যন্ত আমরা আমদানিনির্ভর জ্বালানি থেকে বের হতে না পারব, ততদিন আমাদের অর্থনীতিতে যেসব সংকট চলছে, তা থেকে বেরিয়ে আসতে পারব না। সরকারের আমদানি ব্যয়ের বড় খরচ চলে যাচ্ছে জ্বালানি তেলে। গত অর্থবছর আমাদের জ্বালানি আমদানিতে ব্যয় হয়েছে ৮ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। এ খরচ চলতি অর্থবছরে ১০ বিলিয়নে ঠেকবে। এছাড়া জ্বালানি আমদানির জন্য যে পরিমাণ ডলার প্রয়োজন সেটি আমাদের নেই। মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। এখন আমাদের প্রকৃত প্রবৃদ্ধিটা হচ্ছে না। মনে হচ্ছে রফতানি বেড়েছে। দামের সঙ্গে বিচার করলে প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা ২৫ শতাংশ, সেখানে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১০ শতাংশ। সেই হিসাব যদি করি তাহলে আমরা নেতিবাচক অবস্থানে রয়েছি।’
জ্বালানি নিরাপত্তায় অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় ফিকে হচ্ছে দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর সম্ভাবনা। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষের (বেজা) আওতায় ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য রয়েছে সরকারের। এসব অঞ্চলে স্থানীয় বিনিয়োগের পাশাপাশি বিদেশী বিনিয়োগের প্রত্যাশা রয়েছে। জাপান, ভারত ও চীনের জন্য পৃথক অর্থনৈতিক অঞ্চলের কার্যক্রমও কমবেশি এগিয়েছে। তবে বিদ্যমান জ্বালানি ও অর্থনৈতিক সংকটে বেজার উজ্জ্বল সম্ভাবনায় এখন চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে।
বেজা সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে যে কার্যক্রম চলমান রয়েছে সেগুলোয় শিল্পের ধরনে ভিন্নতা রয়েছে। সব শিল্পই যে গ্যাসনির্ভর এমন নয়। বিদ্যুতের চলমান সমস্যা অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্পকেও ছুঁয়েছে। উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। জেনারেটর দিয়ে উৎপাদন চলমান রাখা ব্যয়বহুল হয়ে পড়ছে। তবে গ্যাসনির্ভর যে শিল্পগুলো হয়েছে, সেগুলোয় প্রভাব পড়বে না। কারণ গ্যাসনির্ভর শিল্প সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। বেশির ভাগ শিল্পেরই বিদ্যুৎনির্ভরতা বেশি। বঙ্গবন্ধু শিল্পনগরে যে কয়টি শিল্প উৎপাদনে গেছে, তার প্রায় সবই বিদ্যুৎনির্ভর। বিকল্প হিসেবে এ শিল্পগুলোর জেনারেটর সংযোগ রয়েছে।
এফবিসিসিআইয়ের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বাবু বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জ্বালানি যদি ঠিকমতো আনতে না পারি, বিদ্যুৎ যদি না থাকে, গ্যাস যদি না থাকে তাহলে তো উৎপাদন বাড়বে না। তখন কর্মসংস্থান কম হবে, প্রবৃদ্ধি কম হবে, ব্যাংক লোন ব্যবসায়ীরা শোধ করতে পারবেন না। তাই আমাদের মূল কাজ হবে জ্বালানি নিশ্চিত করা। এটা নিশ্চিত করতে হলে আমাদের পর্যাপ্ত ডলার নিশ্চিত করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রার আয়টা বাড়াতে হবে। এখন বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের সঠিক পথে আসছে না। সরকার বা বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু কৌশল অবলম্বন করলে সেটি সঠিকভাবে আসবে। ভারতের সঙ্গে আমাদের রুপিতে লেনদেন চালু হয়েছে। চীন থেকে আমরা অনেক কাঁচামাল আমদানি করি। তাদের সঙ্গেও যদি আমরা টাকায় লেনদেন করতে পারতাম তাহলে অনেক ডলার বেঁচে যেত। ডলার সাশ্রয়ের বিষয়টি এখন সবসময় মাথায় রাখতে হবে।’