গ্যাস সরবরাহ

দুর্যোগপ্রবণ বাংলাদেশে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্ভরযোগ্য কি

এখনো চালু হয়নি সামিটের টার্মিনাল

ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে গত ২৭ মে সাগরে ভাসতে থাকা ভাঙা একটি পন্টুনের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামিটের ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের (ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট বা এফএসআরইউ) ব্যালাস্ট ট্যাংক। বর্তমানে টার্মিনালটি থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এর আগে গত বছরের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় মোখার সময়ও সামিট ও এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনাল দুটি থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখতে হয়

ঘূর্ণিঝড় রেমালের প্রভাবে গত ২৭ মে সাগরে ভাসতে থাকা ভাঙা একটি পন্টুনের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সামিটের ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের (ফ্লোটিং স্টোরেজ রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট বা এফএসআরইউ) ব্যালাস্ট ট্যাংক। বর্তমানে টার্মিনালটি থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। এর আগে গত বছরের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় মোখার সময়ও সামিট ও এক্সিলারেট এনার্জির টার্মিনাল দুটি থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখতে হয় পেট্রোবাংলাকে। জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সে সময় চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্যাসের তীব্র সংকট দেখা দেয়।

জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে বঙ্গোপসাগর এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি দুর্যোগপ্রবণ। এ দুর্যোগপ্রবণতা সামনের দিনগুলোয় আরো বাড়বে বলে পূর্বাভাস রয়েছে। দুর্যোগ দেখা দিলেই সাগরে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কখনো কখনো অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনাও ঘটছে। ফলে এলএনজি সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে সামগ্রিক গ্যাস সরবরাহে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশে ভাসমান টার্মিনালভিত্তিক গ্যাস সরবরাহ কতটা নির্ভরযোগ্য, সে বিষয়ে প্রশ্ন তুলছেন জ্বালানি অবকাঠামোবিশারদ ও বিশেষজ্ঞরা।

এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো, ঘূর্ণিঝড় ও দুর্যোগপ্রবণ দেশে গ্যাসের জাতীয় গ্রিডে এলএনজি সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন ও নির্বিঘ্ন রাখতে হলে ভাসমানের পাশাপাশি ভূমির ওপরও টার্মিনাল নির্মাণ প্রয়োজন। এতে দুর্যোগ বা অন্য কোনো কারণে সাগরে ভাসমান টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধের প্রয়োজন পড়লেও ভূমিতে নির্মিত টার্মিনাল ব্যবহার করে সরবরাহ ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখা যাবে। তবে দেশের গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় আমদানীকৃত এলএনজির ওপর নির্ভরতা উৎকৃষ্ট বা টেকসই কোনো সমাধান নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রেই তা গোটা সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় নানা জটিলতার কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। এজন্য এ ধরনের অবকাঠামোর ক্ষেত্রে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনাকে প্রাধান্য দিয়ে গবেষণার পাশাপাশি গ্যাসের স্থানীয় সরবরাহ বাড়ানোরও প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

বুয়েটের অধ্যাপক ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ম. তামিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘দুর্যোগপ্রবণ দেশ ও গ্যাস সংকট বিবেচনায় আমাদের মতো দেশে ভাসমান এলএনজি টার্মিনালের পাশাপাশি ভূমিভিত্তিক টার্মিনাল গড়ে তোলা প্রয়োজন। অন্তত ১৫ দিনের মজুদ সক্ষমতা গড়ে তোলা গেলেও সেটিকে কাজে লাগিয়ে দুর্যোগ বা অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনায় ভাসমান টার্মিনাল বন্ধ থাকলে সরবরাহ সংকট এড়ানো যাবে। বতর্মানে যেভাবে প্রতি বছর ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাস হচ্ছে তাতে এলএনজি সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় বাধা তৈরি হবে এটিই স্বাভাবিক। যদিও এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের আগে বছরে কতদিন এসব দুর্যোগ ও আনুষঙ্গিক কারণে বন্ধ থাকবে সেটির একটা হিসাব করা হয়েছিল। তবে আমাদের স্থানীয় পর্যায়ে উত্তোলন ও সরবরাহ বাড়ানো গেলে সেটি আরো টেকসই সমাধান হবে।’

ভাসমান টার্মিনালের দুর্যোগজনিত ঝুঁকির বিষয়টি স্বীকার করছেন এলএনজি সরবরাহের সঙ্গে জড়িতরাও। এজন্য বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশে ভাসমান টার্মিনাল মডেলটি নিয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন বলে মনে করছেন তারা। নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে সংশ্লিষ্ট একটি কোম্পানির এক প্রকৌশলী বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ভাসমান টার্মিনাল ভূমিতে স্থাপিত টার্মিনালের চেয়ে ব্যয় ও সময়সাশ্রয়ী। এতে ঝুঁকিও কম। উন্নত বিশ্বেও এর বহুল ব্যবহার রয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশে সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় এ মডেলের এফএসআরইউ ব্যবহার নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে। চাহিদা বিবেচনায় এলএনজির ভূমিভিত্তিক টার্মিনালও করা যায়।’ 

জ্বালানি বিভাগ ও পেট্রোবাংলার শীর্ষ নির্বাহীরা বলছেন, দুর্যোগে টার্মিনালের নিরাপত্তা বা অনাকাঙ্ক্ষিত কোনো ঘটনা ছাড়া এফএসআরইউ থেকে এলএনজি সরবরাহ বন্ধের কোনো সুযোগ নেই। আর এফএসআরইউগুলো স্থাপনের সময়েই তা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও টার্মিনাল রক্ষণাবেক্ষণসহ বছরে নির্দিষ্ট একটা সময় বন্ধ থাকবে বলে হিসাবে নেয়া রয়েছে।

দেশে এ মুহূর্তে ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল আছে দুটি। কক্সবাজারের মহেশখালীতে স্থাপিত টার্মিনাল দুটির মধ্যে একটি স্থাপন করেছে সামিট গ্রুপ। আরেকটি স্থাপন করেছে মার্কিন প্রতিষ্ঠান এক্সিলারেট এনার্জি। জ্বালানি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, দুটি টার্মিনালের প্রতিটির ধারণক্ষমতা ১ লাখ ৩৮ হাজার ঘনমিটার। আর এলএনজি রিগ্যাসিফিকেশনে টার্মিনাল দুটির সম্মিলিত দৈনিক সক্ষমতা ১ হাজার ১০০ মিলিয়ন ঘনফুট। স্থানীয় সরবরাহ ও এফএসআরইউ দুটি থেকে পূর্ণ সক্ষমতায় এলএনজি সরবরাহের পরও জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের চাহিদার তুলনায় ঘাটতি থাকে দৈনিক প্রায় ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এ অবস্থায় কোনো কারণে একটি টার্মিনাল থেকে সরবরাহ বন্ধ হলে গোটা দেশেই তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎ, শিল্প ও সিএনজি খাতের মধ্যে গ্যাস রেশনিং করে পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয় পেট্রোবাংলাকে।

ভাসমান টার্মিনাল পরিচালনা-সংশ্লিষ্ট সরকারি দুই কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রক্ষণাবেক্ষণ ও দুর্যোগের কারণে ভাসমান টার্মিনাল দুটি বছরে গড়ে ২০-২৫ দিন বন্ধ থাকার কথা। টার্মিনাল নির্মাণকালে সই হওয়া চুক্তি অনুযায়ী, এর বাইরেও প্রতি পাঁচ বছর পর সংস্কারের জন্য টার্মিনালগুলো ড্রাই ডকিংয়ে নিতে হবে। এতে সময় প্রয়োজন অতিরিক্ত আরো দেড় মাস।

দেশে বিদ্যমান দুটি এলএনজি টার্মিনালের পাশাপাশি আরো তিনটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনা করেছে সরকার। এর মধ্যে দুটি সাগরে (এফএসআরইউ) ও অন্যটি ভূমিতে স্থাপন করা হবে। এফএসআরইউ দুটির মোট দৈনিক সরবরাহ সক্ষমতা ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। আর ভূমিতে স্থাপনের জন্য পরিকল্পনাধীন টার্মিনালটির সক্ষমতা ১ হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। 

এর মধ্যে কক্সবাজারে একটি ভাসমান টার্মিনাল স্থাপনের চূড়ান্ত অনুমোদন পেয়ে গেছে সামিট গ্রুপ। আরেকটি টার্মিনাল নির্মাণে এরই মধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জি। আর ভূমিভিত্তিক টার্মিনালটি সরকারিভাবে বা যৌথ উদ্যোগে নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের।

সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী, দেশের গ্যাস সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় ২০২৬ সালের পর এলএনজির ব্যবহার বহুলাংশে বাড়বে। অবকাঠামো বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুর্যোগজনিত নিরাপত্তা ঝুঁকির কারণে টার্মিনাল স্থানান্তর বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে তা সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। এমনকি বিপুল অর্থের এ বিনিয়োগ হুমকিতে পড়তে পারে। এ কারণে এ ধরনের প্রকল্পের ক্ষেত্রে জলবায়ু ও দুর্যোগের বিষয়গুলো মাথায় রেখে টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। 

জানতে চাইলে বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমুদ্রের তলদেশ ক্রমেই উঁচু হয়ে উঠছে। আগামী ১০০ বছরে সাগরের পানির উচ্চতা বাড়বে আরো এক মিটার। প্রাকৃতিক দুর্যোগও বাড়বে। এসব দুর্যোগের কারণে উপকূলীয় এলাকায় যেসব নতুন নতুন অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে বা হচ্ছে, সেগুলো আরো ঝুঁকিতে পড়বে। বিশেষ করে জ্বালানি ও যোগাযোগ অবকাঠামোর ক্ষতির মাত্রা হবে বেশি। ফলে আমাদের বিষয়টি মোকাবেলায় প্রাধান্য দিয়ে গবেষণা কার্যক্রমও বাড়াতে হবে। যেখানে প্রকল্পের সঙ্গে দুর্যোগ ও জলবায়ুসংক্রান্ত বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়েই প্রকল্প বাস্তবায়ন হবে।’

ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত সামিটের এলএনজি টার্মিনালটি গতকালও বন্ধ ছিল। অন্য টার্মিনালটি দিয়ে দিনে ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কিছু বেশি এলএনজি সরবরাহ হচ্ছে। আর সামিটের টার্মিনালটি কবে নাগাদ গ্যাস সরবরাহে যুক্ত হবে সে বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য জানাতে পারেননি এলএনজি সরবরাহে নিয়োজিত কোম্পানি রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের (আরপিজিসিএল) কর্মকর্তারা।

আরপিজিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সামিটের টার্মিনালটি কবে নাগাদ চালু হবে সেটি এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। টেকনিক্যাল এক্সপার্টরা একটি রিপোর্ট দিয়েছেন। সেটি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে সিদ্ধান্ত পেলে কবে নাগাদ চালু হবে সেটি জানা যাবে। ঘূর্ণিঝড়ে এ ধরনের ঘটনা এই প্রথম। এর আগেও দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় এলএনজি সরবরাহ করা হয়েছে।’

দুর্যোগে ভাসমান টার্মিনাল থেকে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনা এটিই প্রথম নয়। এর আগেও গত বছরের ১২ মে ঘূর্ণিঝড় মোখার প্রভাবে নিরাপত্তার কারণে এফএসআরইউ দুটি থেকে সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়। সে সময় চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বিদ্যুৎ উৎপাদন ও শিল্প খাতে তীব্র গ্যাস সংকট দেখা দেয়। 

ঘূর্ণিঝড়ে ভাসমান পন্টুনের আঘাতে এফএসআরইউ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার বিষয়ে সামিট গ্রুপের পক্ষ থেকে গত বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠানো হয়। ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৭ মে ঘূর্ণিঝড় রেমালের সর্বোচ্চ প্রভাবের সময় কক্সবাজারের মহেশখালীতে সাগরে ভাসতে থাকা একটি ভাঙা পন্টুন সামিট এলএনজি টার্মিনাল কোম্পানি (প্রাইভেট) লিমিটেডের এফএসআরইউতে আঘাত করে। এতে সামিটের এফএসআরইউর ব্যালাস্ট ট্যাংক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। স্ট্যান্ডার্ড অপারেশনাল প্রটোকল অনুযায়ী, বিষয়টি নিরীক্ষার জন্য একজন দক্ষ নিরীক্ষক দ্রুততম সময়ের মধ্যে এফএসআরইউতে পৌঁছাবেন। তিনি পরিস্থিতি নিয়ে পূর্ণাঙ্গভাবে মূল্যায়ন করার পর এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য জানানো যাবে। এছাড়া সামিট বিষয়টি নিয়ে আরপিজিসিএল ও পেট্রোবাংলার সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছে। এলএনজির বিস্ফোরক প্রকৃতির কারণে এর পরিচালনায় সংবেদনশীলতা এবং জাতীয় গ্রিডে গ্যাস সরবরাহের ক্ষেত্রে এফএসআরইউর গুরুত্ব বিবেচনায় টার্মিনালের নিয়মিত কার্যক্রম চালুর আগে উদ্ভূত সমস্যা সমাধানের জন্য সামিট পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি নিচ্ছে।

আরও