দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় জেলা ফেনী, খাগড়াছড়ি ও চট্টগ্রামের পানি নিষ্কাশনের অন্যতম পথ ফেনী নদী। ১৫৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এ নদী মুহুরী প্রজেক্ট হয়ে মিশেছে বঙ্গোপসাগরে। চট্টগ্রামের মিরসরাই ও ফেনীর সোনাগাজী অংশের উপকূলীয় অঞ্চলকে বন্যাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে ১৯৮৪ সালে নদীর পাশে নির্মাণ করা হয় ৫০ কিলোমিটার বাঁধ। এতে দুই পাশে জেগে ওঠে কয়েক হাজার একর চর। গত চার দশকে সেই এলাকা দখলে কিংবা ইজারা নিয়ে তৈরি করা হয়েছে মাছের ঘের ও পুকুর। এতে রুদ্ধ হয়েছে পানি চলাচলের পথ। ফলে ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢল ও অতিবৃষ্টির পানি নামতে না পারায় ফেনীতে দেখা দেয় স্মরণকালের বন্যা।
জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেনী, নোয়াখালী ও কুমিল্লা অঞ্চলের উজানের পানি সিলোনীয়া, মুহুরী, কহুয়া ও ডাকাতিয়া নদী হয়ে বঙ্গোপসাগরে গিয়ে মেশে। এর মধ্যে সিলোনীয়া, মুহুরী ও কহুয়া নদীর পানি ভাটিতে নামে মুহুরী প্রজেক্ট হয়ে। কিন্তু ত্রুটিপূর্ণ বাঁধ ও নদীর পাড় দখল হওয়ায় বর্ষাকালে নদীর পানিতে প্লাবিত হয় নিম্নাঞ্চল।
সরজমিনে দেখা যায়, মুহুরী নদীর উজান অংশ, আজমপুর, ওসমানপুর, চরকৃষ্ণজয়, গুচ্ছগ্রাম ও চর কালীদাস এলাকার ১২ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে এবং উজানের সংযোগস্থলে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি মৎস্য প্রকল্প। এসব প্রকল্পের জন্য নদীর দুই পাশে দখল করা হয়েছে প্রায় আট হাজার একর এলাকা। বঙ্গোপসাগরের উজান ও ফেনী নদীর ভাটিতেও মুহুরী সেচ প্রকল্প এলাকায় নদী ও সাগরের মোহনায় বাঁধ দিয়ে করা হয়েছে মাছের ঘের। এ বাঁধের কারণেও নদীর পানিপ্রবাহ ও সাগরের জোয়ারের পানি বাধাগ্রস্ত হয়ে দুই পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়। পানিপ্রবাহের পথ বদলে যাওয়ায় ভাঙন দেখা দিয়েছে স্থলভাগে। সংকুচিত হয়ে পড়েছে বড় ফেনী নদী (সীমান্ত নদী)। ফলে উজান থেকে আসা পানির প্রবাহ বিঘ্নিত হচ্ছে। সে কারণেই এবারের বন্যায় পানিবন্দি হয়ে পড়ে ফেনীর প্রায় সব উপজেলার মানুষ।
মুহুরী নদীতীরবর্তী এলাকার বাসিন্দা শেখ আনোয়ার বলেন, ‘নদীতে অপরিকল্পিত বালি উত্তোলন, চর দখল করে ফল-ফসল আবাদ, মাছ চাষ এবং দোকানপাট ও বাড়িঘর নির্মাণ করায় নদী তার ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। আবার বালি উত্তোলনের কারণে নদী কোথাও সরু, আবার কোথাও প্রশস্ত হয়ে গেছে। এতে নাব্য হারাতে বসেছে মুহুরী নদী। এ নদী রক্ষায় বিভিন্ন সময় মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সভা করেছেন নদীভাঙনে ক্ষতিগ্রস্তরা।’
পানি ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফেনী নদীর মাধ্যমে জেলার ৮০ শতাংশ পানি বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। এবার রামগড় ও উজান থেকে বৃষ্টির পানি আসায় ফেনী নদী আগেই ভরা ছিল। নদীর উজান অংশ আগে থেকে দখল হওয়ায় পানি সরতে পারেনি। এছাড়া এ নদীর প্রধান রিজার্ভারের তিন ভাগের দুই ভাগ এরই মধ্যে মাটিতে ভরে যাওয়ায় পানি ধারণক্ষমতাও কমে গেছে।
ফেনী জেলা ও সোনাগাজী উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ফেনী নদীকে কেন্দ্র করে দুই পাশে গড়ে উঠেছে মৎস্য খামার। এর মধ্যে পানি পতিত হওয়ার স্থানে ৫০০ একরের বেশি জায়গাজুড়ে মৎস্য খামার গড়ে উঠেছে। গত ১৫ বছরে এসব মৎস্য খামার গড়ে ওঠে। নদী থেকে জেগে ওঠা কলমিরচরের খাস জমি দখল করে এসব মৎস্য খামার গড়ে তোলা হয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বেশ কয়েকবার উচ্ছেদ অভিযান চালানো হলেও তা সফল হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক উপজেলা প্রশাসনের এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘জেগে ওঠা কলমিরচর ছিল মূলত তিন ফসলি জমি। পরে সেখানে মৎস্য খামার হয়। এ খামার বন্ধে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অভিযান চালানো হলেও তৎকালীন রাজনৈতিক ব্যক্তিদের চাপে তা স্থগিত হয়ে যায়। প্রশাসনের লোকজনের ওপর হামলাও হয়েছে।’
মোহনা ছাড়াও এ নদীর ফেনী অংশের দুই হাজার একর জায়গা দখল করা হয়েছে মৎস্য খামারের নাম করে। চট্টগ্রাম অঞ্চলের অংশে প্রায় ছয় হাজার একর জমি দখল করা হয়েছে মাছের ঘের করার জন্য।
মিরসরাই উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, মুহুরী প্রজেক্ট এলাকার প্রায় ছয় হাজার একর জমিতে এসব মৎস্য খামার গড়ে তোলা হয়েছে।
স্থানীয়রা বলছেন, আশির দশকে বাঁধ নির্মাণের পর অনেকে বিচ্ছিন্নভাবে মাছ চাষ শুরু করেন এ অঞ্চলে। ১৯৯৬ সালে বেশ কয়েকজন মাছচাষী আধুনিক পদ্ধতিতে ও বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ শুরু করেন। এরপর মেরিডিয়ান, বসুন্ধরা, আবুল খায়েরের মতো নামিদামি শিল্প গ্রুপ বাণিজ্যিকভাবে মুহুরী প্রজেক্ট এলাকায় মাছ চাষ শুরু করে। সে সময়ে চর দখল, নদী দখল ও মৎস্য খামার দখল নিয়ে নিয়মিত হামলা-পাল্টাহামলার ঘটনা ঘটে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর মৎস্য খামার ও নদীর মোহনার দখল ভাগ-ভাটোয়ারা হয় ফেনী-চট্টগ্রামের নেতাদের মধ্যে। এর পর থেকে দুই অঞ্চলে প্রভাবশালীরা প্রভাব বিস্তার করতে থাকেন।
স্থানীয়রা জানান, ২০০৯ সালের পর মূলত ফেনী-২ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য নিজাম উদ্দিন হাজারীর নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেন। সর্বশেষ কলমিরচর দখল করেন তারা। এছাড়া মুহুরী প্রজেক্টের রেগুলেটর সংলগ্ন এলাকায় অবৈধভাবে বালি উত্তোলন করতেন দখলদাররা। পার্শ্ববর্তী কলমিরচরে নদী দখল করে মাছ চাষ করেন স্থানীয় প্রভাবশালীরা। অবৈধভাবে ও অপরিকল্পিত বালি উত্তোলনের কারণে অনেক জায়গায় নদীর পাড় ভেঙে গেছে। বিলীন হচ্ছে ফসলি জমি। হুমকির মুখে পড়েছে বাড়িঘর ও মুহুরী প্রজেক্ট রেগুলেটর। এছাড়া নদী দখল করে মাছ চাষে নদীর স্বাভাবিক গতি হারিয়েছে।
দেশের পরিবেশ ও নদী নিয়ে গবেষণা করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার (আরডিআরসি)। এর নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ এজাজ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমরা কিছুদিন আগে ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুর এলাকা ঘুরে এসেছি। একসময় এ অঞ্চলে প্রচুর সিঅ্যান্ডডি খাল ছিল। এখন সেসব খাল ভরাট হয়ে গেছে। এ অঞ্চলে দ্রুত পানিপ্রবাহের মাধ্যম ছিল খাল, তারপর নদী আসে। পুরো জায়গাটা এতটা সংকীর্ণ করা হয়েছে, সমতলের পানি যাওয়ার কোনো রাস্তা নেই এখানে। খালের জায়গাগুলোয় মার্কেট, বাজার ও নানা স্থাপনার মাধ্যমে ধ্বংস করা হয়েছে। এসব দখল করা হয়েছে মৎস্য প্রকল্প ও জলমহালের নামে। জড়িতদের আইনের আওতায় আনতে হবে এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘গত ১৫ বছরে পাইকারি হারে খাল দখল হয়েছে। দখলদাররা আওয়ামী লীগের মদদপুষ্ট ও তাদের ছত্রচ্ছায়ায় বেড়ে ওঠা। এদের চিহ্নিত করে উচ্ছেদ অভিযান চালাতে হবে। এজন্য ছাত্রদের সঙ্গে নিতে হবে।’