বিশ্বব্যাপী টেকসই খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে প্রতি বছরই সূচক প্রকাশ করে লন্ডনভিত্তিক দি ইকোনমিস্টের উদ্যোগ ইকোনমিস্ট ইমপ্যাক্ট। উদ্যোগটির হালনাগাদকৃত বৈশ্বিক টেকসই খাদ্য সূচক বা ফুড সাসটেইনেবিলিটি ইনডেক্স ২০২১-এ ৭৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪৪তম। সার্বিক সূচকে মধ্যম মাত্রার ঝুঁকিপূর্ণ হলেও বাংলাদেশ এখন টেকসই কৃষির দিক দিয়ে বেশ ঝুঁকিতে রয়েছে বলে ইকোনমিস্ট ইমপ্যাক্টের বিশ্লেষণে উঠে এসেছে। একই সঙ্গে বিশ্বব্যাপী টেকসই কৃষি নিয়ে সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা ২০টি দেশের মধ্যে অন্যতম হিসেবে লাল তালিকাভুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ।
এফএসআই-২০২১-এ বিশ্বের ৭৮টি দেশের খাদ্যনিরাপত্তা ব্যবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হয়েছে। বৈশ্বিক জিডিপি ও জনসংখ্যা— উভয়েই দেশগুলোর সম্মিলিত অবদান ৯২ শতাংশ। সূচকটি তৈরিতে খাদ্যের ক্ষতি ও অপচয়, টেকসই কৃষি ও পুষ্টির চ্যালেঞ্জ—এ তিন বিষয়কে মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। মোট ৩৮টি সূচক ও ৯৫টি উপসূচকের ভিত্তিতে এটি প্রস্তুত করা হয়েছে।
বৈশ্বিক টেকসই খাদ্য সূচকে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর ১০০-এর মধ্যে ৬১। এর মধ্যে খাদ্যের ক্ষতি ও অপচয়ে ৫৬ পয়েন্ট, টেকসই কৃষিতে ৬০ ও পুষ্টি চ্যালেঞ্জে ৬৫ পয়েন্ট পেয়েছে বাংলাদেশ। মূলত কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি সূচকে পিছিয়ে থাকা, বাণিজ্য প্রভাব, কম উৎপাদনশীলতা, জমির ব্যবহার, বহুমুখীকরণে পিছিয়ে পড়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির কারণে বাংলাদেশের টেকসই কৃষি ঝুঁকিতে রয়েছে বলে ইকোনমিস্ট ইমপ্যাক্টের পর্যবেক্ষণে উঠে আসে।
এতে দেখা যায়, বাছাইকৃত ৭৮টি দেশের মধ্যে ২০টিতে খুবই উচ্চমাত্রার ও ১৯টিতে উচ্চমাত্রার টেকসই কৃষি বিদ্যমান রয়েছে। অন্যদিকে মধ্যম মাত্রায় টেকসই কৃষি নিশ্চিত করতে পেরেছে ১৯টি দেশ। এদিক থেকে পিছিয়ে রয়েছে ২০টি দেশ। এর মধ্যে বাংলাদেশ ছাড়াও উল্লেখযোগ্য অন্যান্য দেশের মধ্যে রয়েছে ভারত, পাকিস্তান, চীন, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, মালদ্বীপ, ব্রাজিল, রাশিয়া, জর্ডান ও স্পেন।
টেকসই কৃষি সূচক নির্ণয়ের জন্য ইকোনমিস্ট ইমপ্যাক্টের বিশেষজ্ঞরা পানি ব্যবস্থাপনা, পানি উত্তোলন পদ্ধতি, টেকসই মত্স্য চাষ ব্যবস্থাপনা, পানি প্রাপ্যতা ও পরিবেশগত ঝুঁকি এবং বাণিজ্য নীতির মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েছেন। এছাড়া মাটির প্রভাব, জমির মালিকানা, উৎপাদনশীলতা, ভর্তুকি, জমির ব্যবহার বিধিসহ নানা ধরনের সূচক ব্যবহার করা হয়েছে।
সার্বিক টেকসই খাদ্য সূচকে প্রধান তিনটি মানদণ্ডের অনুষঙ্গ হিসেবে খাদ্য অপচয় হ্রাস, প্রাতিষ্ঠানিক ভূমি অধিকার, সরকারি বিনিয়োগ, কৃষিসংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান, অপুষ্টি প্রতিরোধ এবং জনগণের পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য কেনার সামর্থ্যের মতো বিষয়গুলোকেও বিবেচনায় নেয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে সার্বিক সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান মধ্যম পর্যায়ে। ৭৮টি দেশের মধ্যে ৪৪তম। সূচকের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি খাদ্যনিরাপত্তা রয়েছে সুইডেনে। সবচেয়ে কম মাদাগাস্কারে।
মূলত টেকসই কৃষি এবং খাদ্যের ক্ষতি ও অপচয়ের কারণে বাংলাদেশ বেশি এগোতে পারছে না বলে সূচকের বিশ্লেষণে উঠে আসে। এ বিষয়ে এসিআই এগ্রিবিজনেসেসের প্রেসিডেন্ট ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য ড. ফা হ আনসারী বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারের ধারাবাহিক নীতিসহায়তার অভাবের কারণে কৃষি খাতে বেসরকারি উদ্যোক্তারা বড় বিনিয়োগে আগ্রহী হচ্ছেন না। বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ আনতে হলে অবশ্যই সরকারের সহায়তা প্রয়োজন। বিশেষ করে গবেষণা ও উদ্ভাবনে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগের যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। আবার কৃষি খাতে বাজার খুব নাজুক ও ঝুঁকিপূর্ণ। এতে বেসরকারি খাতও বিনিয়োগে তেমন আগ্রহী হচ্ছে না। বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়নের যথেষ্ট সুযোগ থাকলেও তা সঠিক মাত্রায় হচ্ছে না। তাই সার্বিক কৃষি খাতের সমসাময়িক প্রতিবন্ধকতাগুলোকে অনুধাবন করার পাশাপাশি সে অনুযায়ী দ্রুত পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন। দেশের চাহিদা মিটিয়ে রফতানি সক্ষম করে তুলতে হবে কৃষি শস্য খাতকে। এজন্য বাড়তি বিনিয়োগ ও আর্থিক প্যাকেজ সঠিকভাবে দিতে হবে। পাশাপাশি মূল্য সংযোজন ও তারুণ্যনির্ভর কৃষিতে গুরুত্বারোপ করতে হবে।
বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, দেশের বেশির ভাগ কৃষিজমির উর্বরাশক্তি কমে গেছে। অতিমাত্রায় ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতার কারণে বিভিন্ন অঞ্চলে পানির স্তর বিপজ্জনকভাবে নেমে গিয়েছে। সেই সঙ্গে কৃষিতে আছে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব। বাংলাদেশ মৃত্তিকা সম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এসআরডিআই) গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের আবাদযোগ্য ৮৫ শতাংশ ভূমির উর্বরাশক্তি কমে গেছে।
এ অবস্থায় ভবিষ্যতে ভূমির সর্বোত্তম ব্যবহার ধরে রাখার জন্য জমির পুষ্টি ও উর্বরাশক্তির বিষয়ে এখনই বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে লবণাক্ততা বৃৃদ্ধি, মাটির পুষ্টি উপাদানের ঘাটতির ফলে মৃত্তিকা এখন হুমকির মুখে। জমি থেকে দীর্ঘমেয়াদে ফসল উৎপাদন ধরে রাখতে জমিতে রাসায়নিক সারের ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার ছাড়াও ফসল আবাদে বহুমাত্রিকতার বিষয়ে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। প্রযুক্তি ও যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়া বিকল্প টেকসই কোনো উপায় নেই। এছাড়া প্রতিকূল পরিবেশে উপযোগী প্রযুক্তি ও উৎপাদন কৌশল, হাইব্রিড শস্যের প্রসার, পানি সাশ্রয়ী সেচ পদ্ধতি, সার ব্যবস্থাপনার দক্ষতা বৃদ্ধি প্রয়োজন। উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বৃদ্ধি রোধে ও বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় নতুন জাত, ভূমি ব্যবস্থাপনায় সমন্বিত পরিকল্পনা নিতে হবে। জমির উর্বরাশক্তি ধরে রাখা এবং ফসলের বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন হয়ে পড়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা পুলের সদস্য ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক হামিদুর রহমান বলেন, মাটির উর্বরাশক্তি ধরে রাখার পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা বাড়াতে আধুনিকায়ন ও ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। পাশাপাশি বাণিজ্যিক কৃষিকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলায় বিভিন্ন ফসলের স্বল্পমেয়াদি জাতসহ ঘাতসহিষ্ণু, বিশেষ করে খরা, বন্যা এমনকি লবণাক্ততাসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবনে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কৃষি খাতে গবেষণা ও উদ্ভাবনে বরাদ্দ বাড়ানো হচ্ছে। সব মিলিয়ে দেশের কৃষি খাতকে এগিয়ে নিতে সরকারের সব ধরনের উদ্যোগ ও নীতিসহায়তা দেয়া হচ্ছে।