অনিয়ম-দুর্নীতির ভারে বিপর্যস্ত দ্য ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচানো হয়েছিল অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে। বেসরকারি ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রাখতে ঢালা হয়েছিল সরকারি ব্যাংকের পুঁজি। নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছিল পদ্মা ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দেয়া হয়েছিল নজিরবিহীন নীতিছাড়। যদিও শেষ পর্যন্ত বহুল বিতর্কিত ব্যাংকটিকে আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
সরকারি ব্যাংকের অর্থ আর নীতিছাড় দিয়ে ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচিয়ে রাখার বিপক্ষে ছিলেন তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। কিন্তু আর্থিক খাতে অস্থিরতার ভয়, গোষ্ঠীস্বার্থ রক্ষা ও তদবিরের মুখে ঘটনা ঘটেছিল এর বিপরীত। পরে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী নিজেই একাধিকবার গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘ফারমার্স ব্যাংকে শুরু থেকেই ডাকাতি হয়েছে। এটা কোনো ব্যাংক ছিল না। এটিকে স্বাভাবিকভাবে মরতে দেয়া উচিত ছিল। ব্যাংকটিকে বাঁচিয়ে রেখে ভুল করেছি।’
সাত বছর আগে ঘটে যাওয়া সেই ‘ভুল’ এখন অনেক বড় ক্ষতের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক যখন ফারমার্স ব্যাংকে হস্তক্ষেপ করেছিল, তখন ব্যাংকটির দৃশ্যমান খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৭৭ কোটি টাকা। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের মাত্র ৪ শতাংশ ছিল খেলাপি। তখন ফারমার্স ব্যাংকের মূলধন কিংবা সঞ্চিতির (প্রভিশন) কোনো ঘাটতি ছিল না। ব্যাংকটির আর্থিক প্রতিবেদনে মুনাফাও দেখানো হয়েছিল। ব্যাংকটির মোট সম্পদ ও দায়ের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৯০০ কোটি টাকা। কিন্তু সাত বছর পর এসে সব ক্ষেত্রেই বড় ধরনের ক্ষত তৈরি করেছে ব্যাংকটি।
বর্তমানে পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ ৩ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৬২ শতাংশ। তবে মেয়াদোত্তীর্ণসহ পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণের হার এখন ৮৬ শতাংশেরও বেশি। পুনর্গঠনের পর থেকে ধারাবাহিকভাবে লোকসান দিয়েছে পদ্মা ব্যাংক। এ কারণে ব্যাংকটির পুঞ্জীভূত লোকসানের পরিমাণ ৬৭০ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আবার বিদেশী বিনিয়োগ আসার নামে ব্যাংকটির ২ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকার ক্ষতিকে ইন্টেনজিবল অ্যাসেটে রূপান্তর করা হয়েছে। এ ক্ষতি যুক্ত হলে পদ্মা ব্যাংকের লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকার কাছাকাছি।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী, ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের বিপরীতে পদ্মা ব্যাংকে সাড়ে ১২ শতাংশ হারে মূলধন সংরক্ষণ করার কথা। কিন্তু বর্তমানে ব্যাংকটির মূলধন সংরক্ষণের হার দশমিক ৩৯ শতাংশ। আবার ১ হাজার ৮০০ কোটি টাকার সঞ্চিতি ঘাটতিও রয়েছে ব্যাংকটির।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পুনর্গঠনের পর প্রতি বছরই প্রায় ৪০০ কোটি টাকা করে পরিচালন লোকসান দিয়েছে পদ্মা ব্যাংক। আমানতের সুদ পরিশোধ, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, অফিস ভাড়াসহ বিভিন্ন খাতের ব্যয়ের কারণে ব্যাংকটি কেবল লোকসানই গুনেছে। ধারাবাহিক লোকসানের কারণে পদ্মা ব্যাংকের মূলধন বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো থেকে জোগান দেয়া মূলধনও এখন আর নেই। ব্যাংকটিতে নিরীক্ষা চালালে সম্পদের চেয়ে দায় কয়েক গুণ বেশি হবে।
আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো সাবেক অর্থ সচিব মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরীও মনে করেন ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচতে দেয়া ভুল ছিল। ব্যাংকটিতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হস্তক্ষেপ ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার সময় তিনি অর্থ সচিব হিসেবে দায়িত্বরত ছিলেন। পরে তিনি মহা-হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক (সিএজি) হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। মুসলিম চৌধুরী গতকাল বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে ব্যাংক অনুমোদন দেয়া হলে বন্ধ করে দেয়ার সাহসও থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের সে সাহসের ঘাটতি আছে। তখন যদি ফারমার্স ব্যাংক বন্ধ করে দেয়া হতো, তাহলে আর্থিক ক্ষতি কিছুটা হলেও কম থাকত। পুনর্গঠনের পর ব্যাংকটির কোনো উন্নতি হয়নি। বরং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে যে মূলধন দেয়া হয়েছিল, সেগুলোও শেষ হয়ে গেছে। খেলাপি ঋণসহ অন্য সব সূচকই খারাপ হয়েছে।’
মুসলিম চৌধুরী জানান, তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও চাননি ব্যাংকটি বেঁচে থাক। কিন্তু দেশের ব্যাংক খাতে অস্থিরতা তৈরি হওয়ার ভয়ে তিনি বিলুপ্তির পথে যাননি। তখন ব্যাংকটি বন্ধ করে দিলে অন্য ব্যাংকগুলোর ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ত। আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হতো।
২০১৩ সালে চতুর্থ প্রজন্মের বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে কার্যক্রম শুরু করে দ্য ফারমার্স ব্যাংক লিমিটেড। এ ব্যাংকটি ঋণ জালিয়াতি ও অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে কার্যক্রম শুরুর তিন বছরের মধ্যে মুখ থুবড়ে পড়ে। ধারাবাহিকভাবে গ্রাহকদের আমানতের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৭ সালে ফারমার্স ব্যাংকে হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুনর্গঠন করা হয় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। ওই সময় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর ব্যাংকটির চেয়ারম্যান পদ ছাড়তে বাধ্য হন। একই সময় অপসারণ করা হয় ব্যবস্থাপনা পরিচালককে। এরপর চৌধুরী নাফিজ সরাফাত ব্যাংকটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন।
২০১৯ সালের জানুয়ারিতে ব্যাংকটির নাম পরিবর্তন করে দ্য ফারমার্স থেকে পদ্মা ব্যাংকে রূপান্তর করা হয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে পদ্মা ব্যাংকের ৬৮ শতাংশ শেয়ারের মালিকানা নিয়েছিল রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। বিনিময়ে এসব প্রতিষ্ঠানকে জোগান দিতে হয়েছে ৭১৫ কোটি টাকার পুঁজি। বন্ড কেনার মাধ্যমে ব্যাংকটিকে আরো ২৮৫ কোটি টাকার মূলধন জোগান দেয়া হয়েছিল। ২০১৮ সালের এপ্রিলে দেয়া পুঁজির বিপরীতে এখন পর্যন্ত কোনো মুনাফা পায়নি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। গত কয়েক বছরে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণসহ অন্যান্য আর্থিক সূচকে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি দেখা যায়নি। উল্টো কেন্দ্রীয় ব্যাংক নজিরবিহীনভাবে একের পর এক নীতিছাড় দিয়েছে ব্যাংকটিকে। পদ্মা ব্যাংকের পক্ষ থেকে বিদেশী বিনিয়োগ আনাসহ যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছিল, তার কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি। প্রায় ছয় বছর চেয়ারম্যান পদে দায়িত্ব পালনের পর চলতি বছরের জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে পদ্মা ব্যাংক পর্ষদ থেকে চৌধুরী নাফিজ সরাফাত পদত্যাগ করেন।
পদ্মা ব্যাংকের কাছে এখন গ্রাহকদের আমানত রয়েছে ৬ হাজার ১৮৬ কোটি টাকা। এ আমানত থেকে ৫ হাজার ৭৪১ কোটি টাকার বেশি ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকটি। তবে বিতরণকৃত ঋণের ৬২ শতাংশের বেশি এখন খেলাপি। সারা দেশে ব্যাংকটির শাখা রয়েছে ৬২টি। প্রায় ১ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারীও রয়েছে ব্যাংকটির।
প্রাতিষ্ঠানিক গ্রাহকদের আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হয়ে গত মাসে আমানতকে প্রিফারেন্সিয়াল বা অগ্রাধিকারমূলক শেয়ারে রূপান্তরের উদ্যোগ নেয় পদ্মা ব্যাংক। এজন্য গত ২৮ ফেব্রুয়ারি বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) আয়োজন করেছিল ব্যাংকটি। ওই সভায় সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও তহবিলের ১ হাজার ৮২০ কোটি টাকা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার আমানতকে শেয়ারে রূপান্তরের সিদ্ধান্ত পাস হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ সিদ্ধান্তটিও কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।
শেষ পর্যন্ত শরিয়াহভিত্তিক এক্সিম ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পদ্মা ব্যাংক। এরই মধ্যে বেসরকারি ব্যাংক দুটির মধ্যে এ নিয়ে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর হয়েছে। চুক্তি অনুযায়ী পদ্মা ব্যাংকের যাবতীয় সম্পদ ও দায় এক্সিম ব্যাংকের অনুকূলে স্থানান্তর হবে। তবে পদ্মা ব্যাংকের খেলাপি ঋণ সরকার গঠিত অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিতে চলে যাবে। ব্যাংকটির নিয়মিত ঋণ সার্ভিস করবে এক্সিম ব্যাংক। পদ্মা ব্যাংকের আমানতকারী, গ্রাহক, শাখা-উপশাখা, জনবলসহ যাবতীয় অবকাঠামো এক্সিম ব্যাংকের বলে পরিগণিত হবে। একীভূতকরণ প্রক্রিয়া শেষ হলে দেশের আর্থিক খাতে পদ্মা ব্যাংকের অস্তিত্ব থাকবে না।
ফারমার্স ব্যাংককে বাঁচিয়ে সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে ভুল করেছিল এখনো সেটিই করছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ফারমার্স ব্যাংক টিকে থাকার অবস্থায় ছিল না। কিন্তু সেটিকে অক্সিজেন দিয়ে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছিল। এভাবে বাঁচিয়ে রাখার খেসারত এখন আরো বড় করে দিতে হবে। যে প্রক্রিয়ায় ব্যাংকটি একীভূত হওয়ার প্রক্রিয়ায় যাচ্ছে, সেটিও একটি ভুল পদক্ষেপ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রথম কাজ হবে, দুটি ব্যাংকেই আন্তর্জাতিক মানের নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে অডিট করা। এরপর ব্যাংক দুটি একীভূত হতে পারে কিনা, সেটির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া।’
তবে পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তারেক রিয়াজ খান মনে করেন, ‘তখন ফারমার্স ব্যাংক অবসায়ন হলে আমানতকারীদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি হতো। এতে দেশের আরো ১০-১৫টি ব্যাংকের অবস্থা খারাপ হয়ে যেত। ব্যাংক খাতের অস্থিরতা ঠেকাতেই ব্যাংকটি পুনর্গঠন করা হয়েছিল।’
তিনি বলেন, ‘পদ্মা ব্যাংকের আর্থিক পরিস্থিতি আমরা বাংলাদেশ ব্যাংক ও এক্সিম ব্যাংককে জানিয়েছি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেয়া হলে তখন প্রকৃত পরিস্থিতি আরো পরিষ্কার হবে। এখন আমরা ব্যাংকের যাবতীয় নথিপত্র গোছানোর কাজ করছি।’