জুরাইন নাগরিক অধিকার বাস্তবায়ন পরিষদের সমন্বয়ক মো. মিজানুর রহমান। জ্বর নিয়ে ২১ জুলাই তিনি ঢাকা কমিউনিটি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হন। পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে জানা যায়, তার দেহে সংক্রমণ করেছে ডেঙ্গু ভাইরাস। নিজের চিকিৎসা চলাকালীনই মঙ্গলবার জ্বর নিয়ে একই হাসপাতালে ভর্তি হতে হয় মিজানের সন্তান হৃদ্যতা হাসিনা মৃন্ময়ীর। পরীক্ষা শেষে জানা যায়, সেও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। মাত্র সাড়ে আট বছরের ছোট্ট মেয়েটি এ নিয়ে তৃতীয়বারের মতো ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানান বাবা মিজান।
মিজান কিংবা তার মেয়ে হৃদ্যতাই কেবল নয়, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অন্তর্ভুক্ত এলাকাটির ঘরে ঘরে এখন ডেঙ্গু রোগী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডিএসিসিসি ভুল নিয়মে রাস্তা উঁচু করায় জুরাইনে স্থায়ী জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে, যা এখন মশার অভয়ারণ্য। ফলে মশাবাহিত ডেঙ্গুসহ নানা সমস্যার মুখোমুখি জুরাইনবাসী। এদিকে নিজেদের দায় স্বীকার না করে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ উল্টো এলাকাবাসীকেই দোষারোপ করছে। সংস্থাটির দায়িত্বশীলদের দাবি, রাস্তার সঙ্গে সঙ্গে এলাকাবাসী যদি তাদের ঘরবাড়ি ও ফাঁকা স্থানগুলো উঁচু করে নিত তাহলে সেখানে ডেঙ্গু এত মারাত্মক আকার ধারণ করত না।
৫১, ৫২, ৫৩ ও ৫৪—ডিএসসিসির মোট চারটি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত বৃহত্তর জুরাইন এলাকা। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ উদ্যোগে ‘প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প’ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে ২০২১ সালে করা এক গবেষণায় দেখানো হয়, ডিএসসিসির মধ্যে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বেশি বাস জুরাইন এলাকায়। সরজমিনে দেখা গেছে, সেখানকার প্রায় সব রাস্তাই বাসাবাড়ি ও দোকানপাট থেকে কয়েক ফুট উঁচু। ফলে রাস্তার পাশের প্রতিটি বাড়ির প্রথম তলায় যেতে উল্টো সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামতে হয়। বৃষ্টি হলে পানি জমে জলাবদ্ধতায় রূপ নেয়। ওই জলাবদ্ধতার কারণেই ডেঙ্গুসহ মশাবাহিত রোগের প্রকোপ বেড়েছে বলে জানায় সিটি করপোরেশন।
চলতি বর্ষা মৌসুমের আগে থেকেই জুরাইনে অল্পবিস্তর ডেঙ্গু রোগী পাওয়া যাচ্ছিল। তবে মৌসুম শুরুর সঙ্গে সঙ্গে প্রকট আকার ধারণ করে জুরাইনের ডেঙ্গু পরিস্থিতি। প্রায় প্রতিটি ঘরেই এখন ডেঙ্গু রোগী। স্থানীয়দের অভিযোগ, সিটি করপোরেশন থেকে ঠিকমতো মশার ওষুধ ছিটানো হয় না। মাঝে মধ্যে স্প্রে করা হলেও তাতে মশা মরে না। তাই ওষুধের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তারা। গতকাল দুপুরে জুরাইন চেয়ারম্যানবাড়ির বাসিন্দা আসমা বেগমের সঙ্গে কথা হয়, যার দুই সন্তান ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভর্তি আছে মিডফোর্ট হাসপাতালে। গত সপ্তাহে তার স্বামী মো. রিদওয়ানও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন বলে জানিয়েছেন ওই গৃহবধূ।
জুরাইন মুরাদপুরের বাসিন্দা ইকবাল সিদ্দিকি বলেন, ‘আমিসহ আমার আশপাশের প্রতিটা বাড়িতেই এক-দুজন করে ডেঙ্গু রোগী আছে। অনেকে ডেঙ্গুর উপসর্গ নিয়ে বাড়িতেই চিকিৎসা নিচ্ছে। এমন সংখ্যাই বেশি।’
জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমাদের ঢাকা দক্ষিণে বেশি রোগী এটা প্রচার করা হয়। কিন্তু এর বেশির ভাগই ঢাকার বাইরে থেকে এসে হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। ফলে ঢাকা দক্ষিণের বাসিন্দাদের মধ্যে ডেঙ্গু আক্রান্তের পরিমাণ কম। তবে এটা ঠিক, ডিএসসিসির জুরাইনে অনেক রোগী রয়েছে। এজন্য এলাকাবাসীর অসচেতনতা দায়ী।’
সিটি করপোরেশনের সড়ক উঁচু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের বাড়িঘর ও খোলা জায়গা ভরাট না করার কারণেই সেখানে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব ভয়ংকর আকার ধারণ করেছে বলে মনে করেন ডিএসসিসির এ প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। তিনি বলেন, ‘সড়ক উঁচু করায় পূর্ব জুরাইনের বেশির ভাগ ভবনের নিচতলা রাস্তার উচ্চতা থেকে নিচে নেমে গেছে। অনেক ভবনের নিচতলা ব্যবহারের অনুপযোগী হওয়ায় সেখানে প্রায়ই জমে থাকছে পানি। আবার এলাকায় প্রচুর পরিত্যক্ত ভবন রয়েছে। ওইসব ভবনেও পানি জমে থাকার কারণে এডিস মশা ব্যাপক হারে বংশবৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। এছাড়া এলাকাটি তুলনামূলক নিচু হওয়ায় বিভিন্ন স্থানেই সবসময় পানি জমে থাকে। পরিস্থিতি বিবেচনায় মশক নিধন কার্যক্রমও পর্যাপ্ত নয়। এ কারণে সেখানে ডেঙ্গু পরিস্থিতি খারাপের দিকে চলে গেছে।’
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য ডিএসসিসির ভুল উন্নয়নের কারণেই জুরাইনের মতো এলাকাটি ডেঙ্গুর বিপজ্জনক জোনে পরিণত হয়েছে বলে মনে করছেন। জানতে চাইলে নগরিবদ ও স্থপতি মো. ইকবাল হাবিব বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ঢাকা শহরের ভূপৃষ্ঠের গঠন অনেকটা কচ্ছপের পিঠের মতো। এর মাঝখানটা উঁচু। দুই পাশে ঢালু। এখানে কোনো সড়ক ডিজাইন করতে হলে এ বৈশিষ্ট্য মাথায় রেখেই করতে হয়। আপনি দেখবেন তাজউদ্দীন সড়ক, ফার্মগেট, বিজয় সরণি এগুলো উঁচু সড়ক; আবার ধানমন্ডি ক্রমান্বয়ে ঢালু হয়েছে। জুরাইনেও ক্রমান্বয়ে ঢালু সড়ক নির্মাণের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সিটি করপোরেশন সেটা করেনি। তাদের সে ভুলের কারণেই পূর্ব আর পশ্চিম জুরাইনে ছোট ছোট অসংখ্য আবদ্ধ জলাঞ্চলের সৃষ্টি হয়েছে। ফলে শহরের অন্যান্য নিচু অঞ্চলের মতো পুরো জুরাইনবাসীও দীর্ঘমেয়াদি ভোগান্তিতে পড়েছে। এজন্য সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা দায় এড়াতে পারেন না।’
জুরাইনে সড়ক নির্মাণের পেছনে সিটি করপোরেশনের তত্ত্ববধানের অবহেলা রয়েছে বলে অভিযোগ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খানের। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘সিটি করপোরেশন যখন রাস্তা সংস্কার করে তখন নিয়ম হলো আগের পিচটা তুলে ফেলা। কিন্তু সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা এসব ক্ষেত্রে গাফিলতি করেন। মূলত তদারকির অভাবেই তারা পয়সা বাঁচানোর জন্য আগের পিচ না তুলে নতুন ঢালাই দিয়ে দেন। ফলে জুরাইনসহ ঢাকা শহরের অনেক এলাকায়ই বাসাবাড়ির তুলনায় রাস্তা উঁচু। এসব এলাকায় অল্প বৃষ্টিতেই বাসাবাড়ির ভেতরে পানি ঢুকে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। তাছাড়া ডিএনডি বাঁধের কারণেও জুরাইনের মানুষ জলাবদ্ধতায় ভুগছে। সব মিলিয়ে নানা দিক থেকেই সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে ওই এলাকার বাসিন্দাদের।’
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন স্থানীয়রাও। ডিএসসিসির ৫২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. রুহুল আমিন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আমি নিজেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। উঁচু সড়কের কারণে আমরা মারাত্মক ভোগান্তির শিকার হচ্ছি। শুধু এ বছর বা ডেঙ্গু সমস্যা নয়, সব ধরনের সমস্যা আমাদের মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ডেঙ্গু মোকাবেলায় আমরা যত উদ্যোগই নিচ্ছি না কেন উঁচু সড়কের প্রভাবে সৃষ্ট জলাবদ্ধতার কারণে সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে।’